অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে জীবাশ্ম জ্বালানির সম্পর্ক কী
সাধারণ চোখে অ্যান্টিবায়োটিক আর ফসিল ফুয়েলের মধ্যে তুলনা চলে না। তবে এর মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। শক্তি ব্যবহার করে এমন সব যন্ত্র মোটামুটি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে চলে। আধুনিক বিশ্ব এর ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়েছি।
একইভাবে ১৯৫৪ সালে অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। আবিষ্কারের কয়েক বছর পরে এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। যাচ্ছেতাই ব্যবহারের ফলে তৈরি হয় ঝুঁকি। চিকিৎসকেরা তখনই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের বিষয়টি ধরতে পারেন।
বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, অ্যান্টিবায়োটিকের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে শরীরে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। ফলে আজকে যে চিকিৎসা কাজ করছে, কাল সেটা অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। একজন ব্রিটিশ চিকিৎসক তখনই এই সমস্যা দেখে উদ্বেগ জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমাদের কার্যকর গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে জীবাণু আর ছত্রাকগুলো দাপট দেখাবে।’
একথা বলার ৭০ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। সেই উদ্বেগ সত্যি হয়েছে। জাতিসংঘ অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে জরুরি স্বাস্থ্য হুমকিগুলোর মধ্যে একটি’ বলে মন্তব্য করেছে। গবেষকেরা অনুমান করছেন, অ্যান্টিবায়োটিকের প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে এরমধ্যেই প্রতি বছর ১০ লাখের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়বে।
ইদানীং নতুন কোনো অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হচ্ছে না। বর্তমানে অপরিহার্য ওষুধগুলোর বেশিরভাগই ৬০ বছরের বেশি আগে আবিষ্কৃত হয়েছে। এখানে একটি বিষয় মনে রাখা জরুরি। অ্যান্টিবায়োটিক অন্যান্য ওষুধের চেয়ে বেশ আলাদা। বেশিরভাগ ওষুধ মানুষের শরীরের জৈবিক প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন প্যারাসিটামল ব্যথার রাসায়নিক সংকেত কমিয়ে মাথাব্যথা দূর করে। অন্যদিকে অ্যান্টিবায়োটিক সরাসরি জীবাণুকে আক্রমণ করে।
জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে অ্যান্টিবায়োটিকের মতোই চিন্তাভাবনা চলছে। জীবাশ্ম জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তা থেকে শিগগিরই মানুষের মুক্তি নেই।
টিকে থাকতে হলে মানুষকে এখন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিকের বেশিরভাগ উপাদান আসে মূলত ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাক থেকে। এগুলো কোটি কোটি বছর ধরে প্রকৃতিতে টিকে থেকেছে। গবেষকেরা প্রকৃতি থেকে এগুলোকে বেছে নিয়েছেন শত বছরও হয়নি।
জীবাশ্ম জ্বালানি বা প্রাকৃতিক সম্পদের বিষয়টাও তেমনি। জীবাশ্ম জ্বালানি আধুনিক বিশ্ব গঠনে সাহায্য করেছে। এটিও অতিরিক্ত ব্যবহার করা হয়েছে। লাখো বছর ধরে এটিও মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল। দুইশ বছর ধরে এগুলোর অনেক ব্যবহার হচ্ছে। আধুনিক বিশ্বকে সচল রাখছে জীবাশ্ম জ্বালানি।
জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে অ্যান্টিবায়োটিকের মতোই চিন্তাভাবনা চলছে। জীবাশ্ম জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তা থেকে শিগগিরই মানুষের মুক্তি নেই। জলবায়ু পরিবর্তনে মানব জাতির টিকে থাকাই হুমকির মুখে পড়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি আর অ্যান্টিবায়োটিক, উভয়ই বেশি সময় ধরে মানুষ ব্যবহার করছে না। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়েছে এক শতাব্দীও হয়নি এখনো। ১৯২৮ সালে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং প্রথম একটি অদ্ভুত ছত্রাকের কার্যকারিতা খেয়াল করেন। কিন্তু ১৯৩০-এর দশকের শেষের দিকেও ছত্রাকের মধ্যে থাকা সক্রিয় উপাদান পেনিসিলিনকে আলাদা করা সম্ভব হয়নি। তখন এর দৈনিক ডোজ ছিল মাত্র ৬০ মিলিগ্রাম। এক চিমটি লবণের সমান আরকি।
