গাছেরাও কথা বলে!

নোবেলজয়ী মার্কিন বিজ্ঞানী ও সবুজ বিপ্লবের প্রবক্তা নরম্যান বোরলগ বলেছিলেন, ‘গাছেরা কথা বলে ফিস ফিস করে। সে কথা শুনতে হলে যেতে হবে তাদের কাছে।’ অর্থাৎ গাছও কথা বলে! কয়েকদিন আগে বাজার থেকে একটা খেলনা টকিং ক্যাকটাস কিনেছিলাম। সুইচ অন করে তার সামনে আমরা যে যেভাবে বলি, সেই খেলনা ক্যাকটাসটাও ঠিক সেভাবেই কথা বলছিল। খেলনাটাকে হয়তো সেভাবেই বানানো হয়েছে। কিন্তু গাছ? সে কি আসলেই কথা বলে? ওদের ঠোঁট-মুখ-দাঁত নেই যে ওরা কথা বলবে। মানুষের এগুলো আছে বলেই সে অন্যের সঙ্গে কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। বিভিন্ন প্রাণীও পারে। প্রজাপতি, পাখি, ঝিঁঝিঁ পোকা—এদেরও নিজস্ব ভাষা আছে। ফুলের কি সেরকম কোনো ভাষা আছে, যা দিয়ে নিজেরা নিজেদের মধ্যে বা অন্য কারো সঙ্গে কথা বলতে পারে? অনেক উদ্ভিদ বিজ্ঞানীই এসব নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন, জানতে চেয়েছেন আসলে উদ্ভিদের ভাষা কী? কীভাবে তারা একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে?

একটা ফুলের কথাই ধরা যাক। ফুলে ফুলে মৌমাছি ঘোরে কেন? পাতার কথা যদি বলি, পাতায় কেন শুঁয়াপোকার মা এসে বসল, ডিম পাড়ল, আর সেসব ডিম ফুটে সেখানে বাচ্চা বেরিয়ে পাতাটাকে খাওয়া শুরু করল? কেন এসব ঘটছে? লক্ষ করেছি, কিছু পোকা নির্দিষ্ট গাছ ছাড়া অন্য গাছে বসতেই চায় না। কিছু প্রজাপতি নির্দিষ্ট কিছু গাছের ফুলেই ঘুরে বেড়ায়। বিজ্ঞানীরাও তা দেখেছেন। তাঁরা বলছেন, প্রতিটি উদ্ভিদের বিশেষ একধরনের গন্ধ আছে। বলা যায় সিগন্যাল দেওয়ার পদ্ধতি। উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশের গন্ধ বিভিন্ন রকম। তাই সেসব গন্ধ শুঁকে গাছের সে অংশ খুঁজে পেতে পোকাদের কোনো অসুবিধা হয় না। এই গন্ধ তৈরি করে উদ্ভিদের কিছু উদ্বায়ী জৈব যৌগ, যাকে ইংরেজিতে বলে ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড বা সংক্ষেপে ভিওসি (VOCs)।

উদ্ভিদ এসব জৈব রাসায়নিক বাতাসে ছড়িয়ে দিলে সে গন্ধ পেয়ে ছুটে আসে পতঙ্গরা। এমনকি ছাগলও হয়তো তা বোঝে। এ কারণে ছাগলের প্রথম পছন্দ কাঁঠাল পাতা। আর একেবারে অপছন্দ অড়হর গাছের পাতা। কাঁঠাল পাতা ছাগলের দেহে প্রোটিন তৈরিতে দারুণ ভূমিকা রাখে। তাই ছাগল এটা বেশি পছন্দ করে। কিন্তু ছাগল এটা বুঝল কী করে? গাছ এই উদ্বায়ী জৈব যৌগ দিয়ে শুধু যে বিভিন্ন প্রাণীকে তার কাছে টেনে আনে, ব্যাপারটা শুধু তা নয়। কোনো গাছ যখন বিপদে পড়ে, তখন তার কথা সে পাশের গাছকে জানিয়ে দেয় বিশেষ একরকম উদ্বায়ী যৌগ নিঃসরণ করে। আবার অনেক সময় গাছ তার দেহ থেকে এমন কিছু উদ্বায়ী জৈব যৌগ বা জৈব রাসায়নিক দ্রব্য ছাড়ে, যার কারণে আগত প্রাণীরা বিভ্রান্ত ও বিতাড়িত হয়।

