দেহঘড়ি
শীতের রোগবালাই
শীতের সঙ্গে সর্দি-কাশির সম্পর্ক কী, কেন ব্যথা বেড়ে যায়, একজন চিকিৎসকের কলমে জেনে নিন শীতের রোগবালাই ও প্রয়োজনীয় সতর্কতা…
শীত এলে আবহাওয়া শীতল তো হয়ই, সেই সঙ্গে কমে যায় বাতাসের আর্দ্রতা। ধুলাবালুর পরিমাণ বাড়ে, বাড়ে বায়ুদূষণ। কুয়াশা ও শিশির পড়ে সকাল-সন্ধ্যা। কিছু ভাইরাস ও জীবাণুর জন্য তাপমাত্রার তারতম্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ফলে শীত এলে কিছু রোগবালাইয়ের প্রকোপ বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে শ্বাসতন্ত্র, ত্বকের রোগ, ব্যথা-বেদনা, বাতরোগ ও হাইপোথার্মিয়া উল্লেখযোগ্য।
শ্বাসতন্ত্রের রোগ
যাঁদের শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা আছে, যেমন হাঁপানি বা অ্যাজমা, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসের রোগী বা যাঁদের কোল্ড অ্যালার্জি আছে, তাঁদের জন্য শীতকাল বেশ কষ্টের। এ সময় বাতাসের শীতলতা ও শুষ্কতা এবং বায়ুদূষণের কারণে তাঁদের সমস্যা বেড়ে যায়। এ মৌসুমে হাঁপানি রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। আবার এ সময় ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বলে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণও বেড়ে যায়। শ্বাসতন্ত্রের যে রোগগুলো এ সময় বেশি হয়, সেগুলো নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।
প্রথমেই ফ্লুর কথা বলি। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের আক্রমণে ফ্লু হয়। এটি বাতাসে ড্রপলেট (তরলের ফোঁটা বা কণা) আকারে ছড়ায় বলে দ্রুতই একজন থেকে অন্যজনের দেহে সংক্রমিত হয়। ফলে বাড়িতে, স্কুলে বা ভিড়ভাট্টায় একজন থেকে বহুজন আক্রান্ত হতে পারেন। এতে নাক, গলনালি আর শ্বাসতন্ত্রের উপরিভাগ আক্রান্ত হয় এ সময়। জ্বর, সর্দি, হাঁচি, কাশি, গলা খুসখুস, গলাব্যথা, মাথাব্যথা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। ভাইরাসের সংক্রমণ বলে এর তেমন কোনো চিকিৎসা নেই, তবে টিকা রয়েছে। শীতের শুরুতে বয়স্ক ব্যক্তি ও দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা এই টিকা নিয়ে নিলে ভালো। ফ্লু হলে বিশ্রাম, যথেষ্ট তরল, পুষ্টিকর খাবার ও প্যারাসিটামলই চিকিৎসা। ভাইরাস জ্বর সাত দিনের মধ্যে এমনিতেই সেরে যাবে।
রেসপিরেটরি সিনসাইটিয়াল ভাইরাস (আরএসভি) নামের একধরনের ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যায় শীতকালে। এই ভাইরাস শিশুদের আক্রমণ করে। শীত মৌসুমেই এ আক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয়। উপসর্গ অনেকটা ফ্লুর মতোই—জ্বর, সর্দি, কাশি, অরুচি, বুকে ঘড়ঘড় শব্দ। নবজাতক ও প্রিম্যাচিউর শিশুদের জন্য জটিল হতে পারে, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ৭-১৪ দিনের মধ্যে সেরে যায়।
নিউমোনিয়ার কথা আমরা সবাই জানি। শীতকালে এই নিউমোনিয়া বা ফুসফুসের সংক্রমণ বেড়ে যায়। ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে স্ট্রেপটোকক্কাস নিউমোনি, হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা, লিজিওনেলা ইত্যাদি জীবাণু গুরুতর নিউমোনিয়া সৃষ্টি করতে পারে। উচ্চমাত্রার জ্বর, তীব্র কাশি, কফ, মাথাব্যথা ও শ্বাসকষ্টের মতো উপসর্গ দেখা যেতে পারে এ সময়। রোগের তীব্রতা বেড়ে গেলে রেসপিরেটরি ফেইলিউর হয়ে মারাও যেতে পারেন রোগী। নিউমোনিয়া হলে তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে দ্রুত অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা শুরু করা উচিত। প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া লাগতে পারে।
ফ্লু হলে বিশ্রাম, যথেষ্ট তরল, পুষ্টিকর খাবার ও প্যারাসিটামলই চিকিৎসা। ভাইরাস জ্বর সাত দিনের মধ্যে এমনিতেই সেরে যাবে
আরেকটি বড় সমস্যা হাঁপানি। শীতকালে হাঁপানি রোগীর শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায় শীতল আবহাওয়া ও ধুলাবালুর জন্য। শ্বাসের সঙ্গে বাঁশির মতো আওয়াজ বা ঘড়ঘড় শব্দ, শ্বাসকষ্টের জন্য কথা শেষ করতে না পারা এবং পাঁজরের খাঁচা দেবে যাওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দিলে বুঝতে হবে হাঁপানির মাত্রা তীব্র হয়েছে। অনেক সময় সমস্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে অক্সিজেন, নেবুলাইজার, স্টেরয়েড ইনজেকশন দরকার হতে পারে। তাই যাঁদের হাঁপানি আছে, শীতের শুরুতেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ইনহেলারের মাত্রা ঠিক করে নিলে ভালো।
ব্রঙ্কাইটিস নামের আরেকটি সমস্যা আছে। ধূমপায়ীরা সাধারণত ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসের রোগী হয়ে থাকেন। শীতে তাঁদের কাশি, কফ, শ্বাসকষ্ট বাড়ে। বায়ুদূষণে তাঁদের সমস্যা হয় সবচেয়ে বেশি। হাঁপানি রোগীর মতোই অক্সিজেন, নেবুলাইজার, অ্যান্টিবায়োটিক দরকার হতে পারে তাঁদের এ সময়।
ত্বকের রোগ
শীতকালে পরিবেশের মতো ত্বকও শুষ্ক হয়ে পড়ে। বাড়ে ত্বকের নানা সমস্যা। ঠোঁট ফাটা, পা ফাটার মতো সমস্যা তো আছেই। এর সঙ্গে শীতে বাড়ে মাথার খুশকি বা সেবোরিক ডার্মাটাইটিস, ত্বকের একজিমা বা অ্যাটপিক ডার্মাটাইটিস, সোরিয়াসিস, স্ক্যাবিস বা খোসপাঁচড়ার মতো সমস্যা। এসব সমস্যায় ত্বক শুষ্ক হয়ে ফেটে যায়, কখনো লাল হয়ে যায়, চুলকায়। শীতে ত্বক সুস্থ রাখতে যথেষ্ট পানি পান করতে হবে, যাতে ত্বক পানিশূন্য না হয়ে যায়। ত্বক আর্দ্র রাখতে বারবার ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে। খুব গরম পানি ব্যবহার করলে শুষ্কতা বাড়ে, তাই হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল ও অন্য কাজ করতে হবে। প্রতিবার হাত–মুখ ধোয়া বা গোসলের পর আর্দ্র অবস্থাতেই ময়েশ্চারাইজার লাগানো ভালো। ঠোঁটে ভালো মানের পেট্রোলিয়াম জেলি বা গ্লিসারিন লাগানো ও ঠোঁট চাটা বা চামড়া ওঠানোর অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। পায়ে সব সময় সুতি মোজা পরা ভালো। পা রাতে ভালো করে পরিষ্কার করে পুরু করে ময়েশ্চারাইজার লাগাতে হবে। খুশকি রোধে অ্যান্টি–ড্যানড্রাফ শ্যাম্পু ব্যবহার, মাথার ত্বক পরিষ্কার রাখা জরুরি। একে অন্যের তোয়ালে, বালিশ, চিরুনি, পোশাক ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না। স্ক্যাবিস বা খোসপাঁচড়া সংক্রামক। তাই হোস্টেলে, মেসে, স্কুলে ছড়ায়। শীতে এই রোগের প্রকোপ বাড়ে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পরিবারের সবাই বা এক ঘরের সবাই একসঙ্গে চিকিৎসা নিতে হবে।
ব্যথা–বেদনা ও বাতরোগ
শীতে বাতরোগী ও বয়স্কদের ব্যথা-বেদনা বেড়ে যায়। এর কারণ, ক্ষুদ্র রক্তনালির ঠান্ডাজনিত সংকোচন ও জয়েন্টে রক্তপ্রবাহ কমে যাওয়া। এ ছাড়া বায়ুচাপের তারতম্য জয়েন্টের ব্যথা বাড়িয়ে দিতে পারে। শীতে বয়স্কদের সচলতা কমে, এটিও ব্যথা বাড়ার একটি বড় কারণ।
ব্যথা কমাতে হলে একটু সচল হতে হবে, ব্যায়াম ও শরীরচর্চা করলে রক্তসঞ্চালন বাড়বে। শীতে বাইরে হাঁটতে যাওয়া সম্ভব না হলে ঘরেই ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করা ভালো। গরম সেঁক দিলে রক্তপ্রবাহ বাড়ে এবং শীতে বেশ আরাম পাওয়া যায়