কয়েক বছর ধরে এটি খুব দুষ্প্রাপ্য ছিল। এর দাম ছিল সোনার চেয়ে বেশি। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এর উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাড়ানো হয়। ফলে এর দাম পড়ে যায়। একটা তেলের বোতলের চেয়েও কম দামে পাওয়া যাচ্ছিল তখন। খুব সহজে পাওয়ায় সংক্রামক রোগ ঠেকাতে এটা বেশ কাজে লেগেছে। জীবাশ্ম জ্বালানির শক্তিও পুরো বিশ্বকে এভাবে বদলে দিয়েছে।
অ্যান্টিবায়োটিক আধুনিক চিকিৎসার ভিত্তি তৈরি করতে সাহায্য করেছে। সার্জারির কথাই ধরা যাক। অপারেশনের মাধ্যমে মানুষের শরীরে কাটাছেড়া করলে ত্বকের প্রতিরক্ষা স্তর ভেঙে যায়। তখন জীবাণু শরীরের ভেতরের টিস্যুতে খুব সহজে প্রবেশ করার সুযোগ পায়। অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের এই প্রক্রিয়া ছিল খুব ঝুঁকিপূর্ণ। খুব সাধারণ অস্ত্রপচারও মারাত্মক বিষক্রিয়ার কারণ হতো। শুধু অ্যান্টিবায়োটিকের কারণেই এখন হার্ট সার্জারি, অঙ্গ প্রতিস্থাপনসহ আরও অনেক চিকিৎসা সম্ভব হচ্ছে।
জলবায়ু সুরক্ষার জন্য এখন জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো বন্ধ করতে বলা হচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব না। বিশ্বব্যাপী ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের বেশিরভাগ মৃত্যু রেজিস্ট্যান্সের কারণে হয় না
অপরদিকে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাব শুধু মানুষের মধ্যে আটকে নেই। একসঙ্গে অনেক গবাদিপশু পালন করা সম্ভব হয়েছে অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে। খুব কম জায়গায় একসঙ্গে অনেক পশু রাখলে যে রোগ ছড়াতে পারত, তা অ্যান্টিবায়োটিকের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যাচ্ছে। ১৯৫০-এর দশক থেকে মাংসের ব্যবহার বৃদ্ধির পেছনে এটি একটি প্রধান কারণ।
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হওয়ার পরও অ্যান্টিবায়োটিকের দাম অন্যান্য ওষুধের তুলনায় কম। জীবাশ্ম জ্বালানিরও একই অবস্থা। এর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব আছে। তবু এটি সস্তা। খাবার তেলের তুলনায় এর দাম কম। এর একটি কারণ হলো, এর ব্যবহারের ফলে যে নেতিবাচক পরিণতি ঘটে, সেটার জন্য কাউকে মূল্য দিতে হয় না। যে ১০ লাখ লোক অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের জন্য মারা যায়, তার জন্য কাউকে দায়ী করা হয় না। যে মানুষগুলো বায়ুদূষণের ফলে মারা যায়, তার জন্যও দায় থাকে না কারো। আবার কয়লা, তেল এবং গ্যাসের মতো অ্যান্টিবায়োটিকও পরিবেশ দূষণ ঘটায়। কিন্তু কোনো দায় নেই।
সম্প্রতি পিএনএএস নেক্সাস জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ৪০টি অ্যান্টিবায়োটিকের ৩১ শতাংশ নদীর পানিতে মেশে। একবার নদীর পানিতে মিশলে রেজিস্টেন্সের মাত্রা বেড়ে যায়। এখন জলবায়ু সংকটকে মোকাবেলা করার মতো করে উন্নত দেশগুলো অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার কমাতেও পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু এই দেশগুলো নিজেরাই অতীতে জীবাশ্ম জ্বালানির প্রচুর ব্যবহার করেছে। তাই ভারত, বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়ের মানুষের দেশে এর ব্যবহার সীমিত করতে বলা উন্নত দেশগুলোর জন্য কঠিন।
জলবায়ু সুরক্ষার জন্য এখন জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো বন্ধ করতে বলা হচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিকের ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব না। বিশ্বব্যাপী ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের বেশিরভাগ মৃত্যু রেজিস্ট্যান্সের কারণে হয় না, বরং অ্যান্টিবায়োটিকের অভাবের কারণে ঘটে। তাই এর ব্যবহারের পদ্ধতি আরও টেকসই করলেই সমাধান মিলবে।
বর্তমানে অনেক ওষুধ কোম্পানি নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের চেষ্টা করা বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ অ্যান্টিবায়োটিক এমন একটি পণ্য, যার ব্যবহার যত বাড়বে, রেজিস্ট্যান্সও বাড়বে। তাই এই পণ্যটি লাভজনক থাকবে না।
আমরা এখন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সচেতন হচ্ছি। এখন আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে চাই। একইভাবে আমাদের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়েও সচেতন থাকতে হবে।