গাছ যখন কোনো বিপদে পড়ে, তখনই তারা এই উদ্বায়ী জৈব যৌগ নিঃসরণ করে বলে জানা গেছে। শুধু বিপদে নয়, গাছের নিজেদের কিছু বিশেষ প্রয়োজনেও সে এটা নিঃসরণ করে।

গাঁদা ফুলগাছের শিকড় এমন একধরনের জৈব রাসায়নিক যৌগ মাটিতে নিঃসরণ করে, যার কারণে গাঁদা ফুলগাছের আশপাশে থাকা গাছেদের শিকড়ের কাছে শিকড়ে গিঁট সৃষ্টিকারী কৃমিরা ঘেঁষতে পারে না। কৃমিদের জন্য গাঁদা ফুলগাছ বিতাড়ক বা বিকর্ষক হিসেবে কাজ করে। ফলে সেসব গাছে আর কৃমির সংক্রমণ হয় না। কৃমি রোগও সৃষ্টি হতে পারে না।

প্রতিটি গাছই প্রকৃতিতে অনেক রকম ধকল ও ঝুঁকির মধ্যে বেঁচে থাকে। গাছকে সইতে হয় রোগের যন্ত্রণা, পোকার কামড়, মানুষের কুঠারের আঘাত ও কাঁচির খোঁচা, আবহাওয়ার চরম তাপদাহ, শৈত্যপ্রবাহ, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা ইত্যাদি। এ জন্য গাছকে এসব ধকল সহ্য করে টিকে থাকতে হলে খাপ খাওয়ানোর কিছু কৌশল রপ্ত করতে হয়। ঘটাতে হয় কিছু শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন। কী করতে হবে, তা বুঝতে হলে গাছকে নিজের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের জন্য উদ্বায়ী জৈব যৌগভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়।

গাছ যখন কোনো বিপদে পড়ে, তখনই তারা এই উদ্বায়ী জৈব যৌগ নিঃসরণ করে বলে জানা গেছে। শুধু বিপদে নয়, গাছের নিজেদের কিছু বিশেষ প্রয়োজনেও সে এটা নিঃসরণ করে। ফুলের কথা ধরা যাক। একটি উভলিঙ্গ ফুলের ভেতরে থাকে পুরুষ ও স্ত্রী জননাঙ্গ। পুরুষ জননাঙ্গের পরাগধানীতে থাকে পরাগরেণু আর স্ত্রী জননাঙ্গের গর্ভদণ্ডের মাথায় থাকে গর্ভমুণ্ড। যখন ফুল ফোটে তখন গর্ভমুণ্ড একধরনের আঠালো পদার্থ নিয়ে পরাগরেণু গ্রহণের জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করে। গর্ভমুণ্ডের মাথায় সেই পরাগরেণু পড়লে হয় পরাগায়ন। পরাগায়নের পর হয় গর্ভাধান ও নিষিক্তকরণ। তারপর জন্ম নেয় ফল ও বীজ। প্রাকৃতিকভাবে বাতাস বা অন্যভাবে কিছু ফুলের পরাগায়ন ঘটে। তবে ফুলের পরাগায়ন বেশি ঘটায় পতঙ্গরা। তাই ফুলের এই কম্মটি করার জন্য ফুল আমন্ত্রণ জানায় পতঙ্গদের। ফুল তার পাঁপড়ি থেকে বাতাসে এমন একধরনের উদ্বায়ী জৈব রাসায়নিক যৌগ বাতাসে ছেড়ে দেয়, পাঁপড়িতে বিভিন্ন রঞ্জকের সমন্বয়ে এমন রং সৃষ্টি করে, যাতে পতঙ্গকুল সেসব ফুলের দিকে আকৃষ্ট হয়। আবার দাওয়াত দিয়ে ফুল অতিথির কাছ থেকে উপকৃত হলে সেও অতিথিকে আপ্যায়ন করে তার আসব বা মধু খাইয়ে। পরস্পরের মধ্যে এ যোগাযোগকে প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম বললেও আসলে এর পেছনে রয়েছে এক রহস্যময় বৈজ্ঞানিক ঘটনা।

