বশেমুরকৃবির বিজ্ঞানীদের সাফল্য

২০১৯ সালে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ছাগলছানার জন্ম দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। বাংলাদেশের জন্য এ ঘটনা প্রথম হলেও গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে তেমন আলোচনা হয়নি। সেই ছানাগুলো থেকে পরে প্রাকৃতিক প্রজননের মাধ্যমে একদল ছাগল উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে।

ছোট্ট খামার। সেখানে মোট ছাগল ১৬টি। তবে এটি কোনো সাধারণ খামার নয়, একটু অন্য রকম। এবার সেই গল্প শোনা যাক। গাজীপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সংক্ষেপে বশেমুরকৃবি। এখানকার একটি অনুষদ ভেটেরিনারি মেডিসিন অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স (ভিএমএএস)। এই অনুষদের গাইনিকোলজি, অবস্টেট্রিকস অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ (জিওআর) বিভাগের রিপ্রোডাক্টিভ বায়োটেকনোলজি গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা প্রথমে কসাইখানা থেকে সংগ্রহ করা ছাগলের টেস্টিস বা শুক্রাণু সংগ্রহ করেন। তারপর তা থেকে তাজা ও হিমায়িত অবস্থায় কৃত্রিম প্রজননপদ্ধতি প্রয়োগ করে বাংলাদেশের জন্য প্রথম ছাগলছানা উৎপাদন করেছেন। তা-ও দুই বছর আগে। তবে এ খবর কোথাও প্রকাশিত হয়নি।

সেই ছানাগুলো বড় হয়ে প্রাকৃতিক প্রজননের মাধ্যমে এ পর্যন্ত মোট সাতটি ছানার জন্ম দিয়েছে। সব মিলিয়ে ১৬টি ছোট–বড় ছাগলে ভরে উঠেছে বশেমুরকৃবির ক্ষুদ্র ছাগল খামারটি।

গবেষণাগারের প্রধান গবেষক ড. আ ন ম আমিনুর রহমান

বশেমুরকৃবির এই সাফল্যের পেছনে আছে সরকারের উদ্যোগ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ‘প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ গবেষণা অনুদান প্রকল্প’ ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) আর্থিক সহায়তায় এ গবেষণা পরিচালিত হয়। গবেষক দলে ছিলেন জিওআর বিভাগের শিক্ষক ও মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা। তাঁরা বলছেন, ভবিষ্যতে এই কৌশলের মাধ্যমে সেখানকার গবেষণাগারে উন্নত জাতের গরুর বাছুরও উৎপাদন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ ছাড়া এ দেশের অনেক বন্য প্রাণী বিলুপ্তপ্রায় অবস্থায় আছে। এ রকম বিলুপ্তপ্রায় মৃত বন্য প্রাণী যদি পাওয়া যায়, সেগুলোর শুক্রথলি ও ডিম্বাশয় থেকে সিমেন ও ডিম্বাণু সংগ্রহ করে গবেষণাগারে সংরক্ষণ করা হবে, যাতে ভবিষ্যতে তা থেকে ছানা উৎপাদন করা যায়। এটি বন্য প্রাণী সংরক্ষণে মাইলফলক হবে বলেই তাঁদের বিশ্বাস। তবে এ ব্যাপারে বন বিভাগের আর্থিক ও আইনি সহযোগিতা প্রয়োজন হবে।

রিপ্রোডাক্টিভ বায়োটেকনোলজি গবেষণাগারের প্রধান গবেষক ড. আ ন ম আমিনুর রহমান। তিনি দেশের একজন পাখি ও বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ। তাঁর নেতৃত্বে ২০১২-১৪ সালে রিপ্রোডাক্টিভ বায়োটেকনোলজিসহ চার ইউনিটের একটি কেন্দ্রীয় গবেষণাগার তৈরি হয়েছিল। তখন তিনি ভিএমএএস অনুষদের ডিন ও জিওআর বিভাগের প্রধান ছিলেন। বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতায় ইউজিসির উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন প্রকল্পের অধীন করা হয়েছিল ওই গবেষণাগার।

ব্ল্যাক বেঙ্গল সিমেন সংগ্রহ করা হচ্ছে

প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন কসাইখানা ও অন্যান্য স্থানে, বিশেষ করে কোরবানির ঈদে যেসব উন্নত জাতের গরু ও ছাগল জবাই করা হয়, যেগুলোর শুক্রথলি ও ডিম্বাশয় বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেওয়া হয়। অথচ এই শুক্রথলি সহজেই সংগ্রহ করে, তা থেকে গবেষণাগারে সিমেন সংগ্রহ করা যায়। সংগৃহীত সিমেন প্রক্রিয়াজাত করে রিপ্রোডাক্টিভ বায়োটেকনোলজি গবেষণাগারের সিমেন ব্যাংকে লিকুইড নাইট্রোজেনে হিমাঙ্কের নিচে ১৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বছরের পর বছর সংরক্ষণ করা যায়। এতে একদিকে যেমন প্রজননের জন্য উন্নত জাতের গবাদিপশু পালনে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে হবে না, তেমনি কসাইখানার এই বর্জ্যেরও সদ্ব্যবহার করা হবে।