ব্যথা কমাতে হলে একটু সচল হতে হবে, ব্যায়াম ও শরীরচর্চা করলে রক্তসঞ্চালন বাড়বে। শীতে বাইরে হাঁটতে যাওয়া সম্ভব না হলে ঘরেই ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করা ভালো। গরম সেঁক দিলে রক্তপ্রবাহ বাড়ে এবং শীতে বেশ আরাম পাওয়া যায়। অনেকে রাতে হট ওয়াটার ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে শুতে যান। তাঁরা সাবধান থাকবেন যেন অতিরিক্ত গরম ক্রমাগত ত্বকে লেগে পুড়ে না যায়। গরম পানির সেঁক নেওয়ার সময়ও সাবধান; অতিরিক্ত গরম পানিতে পা ডুবিয়ে অনেকে পা পুড়িয়ে ফেলেন। এ সমস্যা বেশি হয় ডায়াবেটিক রোগীদের। কারণ, তাঁদের স্নায়বিক দুর্বলতার জন্য অনুভূতি কম থাকে। অনেকে রুম হিটার ব্যবহার করেন। তাঁদের ঘরের বাতাস বেশি শুষ্ক হয়ে পড়তে পারে। তাই ঘরের কোণে এক গামলা পানি রেখে দিলে ভালো।
হাইপোথার্মিয়া
পরিবেশের তাপমাত্রা যখন অনেক নিচে নেমে যায়, তখন যাঁরা বাইরে তীব্র ঠান্ডায় অনেকক্ষণ কাজ করেন, তাঁদের ফ্রস্টবাইট, হাইপোথার্মিয়ার মতো সমস্যা হতে পারে। বয়স্ক ব্যক্তি, ছোট শিশু, ভবঘুরে, গৃহহীন মানুষ, কৃষক ও অন্য যাঁরা বাইরে এবং ভেজা জায়গায় কাজ করেন, তাঁরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। হাইপোথার্মিয়া হলে দেহের তাপমাত্রা ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইটের নিচে নেমে যেতে পারে। কাঁপুনি, শীতল ত্বক, তারপর ধীরে ধীরে অসংলগ্ন কথাবার্তা, চেতনা কমে যাওয়া থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। হাত–পা ও উন্মুক্ত স্থানে ফ্রস্টবাইট হতে পারে। তীব্র ঠান্ডায় রক্তনালির তীব্র সংকোচন থেকে নীলচে ও ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, অনুভূতিহীন হয়ে পড়া থেকে শুরু করে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গ্যাংগ্রিন হতে পারে ফ্রস্টবাইট হলে।
তীব্র শীতে তাই অবশ্যই স্তরে স্তরে পোশাক পরতে হবে, মাথায় গরম টুপি, হাতে দস্তানা ও পায়ে মোজা পরতে হবে। শীতে কাউকে হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে থাকতে দেখলে দ্রুত বাইরের ঠান্ডা আবহাওয়া থেকে ঘরে বা অপেক্ষাকৃত উষ্ণ স্থানে নিতে হবে
তীব্র শীতে তাই অবশ্যই স্তরে স্তরে পোশাক পরতে হবে, মাথায় গরম টুপি, হাতে দস্তানা ও পায়ে মোজা পরতে হবে। শীতে কাউকে হাইপোথার্মিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে থাকতে দেখলে দ্রুত বাইরের ঠান্ডা আবহাওয়া থেকে ঘরে বা অপেক্ষাকৃত উষ্ণ স্থানে নিতে হবে। ভেজা কাপড় থাকলে তা খুলে গরম শুকনা কাপড় পরাতে হবে বা কম্বল দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গরম পানির বোতল দিয়ে রাখা যেতে পারে। তবে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়াই উত্তম।
রোগবালাই ছাড়াও শীতে দুর্ঘটনার প্রবণতাও বাড়ে। আমাদের দেশে শীতকালে গরম পানি গায়ে পড়ে পুড়ে যাওয়া এবং আগুন পোহাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার সংখ্যা অনেক। বাড়িতে পানি গরম করার সময় শিশুদের দূরে রাখতে হবে, সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কুয়াশার মধ্যে যানবাহন দুঘর্টনাও ঘটে। সে ক্ষেত্রেও সাবধানতা দরকার। শীত এলে বেড়ানো ও উৎসব–অনুষ্ঠান বেড়ে যায়। সতর্ক থাকলে নানা রকম অসুস্থতা ও দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