একটা গাছ যখন বিপদে পড়ে বা আক্রান্ত হয়, তখন তার প্রতিক্রিয়া গাছের মধ্যে দেখা যায়। গাছ তখন পাশের গাছকে সে কথা জানিয়ে দেয় একধরনের জৈব যৌগ উত্পাদন ও নিঃসরণের মাধ্যমে। বাতাসে সেই উদ্বায়ী পদার্থ ভেসে ভেসে চলে যায় পাশের গাছগুলোর কাছে। আক্রান্ত গাছটি ওসব গাছকে তখন সেই যৌগের মাধ্যমে বিপদ সংকেত বা এসওএস পাঠায়। বলে—ভাই আমি বিপদে পড়েছি, তুমি শিগগিরই তোমার মধ্যে এই বিপদ থেকে বাঁচার জন্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোল। নিজেদের আরও শক্তিশালী করো।

ভারী অদ্ভুত বায়ুবাহিত সেসব ভাষা! গ্রহীতা গাছই যে কেবল সে ভাষা বা সংকেত বুঝতে পারে, শুধু তাই না; সেসব গাছের রক্ষাকারীরাও সে ভাষা কিছুটা বুঝতে পারে। তাই তারাও তখন সে গাছকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসে। শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়।

একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা আরও ভালোভাবে বোঝা যাবে। জাব পোকা নামে একধরনের ক্ষতিকর পোকা আছে। শিমগাছে এদের প্রচুর দেখা যায়। এরা সেসব গাছ থেকে রস চুষে খেয়ে গাছের সর্বনাশ করে। গাছের মধ্যে ভাইরাস জীবাণু ঢুকিয়ে দেয় সেসব বাহক পোকারা। কিন্তু পোকাদের কাছে এ ভাইরাস আসে কোথা থেকে। জাব পোকা যখন কোনো ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত গাছের রস চুষে খায়, তখন সে রসের সঙ্গে গাছের ভাইরাস ওদের মুখের মধ্যে চলে আসে। মুখের মধ্যে তিন ঘণ্টার বেশি সময় সেসব ভাইরাস জীবাণুরা সক্রিয় থাকে। যখন জাব পোকারা অন্য কোনো সুস্থ শিমগাছে বসে ও সেখান থেকে রস চুষে খাওয়া শুরু করে, তখন সেসব ভাইরাস সেই সুস্থ গাছের কোষে ঢুকে পড়ে ও মোজাইক ভাইরাস রোগ রোগ সৃষ্টি করে।

এ রোগের কারণে শিমের পাতায় হলদে-সবুজ নকশা কুটে মোজাইকের মতো দাগ তৈরি হয়। পাতা কুঁকড়ে যায়, ফুল শুকিয়ে যায়, বিকৃত হয় শিম। এটি কোনো গাছে ঘটলে সেসব গাছ অন্য গাছদের খবর পৌঁছে দেয়। অন্য গাছেরা সে খবর জানতে পারে আক্রান্ত গাছ থেকে একধরনের জৈব রাসায়নিক পদার্থের গন্ধ থেকে। তখন গাছেরা সেই শত্রুর বিরুদ্ধে নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। অথবা যারা জাব পোকার সঙ্গে যুদ্ধ করে মারতে পারে, তাদের গাছ আহ্বান জানায়।

দেখা গেছে লেডি বার্ড বিটল নামে একধরনের পরভোজী পোকা জাব পোকাদের শিকার করে খায়। তখন গাছ এমন একধরনের উদ্বায়ী রাসায়নিক যৌগ নিঃসরণ করে, যার গন্ধে লেডি বার্ড বিটলরা আকৃষ্ট হয় ও সেই গাছে এসে বসে। জাব পোকারা পাশের গাছ থেকে এসে সেই গাছে বসলে তখন লেডি বার্ড বিটল তাদের ধরে শিকার করে। ফলে গাছ জাব পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়।

গবেষকরা দেখেছেন, প্রতিটি গাছের প্রজাতি ও ঘটনা বা পরিস্থিতির সঙ্গে এসব উদ্বায়ী জৈব রাসাযনিক যৌগের উপাদানও বদলে যায়। কখনো তা এককভাবে, আবার কখনো কয়েকটি যৌগের সংমিশ্রণে হয়। ভারী অদ্ভুত আর নাটকীয় এসব বিষয়! গবেষকরা একই গাছের মধ্যে সংকেত পাঠানো ও একটি গাছ থেকে অন্য গাছে সংকেত আদান প্রদানের এসব ভাষার রহস্য বুঝতে অনেক গবেষণা করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, গাছেরা যোগাযোগের জন্য একটি যৌগ ব্যবহার করে, নাকি কয়েকটি জৈব রাসায়নিক যৌগের মিশ্রণ ব্যবহার করে?

গবেষণার আরেকটি মজার দিক পাওয়া গেল যখন টমেটো গাছের সেই উদ্বায়ী যৌগ শনাক্ত করে, একটি চেম্বারে কৃত্রিম টমেটো গাছ লাগিয়ে সেই চেম্বারটি পূর্ণ করা হলো টমেটো ভিওসি রাসায়নিকে।