এ বিষয়ে ড. আ ন ম আমিনুর রহমান বিজ্ঞানচিন্তাকে বলছিলেন, বর্তমানে এ দেশের গরুর জাত উন্নয়নে কৃত্রিম প্রজননপদ্ধতি ব্যবহৃত হলেও ছাগলে তা খুব একটা করা হয় না। অথচ কৃত্রিম প্রজননপদ্ধতির ব্যবহারে উন্নত জাতের পুরুষ প্রাণীর একবারের ক্ষরিত সিমেন দিয়ে শতাধিক স্ত্রী প্রাণীকে প্রজনন করানো যায়। যদিও ক্ষরিত সিমেনের আয়তন ও ঘনত্বের ওপর তা নির্ভর করে। তেমনি প্রাকৃতিক প্রজননের মতো সিমেনের মাধ্যমে রোগজীবাণু ছড়ানোর হাত থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। কাজেই গবাদিপশু থেকে রোগবিহীন সুস্থ-সবল ছানা উৎপাদনের জন্য কৃত্রিম প্রজনন একটি ভালো পদ্ধতি।

এই গবেষণাগারের গবেষক ও জিওআর বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ড. জীবন চন্দ্র দাসের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বললেন, ‘আমরা ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের ওপর কৌশলটি প্রয়োগ করেছি। ভবিষ্যতে অধিক মাংস ও দুধ উৎপাদনকারী জাত, যেমন যমুনাপারি, বোয়ের, বিটল ইত্যাদির ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হবে। এরপর আমরা এই কৌশল গরুতেও ব্যবহার করব। আমাদের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য হবে উন্নত জাতের গরু ও ছাগলের শুক্রথলি থেকে সিমেন সংগ্রহ করে, তা ল্যাবের সিমেন ব্যাংকে জমা রাখা এবং ভবিষ্যতে এগুলো কৃষক ও খামার পর্যায়ে বিতরণ করা। তবে এ জন্য কিছু আর্থিক অনুদানের প্রয়োজন রয়েছে। যেমন আমাদের গবেষণাগারে সিমেন প্রসেসর ও অল্প কিছু যন্ত্রপাতির প্রয়োজন রয়েছে, যেগুলো সংগ্রহ করতে পারলে গবেষণাগারের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে ও আমরা মাঠপর্যায়ে কৃষকদের সহজেই সহযোগিতা করতে পারব।’

বর্তমানে রিপ্রোডাক্টিভ বায়োটেকনোলজি গবেষণাগারে বশেমুরকৃবির রিসার্চ ম্যানেজমেন্ট উইংয়ের অনুদানে গরুর টেস্টটিউব বাছুর জন্মানোর গবেষণা চলমান। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত দুজন ছাত্র মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন ও আরও দুজনের লেখাপড়া চলমান।

কৃত্রিম প্রজনন বিজ্ঞানের আশীর্বাদ। এর সুবিধা ইতিমধ্যে বাংলাদেশ পেতে শুরু করেছে। কাজেই এটি দেশের বর্ধিত জনসংখ্যার আমিষের চাহিদা পূরণে অত্যন্ত সহায়ক। দেশের ক্রমবর্ধমান মাংস ও দুধের চাহিদা পূরণে কৃত্রিম প্রজননপদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশে স্বাধীনতার আগে, অর্থাৎ ১৯৫৯ সাল থেকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অধীন সাভারের কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের মাধ্যমে গাভিতে কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম শুরু হয়। একসময় কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম শুধু সরকারি পর্যায়েই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৭৫ সাল থেকে এর বাণিজ্যিকীকরণ শুরু হয়।

বর্তমানে মিল্ক ভিটা, ব্র্যাক, আমেরিকান ডেইরি লিমিটেড, এসিআইসহ বেশ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দেশব্যাপী সফলভাবে এই কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অতিসম্প্রতি ব্র্যাক ও আমেরিকান ডেইরি লিমিটেড হিমায়িত সিমেনের মাধ্যমে ছাগলের কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রম চালু করেছে। কিন্তু দক্ষ কৃত্রিম প্রজননকর্মীর অভাব ও অপর্যাপ্ত হিমায়িত সিমেন সরবরাহের কারণে গ্রামাঞ্চলের খামারিদের কাছে এর জনপ্রিয়তা কম। তাই এতে সফলতাও আসছে না। তা ছাড়া জবাই করা উন্নত জাতের গরু-ছাগলের শুক্রথলি সংগ্রহের পর, তা থেকে সিমেন বের করে সিমেন ব্যাংকে সংরক্ষণ করে তা দিয়ে গরু-ছাগলের কৃত্রিম প্রজনন করানোর কৌশলটি মোটামুটি সহজ হলেও এখন পর্যন্ত এ দেশে চালু হয়নি। এটি চালু হলে গবাদিপশুর উন্নয়নে লাখ লাখ টাকা সাশ্রয় হবে। তা ছাড়া বিলুপ্তপ্রায় বন্য প্রাণী সংরক্ষণেও এটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

সামনে কোরবানির ঈদ। কোরবানির পরপরই উন্নত জাতের গরু ও ছাগলের অণ্ডকোষ সংগ্রহ করে যদি সিমেন সংরক্ষণ করা যেত, তবে কৃত্রিম প্রজনন গবেষণায় আরও অগ্রগতি সম্ভব হতো। আশা করা যায়, কর্তৃপক্ষ সামনে আরও বড় প্রকল্প গ্রহণে প্রয়াসী হবে। একই সঙ্গে এটা বলতে হবে যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সফল গবেষণার ফলাফল যেন ক্যাম্পাসের চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে, তা যেন অচিরেই সাধারণ মানুষ ভোগ করতে পারে, সে বিষয়েও কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করা যায়।

লেখক: সাংবাদিক

*লেখাটি ২০২১ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত