ব্যথার বিজ্ঞান

আমাদের শরীরে অ্যালার্মের মতো কাজ করে দেহঘড়ি। যেকোনো বিপদ-দুর্ঘটনা ঘটার প্রাক্কালে আমাদের সতর্ক করে দেয়। লক্ষাধিক সংবেদনশীল স্নায়ু আমাদের কোষগুলোকে এভাবেই সারাক্ষণ পাহারা দিতে ব্যস্ত। ব্যথার সেন্সর বা নোসিসেপ্টরগুলো তাপমাত্রা, চাপ ও রাসায়নিক সিগন্যাল নির্ণয় করতে পারে। যখনই শরীরে কোনো কিছুর তারতম্য হয়, এসব সংকেত সেন্সরের মাধ্যমে সারা শরীরে খবর পৌঁছে দেয়, সতর্ক করে দেয় আমাদের! উদাহরণস্বরূপ বলি, ধরা যাক শরীরের বাহ্যিক তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি হয়ে গেল কিংবা কমে গেল ১৫ ডিগ্রিরও নিচে, তৎক্ষণাৎ তাপীয় সেন্সর গরম হতে থাকে।

শরীরের যেকোনো অস্বাভাবিকতায় নোসিসেপ্টরের দ্রুত কার্যকর হওয়ার ব্যাপারটি একটু জটিল! ধরে নিলাম, এক হাত আগুনের শিখার সংস্পর্শে আছে, তখন নোসিসেপ্টর সবার আগে এ খবরটি পৌঁছে দেবে মেরুদণ্ডে। মস্তিষ্কে খবর পাঠানোর আগেই মেরুদণ্ডে এর প্রাথমিক তথ্যাদি নিয়ে কিছুক্ষণ গবেষণা চলবে। যখন আগুনের সংস্পর্শ থেকে হাত সরিয়ে নিচ্ছি, তখন নোসিসেপ্টর এসব তথ্য সরাসরি মস্তিষ্কের সেরেব্রাল কর্টেক্সে পাঠিয়ে দেয়। মস্তিষ্কের এ অংশটি অনুভূতি ও স্মৃতি তৈরি করার পাশাপাশি ব্যথার জটিলতম অনুভূতি তৈরি করে থাকে। আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরবর্তী যেকোনো দুর্ঘটনার ব্যাপারেও সচেতন করে দেয়!

বিভিন্ন ধরনের ব্যথা

ব্যথা বিভিন্ন রকমের হতেই পারে! এই যেমন স্বল্পমেয়াদি (অ্যাকিউট) কিংবা দীর্ঘমেয়াদি (ক্রোনিক)। আবার কোনো কোনো ব্যথা খুব ভোগায়, বিষণ্ন, অসাড় করে দেয়, কোনো কোনো ব্যথা জ্বালায়-পোড়ায়! ব্যথা হতে পারে ধ্রুব—একই রকম অনেক দিন ধরে, আবার কোনো কোনো ব্যথা এই আসে, এই যায়! পৃথিবীতে যত ধরনেরই ব্যথা থাক না কেন, এসব ব্যথাকে দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। নোসিসেপটিভ ও

নিউরোপ্যাথিক।

নোসিসেপটিভ ব্যথা—একদম সাধারণ যেসব ব্যথা আমরা অনুভব করি, অর্থাৎ আমাদের টিস্যু বা কলার ক্ষয়ক্ষতির ফলে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া কিংবা অতিরিক্ত চাপ অনুভূত হওয়াসংক্রান্ত সংকেত আমাদের সংবেদনশীল স্নায়ু বহন করে মস্তিষ্কে নিয়ে যায়, সে ব্যথাগুলোই এই বিভাগের অন্তর্গত। মস্তিষ্কে সংকেত পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সচেতন করে দেওয়া হয় এবং ক্ষতস্থানের আরাম-যত্ন ইত্যাদির ব্যাপারে অনুভূতি তৈরি করা হয়, আমরা সচেতন হই যেন ভবিষ্যতে এ রকম ব্যথার সম্মুখীন না হতে হয়।

নিউরোপ্যাথিক ব্যথা—এই ব্যথাগুলো একটু জটিল। টিস্যু বা কলার ক্ষয়ক্ষতি নয়; বরং সরাসরি স্নায়বিক ক্ষয়ক্ষতির ফলেই এই ব্যথার উদ্ভব হয় এবং এ ধরনের সংকেত মস্তিষ্ক ঠিক সময়মতো পায় না। হয়তো যখন ব্যথা অনুভূত হওয়ার কথা নয়, তখন মস্তিষ্কে ভুল বার্তা পৌঁছে যায়, আবার যখন ব্যথা হওয়া উচিত, তখন মস্তিষ্ক নির্বিকার থাকে। এই ব্যথার ফলে অসুস্থতা, বিমর্ষতা, খুব ভোগায়। সাধারণত এই ব্যথা নিরসনের চিকিৎসা অপেক্ষাকৃত দুর্বোধ্য হয়ে থাকে।

ক্রোনিক পেইন বা দীর্ঘমেয়াদি ব্যথা কমানোর জন্য অনেক রকম উপায় অবলম্বন করা হয়; কিন্তু তাতে তেমন কোনো উপকার হয় না। কিছু কিছু পেইনকিলার রয়েছে, যেগুলো শুরুর দিকে খুব ভালো কাজ করলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এদের কার্যকারিতা কমতে শুরু করে। তাই অন্য কোনো উপায় েখাঁজা হচ্ছিল। অবশেষে পাওয়া গেল এক রাসায়নিক সমাধান। এই রাসায়নিক উপাদানটি মস্তিষ্ক থেকেই তৈরি হয়, নাম—নার্ভ গ্রোথ ফ্যাক্টর (এনজিএফ)। এর সবচেয়ে কার্যকর দিক হচ্ছে, ব্যথা কমানোর উদ্দেশ্যে এটি নার্ভ বা স্নায়ুর ব্যথার প্রতি সাড়া দেওয়ার মাত্রাকে সুবিধাজনক উপায়ে পরিবর্তন করতে সক্ষম! এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে পশুর ওপর পরীক্ষা করে। কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয়, ২০১০ সালে মানুষের ক্ষেত্রে এটি আরোপ করা হয়, কিন্তু ভীষণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে দেখা যায় এবং সেটি ভয়াবহ মাত্রার। তবে এখন পর্যন্ত এটি নিয়ে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে, যেন নিরাপদ উপায়ে এই মস্তিষ্ক-উৎপন্ন রাসায়নিক উপাদানটিকে মানুষের শরীরের ব্যথা কমানোর জন্য কাজে লাগানো যায়!

পেইনকিলার কীভাবে কাজ করে?

পেইনকিলার, নামের মধ্যেই অর্থ লুকিয়ে আছে। ব্যথানাশক এসব ওষুধের মূল কাজ, ব্যথা যাতে অনুভূত না হয়, সে পথটিকেই বন্ধ করে দেওয়া! অনেকটা মাথাব্যথা করছে, তো মাথা কেটে ফেলে দিই, এ রকম! তবে শরীরে যা ক্ষতি হওয়ার তার প্রক্রিয়া কিন্তু থেমে নেই, শুধু বাহ্যিক ব্যথা অনুভূত হওয়ার প্রক্রিয়াটিকে পেইনকিলার সাময়িকভাবে স্থগিত রাখে। কীভাবে? নিউরনের মেরুদণ্ড হয়ে মস্তিষ্কে টিস্যু ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার খবরটি পৌঁছে দেওয়ার একটা পথ তো আছে, সেই পথেই বিভিন্ন জায়গায় ট্রাফিক পুলিশের মতো দাঁড়িয়ে পথ আটকে দেয় পেইনকিলার। এই রেড সিগন্যাল আর কখনোই িগ্রন সিগন্যালে পরিণত হয় না, কাজেই টিস্যু বা স্নায়ু ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ খবরটি আমাদের মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছায় না। মস্তিষ্কে যদি না-ই পৌঁছায়, তো ফিরে আসা সংকেত আমরা কোথা থেকে পাব? ব্যথার অনুভূতি আর কীভাবে পাব? সাময়িকভাবে আমাদের ব্যথা অনুভব হওয়া থেকে বাঁচিয়ে দেয় পেইনকিলার। কিন্তু বুঝতেই পারছেন, পদ্ধতিটি শরীরের পক্ষে খুব বেশি সুখকর কিছু নয় মোটেও!

কিন্তু যাঁরা স্বাভাবিকভাবেই কোনো ব্যথা অনুভব করেন না?

এ ঘটনাও কিন্তু পৃথিবীতে ঘটে! আমরা তাদের সাহসী কর্মকাণ্ড দেখে অভিভূত হয়ে যাই! ভাবি, ইশ্‌, তাঁরা কি অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন! পারতপক্ষে, মূল রহস্য তো সেই মস্তিষ্কেই! (এসসিএন৯এ) নামক জিনে গন্ডগোল হওয়ার কারণে এ রকমটি হয়ে থাকে। ব্যথায় সাড়া দেওয়া স্নায়বিক কোষ মস্তিষ্কে সংকেত পাঠাতে অক্ষম হয়ে যায় তখন স্বাভাবিকভাবেই। অধিক তাপমাত্রায় পুড়ে যাওয়ার ব্যথা, অতিরিক্ত ঠান্ডায় শরীরে কাঁপন দেওয়ার মতো ব্যথা কিংবা হাতুড়ি দিয়ে হাত থেঁতলে ফেললেও তারা কোনো ব্যথা অনুভব করবে না। অথচ যা ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার, তা কিন্তু ঠিকই হবে তার শরীরে। এ ক্ষেত্রে তাদের সুপারপাওয়ার নিয়ে আসা বিশেষ মানুষ বলে আখ্যায়িত করা হয়ে যায়, আর তারাও নিজেদের নিয়ে নানা ধরনের ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে বিখ্যাত হওয়ার নেশায়!

গেট নিয়ন্ত্রণতত্ত্ব

আমরা কখনো কখনো এমন করি না বুঝেই। দেখা গেল, যখন ব্যথা পেলাম, সঙ্গে সঙ্গে ওপরের কোনো অংশে চাপ দিয়ে ধরলাম, ব্যথা খানিকটা কমে গেল! এটা আসলে কেন হয়? ব্যথার সংকেত ব্যথা পাওয়ার স্থান থেকে মস্তিষ্কে যাওয়ার সময় সরু স্নায়ুতন্তুর মধ্য দিয়ে যায়। মেরুদণ্ডে প্রবেশের পর আরও অনেক স্নায়ুতন্তুর সঙ্গে জটলা পাকিয়ে মস্তিষ্কের উদ্দেশে রওনা হয়। তখন অন্য কিছু মোটা স্নায়ুতন্তুও মস্তিষ্কে খবর নিয়ে যায়, তবে সেগুলোতে ব্যথার কোনো খবর নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কিছু বিশেষ প্রকৃতির নিউরন আছে, যাদের বলা হয় গেটকিপার! এই নিউরনগুলো দারোয়ানের মতো পাহারা দেয়। কোন সংকেতকে মস্তিষ্কে পাঠানো হবে আর কোনটাকে পাঠানো যাবে না, সর্বক্ষণ সেটা নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা। দেখা গেল সরু স্নায়ুতন্তু ব্যথার খবর নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পেয়ে গেল, কিন্তু অপেক্ষাকৃত মোটা স্নায়ুতন্তুরা যেতে পারছে না, যেহেতু তাদের দেওয়ার মতো কোনো খবর নেই! এখন আমরা যেটা করতে পারি, কোথাও আঘাত পেলে সঙ্গে সঙ্গেই এর আশপাশে হালকা চাপ প্রয়োগ করতে পারি। এতে করে কখনো কখনো ব্যথার খবর নিয়ে ছুটে চলা সরু স্নায়ুতন্তুগুলো গেটকিপারের কাছে আটকা পড়ে যায়, অন্যদিকে খবরহীন স্নায়ুতন্তুগুলো মস্তিষ্কে যাওয়ার অনুমতি পেয়ে যায়। তখন মস্তিষ্ক থেকে ফিরে আসা নির্দেশনায় আমরা আর ব্যথাটুকু অনুভব করার অবকাশ পাই না!

আমরা কি ব্যথার পরিমাণ করতে পারি?

এটা কি আদৌ সম্ভব? তবে এটাকে সম্ভব করার চেষ্টা করেছেন বিজ্ঞানীরা। ব্যথার তীব্রতাকে এই প্রক্রিয়ায় কিছু নম্বরে পরিণত করা হয়, তারপর পরীক্ষার মাধ্যমে ধারণা করা হয়, রোগী ঠিক কতখানি ব্যথা অনুভব করছেন! এই পদ্ধতি যে ডিভাইস বা যন্ত্রের মাধ্যমে করা হয়, তার নাম ডলোরিমিটার। এটি রোগীর ত্বকে স্থাপন করার পর, যতক্ষণ না রোগী ব্যথা বা উচ্চতাপে ‘উহ’ বলে অভিব্যক্তি প্রকাশ না করছে, ততক্ষণ পরিমাপ করা হয়। ডলোরিমিটারে নির্দেশিত সে নম্বর দেখে বুঝে ফেলা যায় রোগী ঠিক কতখানি ব্যথা অনুভব করছেন। এই পদ্ধতির পর এক নতুন গবেষণা করা হয়, সেটিও ডলোরিমিটার দিয়েই, আগের মতোই ত্বকে তাপীয় স্পর্শ প্রদান করে। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে, এখানে রোগীর ব্যথায় কাতর হয়ে কোনো অসহ্য শব্দ উচ্চারণের জন্য অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই; বরং রোগী তার মস্তিষ্ককে চাক্ষুষ দেখতে পায়। মস্তিষ্ক কখন ব্যথায় কাতর হচ্ছে, কখন শারীরিক ব্যথা প্রবল হচ্ছে এবং সে অনুযায়ী কখন কত ডোজের পেইনকিলার সেবন করা প্রয়োজন—সবকিছু পরিমাপ করার একটা ধারণাকৃত ফলাফল রিপোর্ট রোগী সহজেই বুঝে নিতে পারবে। শুধু আবেগের ওপর নির্ভর করেই নয়; বরং প্রকৃতপক্ষে কতখানি ব্যথার অনুভূতি মস্তিষ্ক থেকে সংকেতের মাধ্যমে শরীরে ফেরত পাঠানো হয়, সেটুকু সম্বন্ধে নির্ভুল তথ্য পাওয়া সম্ভব!