এক গাছের সঙ্গে অন্য গাছের যোগাযোগ

গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন, যখন অক্ষত পপলার ও সুগার মেপল গাছ কোনো ক্ষতিগ্রস্ত গাছের কাছে অবস্থান করে, তখন দেহের মধ্যে কিছু ফেনলিক যৌগ ও ট্যানিন জমা করে। সেজব্রাশ (বৈজ্ঞানিক নাম: আর্টেমিসিয়া ট্রাইডেনটাটা, Artemisia tridentata) নামে এক প্রজাতির উদ্ভিদ মিথাইল জেসমোনেট (MeJA) নামে এক প্রকার রাসায়নিক যৌগ নিঃসরণ করে, যা পত্রভূক জীবের বিরুদ্ধে উদ্ভিদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। আর ক্ষতিগ্রস্ত গাছ এটা করতে অক্ষত গাছকে উদ্দীপ্ত করে সংকেত পাঠায়। যদিও গবেষকরা আসলে এ ধরনের যোগাযোগের বিষয়ে এখনও খুব স্পষ্ট ধারণা পাননি। তবে এটা যে ঘটছে, তা তাঁরা নিশ্চিত। আরও কী কী বিষয়ের সঙ্গে জড়িত বা আন্তঃউদ্ভিদ যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে, তা এখন পরবর্তী গবেষণার বিষয়। গবেষকরা গ্যাস ক্রোমোটোগ্রাফি—মাস স্পেক্ট্রোস্কোপি যন্ত্র ব্যবহার করে উদ্ভিদ নিঃসরিত উদ্বায়ী জৈব যৌগগুলো শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন। তাঁরা অসংখ্য টারপিনয়েড রাসায়নিক যৌগের সন্ধান পেয়েছেন, যার মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক যৌগ আন্তঃউদ্ভিদ যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। সমভাবে তারা লিপিড থেকে উদ্ভুত কিছু গ্রিন লিফ ভোলাইটলসের (Green leaf volatiles) সন্ধান পেয়েছেন। সি১৮ ফ্যাটি অ্যাসিড এসব উত্পাদন করে, বিশেষ করে লিনোলিনিক অ্যাসিড। এ ছাড়াও রয়েছে ওলেফিন ইথিলিন ও আইসোপ্রিন, অক্সিলিপিন মেটাবোলাইটস, সিস-জেসমোন ইত্যাদি উদ্বায়ী যৌগ। শিমজাতীয় একধরনের উদ্ভিদ (বৈজ্ঞানিক নাম: ফাসেওলাস ল্যান্টাস, Phaseolus lunatus) বিটা-ওসিমিন, ডিএমএনটি (4,8-dimethyl-1,3,7-nonatriene) ও টিএমটিটি (4,8,12-trimethyl-1,3,7,11-tridecatetraene) উদ্বায়ী জৈব যৌগ নিঃসরণ করে যা, স্পাইডার মাইট বা লাল ক্ষুদ্র মাকড়ের আক্রমণ প্রতিহত করতে ভূমিকা রাখে। এসব উদ্বায়ী যৌগ অক্ষত সবুজ পাতার ভেতর এলওএক্স, এফপিএস ও কিছু পিআর জিনের প্রকাশকে উদ্দীপিত করে, যারা লাল মাকড়ের সংক্রমণে বাধা দেয়। অন্যদিকে গ্রিন লিফ ভোলাটাইলস ভূট্টার (Zea mays) দীর্ঘকালীন মজুদের সময় তার ভেতর জেসমোনিক অ্যাসিড সঞ্চয়নে উত্সাহিত করে। এটা ভূট্টাখেকো পোকাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জনে সাহায্য করে। কোন উদ্বায়ী যৌগ আসলে আন্তঃউদ্ভিদ যোগাযোগের ক্ষেত্রে কি ভূমিকা রাখে, তা এখন পরবর্তী গবেষণার বিষয়।

ছবি: আন্তঃউদ্ভিদ যোগাযোগের ক্ষেত্রে সংকেত আদান-প্রদানে ভূমিকা রাখে অক্সিলিপিন ও টারপিনয়েড উদ্বায়ী জৈব যৌগগুলো

এ দেশে স্বর্ণলতা নামে একধরনের পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ জন্মে। তাদের কোনো শিকড় নেই। অন্য গাছের ওপর আশ্রয় নিয়ে গাছ থেকে ও বাতাস থেকে খাদ্য ও পানি শোষণ করে বেঁচে থাকে। ফুলও দেয়। কিন্তু সব গাছের ওপর তারা জন্মায় না বা জন্মাতে পারেও না। কোন গাছ তার আশ্রয়ের জন্য ভালো হবে, তা স্বর্ণলতা কীভাবে বোঝে? রানইয়ন ও তাঁর সঙ্গীরা ২০০৬ সালে স্বর্ণলতার (বৈজ্ঞানিক নাম: কুসকুটা পেন্টাগোনা, Cuscuta pentagona) ওপর এক গবেষণা চালান। গবেষণার বিষয়: কী করে উদ্বায়ী জৈব যৌগ বা ভিওসি ব্যবহার করে তারা আশ্রয়দাতার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে, এমনকি সে গাছের কোন অংশে তারা আশ্রয় নেবে সেটাও ঠিক করে ফেলে! গবেষকরা এ বিষয়টি দেখার জন্য দুটি চেম্বারে টমেটো গাছের সঙ্গে স্বর্ণলতার যোগাযোগের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেন। একটি চেম্বারে রাখেন সত্যিকার টমেটো গাছ (বৈজ্ঞানিক নাম: লাইকোপারসিকন ইসুলেন্টাম Lycopersicon esculentum) ও স্বর্ণলতার চারা। অন্য চেম্বারে রাখেন একটি কৃত্রিম টমেটো গাছ ও স্বর্ণলতার চারা। মাত্র চার দিনের মাথায় তারা দেখতে পান, স্বর্ণলতা টমেটো গাছকে আঁকড়ে ধরে বাড়তে শুরু করেছে। কিন্তু অন্য চেম্বারে কৃত্রিম টমেটো গাছের ধারে কাছেও যায়নি স্বর্ণলতা। তাঁরা বুঝতে পারেন, টমেটো গাছ এমন কিছু উদ্বায়ী জৈব যৌগ নিঃসরণ করে, যা স্বর্ণলতাকে আকর্ষণ করেছে।

গবেষণার আরেকটি মজার দিক পাওয়া গেল যখন টমেটো গাছের সেই উদ্বায়ী যৌগ শনাক্ত করে, একটি চেম্বারে কৃত্রিম টমেটো গাছ লাগিয়ে সেই চেম্বারটি পূর্ণ করা হলো টমেটো ভিওসি রাসায়নিকে। তখন দেখা গেল, স্বর্ণলতা ঠিকই কৃত্রিম সেই টমেটো গাছের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ থেকে তারা বুঝতে পারেন, আন্তঃউদ্ভিদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভিওসি ভূমিকা রাখে।

একবারও কি ভেবেছি, বনের মধ্যে যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে আমাদের পায়ের তলায় মাটির নিচে কত সব ঘটনা ঘটে চলেছে! কী আছে সেখানে? বনের এত গাছদের কে খাওয়ায়? কোন বনের গাছে কে সার দিতে যায়?

নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ

গাছের সঙ্গে গাছের যোগাযোগের ক্ষেত্রে বা গাছের সঙ্গে অন্য জীবের যোগাযোগের ক্ষেত্রে শুধু যে কিছু উদ্বায়ী জৈব রাসায়নিক যৌগ দায়ী, তা নয়। আরও অনেক বিষয় এর সঙ্গে রয়েছে। যেমন গাছেদের মধ্যে একধরনের বৈদ্যুতিক সংকেত আদান-প্রদানের রীতিও দেখা যায়। আমরা যেমন চিমটি খেলে ‘উহ’ করে উঠি, চিমটির সে ব্যথা সঙ্গে সঙ্গে সংকেত পাঠিয়ে দেয় মস্তিষ্কে। ঠিক সেরকমই গাছেরও অনুভূতি রয়েছে। গাছ সূর্যের আলোর দিকে মুখ করে থাকে, পাতাদের এমনভাবে সাজায় যেন পাতাগুলো রোদ বা আলো পায় ও খাদ্য তৈরি করতে পারে। গাছের আমাদের মতো সুগঠিত স্নায়ুতন্ত্র নেই। তবে তারা পাতা থেকে শাখায়, শাখা থেকে কুঁড়িতে, কুঁড়ি থেকে ফুলের পাঁপড়িতে সংকেত পাঠায়।

কোনো ঘটনা ঘটলে গাছ সে কথা শিকড়কেও বলে। শিকড় তখন সেই মতো ব্যবস্থা নেয়। পুরো ব্যাপারটা ঘটে একধরনের বৈদ্যুতিক সংকেত প্রদান প্রবাহতন্ত্রের মাধ্যমে। সেই আঠারো শতকেই বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন সে কথা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তার মাথায় কিছুতেই আসছিল না যে কলস উদ্ভিদের বা ভেনাস ফ্লাইট্র্যাপ গাছের ঢাকনাগুলো কেন মাছি বসার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়। সংকেতে কীভাবে গাছেরা বুঝতে পারে? আবার সেসব মাছিদের আটকে মেরে তা বেমালুম হজমও করে ফেলে। পতঙ্গভূক উদ্ভিদগুলোর নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের এ রহস্য সত্যিই বিস্ময়কর।

গবেষকরা দেখেছেন, উদ্ভিদ দুই ধরনের বৈদ্যুতিক সংকেত ব্যবহার করে। অ্যাকশন পটেনশিয়াল ও ভেরিয়েশন পটেনশিয়াল। অ্যাকশন পটেনশিয়ালের সাড়া প্রদান প্রক্রিয়া অনেকটা প্রাণীদের মতো। উদ্ভিদের মধ্যে ক্যালসিয়াম চ্যানেলের মাধ্যমে সেই সংকেত যায় ও আসে। ভেরিয়েশন পটেনশিয়াল সম্পর্কে গবেষকরা এখনও খুব সুনিশ্চিত তথ্য খুঁজে পাননি। পেলেও তা খুব সন্তোষজনক কিছু নয়।

মাটির নিচে উদ্ভিদের ইন্টারনেট

বনের মধ্যে যখন হেঁটে বেড়াই, কত আনন্দই না হয়। বনের গাছপালা দেখি, ফুল দেখি, পাখিরা উড়ে যাচ্ছে গাছ থেকে গাছে, প্রজাপতিরা উড়ছে ফুলে ফুলে, গাছদের ঝাকড়া মাথা ফুঁড়ে চুইয়ে নামছে সূর্যের রশ্মি। মোটা মোটা গাছগুলো কী বিশালত্ব নিয়ে যুগের পর যুগ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু একবারও কি ভেবেছি, বনের মধ্যে যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে আমাদের পায়ের তলায় মাটির নিচে কত সব ঘটনা ঘটে চলেছে! কী আছে সেখানে? বনের এত গাছদের কে খাওয়ায়? কোন বনের গাছে কে সার দিতে যায়? কোথায় পায় গাছগুলো এত পুষ্টি? বনের কোন গাছটা দুর্বল? গাছদের সতেজ রাখতে, অর্থাৎ পুষ্টির যোগান দিতে মাটির নিচে এক বিস্ময়কর জগত রয়েছে। যেখানে বাস করে অনেক জীব ও অণুজীবেরা। ব্যাকটেরিয়া অণুজীবেরা মাটির জৈব পদার্থ পচিয়ে গাছকে পুষ্টি দেয়। কেঁচো তার মল ত্যাগ করে মাটিকে উর্বর করে। আর কিছু ছত্রাকের সুতোর মতো মাইসেলিয়াম বনের ভেতর মাটির নিচে এক বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। সেটা দেখতে অনেকটা তারের মতো, চিকন-মোটা আঁকা বাঁকা সূত্রের এক মহাজাল বিছিয়ে রয়েছে বনের মাটির নিচে। ওগুলোই গাছের ইন্টারনেটের মতো এক গাছের সঙ্গে অন্য গাছের যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। এগুলো এত সবল যে একটা বা দুটো ছত্রাক সূত্রই শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে করতে পুরো বনের মাটির নিচে একসময় ছড়িয়ে পড়ে। আমরা এর অস্তিত্ব টের পাই যখন বনের মাটির ওপর কিছু ব্যাঙের ছাতার মতো মাশরুম দেখি। ওগুলো ওদের ফ্রুট বডি—স্পোর বা বীজাণু তৈরির অঙ্গ। মাটির নিচের থাকা ছত্রাক সূত্রগুলো খুব সূক্ষ্ম ও সরু। এসব ছত্রাক সূত্রগুলো একে অপরের সঙ্গে ও গাছগুলোর শিকড়ের সঙ্গে জড়াজড়ি করে থাকে। এরা এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গাছগুলোর মধ্যে নাইট্রোজেন, কার্বন ও অন্যান্য খনিজ দ্রব্য বা পুষ্টি স্থানান্তর করে। আর এগুলোর মাধ্যমেই গাছগুলো একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হয় ও সংকেত আদান-প্রদান করে।

একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। বনের মধ্যে নানা পরিবেশ ও স্থান থাকে। ধরা যাক, নিচু স্যাঁতসেঁতে ছায়াময় স্থানে একটা গাছের চারা জন্মাল। সেখানে তার টিকে থাকার উপযুক্ত পরিবেশ নেই, খাদ্য নেই, আলো নেই। অথচ চারাটি কিছুতেই মরতে চাইছে না। একটু নিজেকে বড় করতে পারলেই সে আকাশ দেখতে পাবে, আলো পাবে আর সূর্যের আলোতে তার পাতারা সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য বানাতে পারবে। কিন্তু এ চারা ওই আলো না পেয়ে সালোকসংশ্লেষণ করতে পারছে না। তৈরি করতে পারছে না খাদ্য। তাই সে তখন কাছে থাকা বড় গাছদের কাছে এসব ছত্রাক সূত্রের মাধ্যমে সাহায্য পাওয়ার সংকেত পাঠায়। বলে আমাকে খেতে দাও, বাঁচতে দাও। তখন বড় গাছগুলো তার দেহে তৈরি করা খাবারের কিছু অংশ ওসব ছত্রাক সুত্রের মাধ্যমে চারা গাছের শিকড়ে পৌঁছে দেয়। চারা সে খাদ্য পেয়ে পরিপুষ্ট হয়, বড় হয়। তা বলে ভাববেন না, ছত্রাক সূত্রগুলো কোনো লাভ ছাড়া গাছগুলোর মধ্যে এভাবে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছে। বিনা স্বার্থে পুষ্টি উপাদান তথা খাদ্য বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কোনো গাছ যখন ছত্রাক সূত্রের মাধ্যমে পুষ্টি স্থানান্তর করে, তখন তার খানিকটা অংশ কমিশন হিসেবে সে নিজে শুষে নেয়। এতে উভয় পক্ষই উপকৃত হয়। এজন্য ছত্রাক সূত্রের সঙ্গে গাছেদের এরূপ সহাবস্থান ও সহযোগিতাকে বলা হয মিথোজীবিতা, ইংরেজিতে সিমবায়োসিস।

পরিবেশবিদ সুজানে সিমার্ডের ধারণা, গাছ সালোকসংশ্লেষণের জন্য বায়ুমণ্ডল থেকে যে পরিমাণ কার্বন শোষণ করে, খাদ্য প্রস্তুতের পর সেই কার্বনের প্রায় ৩০ বাগ সার্ভিস চার্জ বা কমিশন হিসেবে দিতে হয় ছত্রাকসূত্রগুলোকে। মাইকোরাইজা বা ছত্রাক সূত্র বনের গাছগুলোকে ডাক পিয়নের মতো কার্বন বিলি করে। বিনিময়ে সার্ভিস চার্জ হিসেবে এটা গ্রহণ করে নিজেরা পরিপুষ্ট হয় ও বেঁচে থাকে। এতে গাছগুলোর কোনো অসুবিধে হয় না। ঘাটতি পড়লেই বায়ুমণ্ডলে থাকা কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে তা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু এই নেটওয়ার্কের ফলে উপকৃত হয় রুগ্ন ও দুর্বল, অপুষ্টিতে ভুগতে থাকা বনের গাছগুলো। এই সিস্টেমে সাধারণত বুড়ো ও বয়স্ক গাছগুলো মায়ের মতো দায়িত্ব পালন করে। ওদের শিকড়ের অগ্রভাগ থেকে সংকেত পেয়ে সে গাছ অন্য গাছের কাছে খাবার পাঠিয়ে দেয়। এভাবে বনের সব গাছই ভালো ও স্বাস্থ্যবান থাকে। বনের ইকোসিস্টেমে সমগ্র জীবগোষ্ঠীর পারস্পারিকভাবে উপকৃত হওয়ার কী আশ্চর্য ব্যবস্থাই না প্রকৃতি নিজ হাতে নির্মাণ করে রেখেছে! এসব ভাবলে অবাক হতে হয়!

লেখক : কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক