বেসাল টিয়ারে প্রচুর পরিমাণে লবণের আয়ন থাকেছবি: সংগৃহীত

ছোটবেলায় খেলনা ভেঙে গেলেই আমরা কাঁদতাম। এখন আর সে বয়স নেই। তবু আমরা কাঁদিপ্রিয়জনকে হারালে আমাদের কষ্ট হয়। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। অনেকের আবার বই পড়ে বা সিনেমার কোনো দৃশ্য দেখেও এমনটা হতে পারে। আর পেঁয়াজ কাটলে যে চোখ দিয়ে পানি বের হয়, তা কমবেশি সবারই জানা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আবেগ-অনুভূতির কারণে আমাদের চোখ দিয়ে যে পানি বা অশ্রু বের হয়, তা আসলে কী দিয়ে তৈরি? কষ্টের কান্না আর পেঁয়াজ কাটার সময়ের কান্না কি একই?

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব প্লিমথের চক্ষু গবেষণা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড্যানিয়েলা ওহরিং। তাঁর মতে, অশ্রু মূলত তিন ধরনের। এর মধ্যে দুটির সঙ্গে আমরা বেশি পরিচিত। এক, ইমোশনাল টিয়ার বা আবেগ সৃষ্ট অশ্রু। সাধারণত প্রিয়জনকে হারালে কষ্টে বা অনেকদিন পর শৈশবের কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে আনন্দে আমরা কেঁদে ফেলি। এটাই আবেগ সৃষ্ট অশ্রু। এক কথায় বলা যায়, আবেগাশ্রু।

বাকি দুই ধরনের অশ্রু হলো বেসাল টিয়ার ও রিফ্লেক্স টিয়ার বা প্রতিক্রিয়ামূলক অশ্রু। বেসাল টিয়ার মূলত চোখকে রক্ষা করে। এটি চোখের টিস্যুকে পুষ্টি সরবরাহ করে ও ময়লা পড়লে সেটাকে ভাসিয়ে বের করে নেয়। আবার চোখের জন্য অস্বস্তিকর কোনো ঘটনা ঘটলেওযেমন ধোঁয়া চোখে গেলে বা পেঁয়াজ কাটলে আমাদের চোখ দিয়ে পানি বের হয়। এ জন্য আসলে সালফারের একধরনের যৌগ দায়ী। পেঁয়াজ কাটলে এ ধরনের যৌগ বেরিয়ে আসে। এ যৌগ পানির সঙ্গে মিশে অতিসামান্য সালফিউরিক অ্যাসিড তৈরি করে। তাই সালফারের এ যৌগ আমাদের চোখে গেলে চোখ জ্বালা করে, অস্বস্তিবোধ হয়। তখন অশ্রু ঝরে পড়ে। এটাই রিফ্লেক্স টিয়ার। মানে, চোখে অস্বস্তির প্রতিক্রিয়া হিসেবে এ অশ্রু বেরিয়ে আসে।

ওহরিংয়ের মতে, বেসাল টিয়ারে প্রচুর পরিমাণে লবণের আয়ন ও অন্যান্য ইলেক্ট্রোলাইটসহ অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্যযুক্ত প্রোটিন থাকে। এ প্রোটিনের মধ্যে থাকে লাইপোক্যালিন ও লাইসোজাইম। লাইপোক্যালিন জীবাণুর মধ্যে থাকা নির্দিষ্ট কিছু যৌগকে আটকে ফেলে। আর লাইসোজাইম কোষের দেয়াল ভেঙে মেরে ফেলে ব্যাকটেরিয়াকে।

প্রতিক্রিয়ামূলক অশ্রু ও আবেগাশ্রুতে বেসাল টিয়ারের তুলনায় পানির পরিমাণ বেশি থাকে। তবে ফ্যাট ও প্রোটিনের ঘনত্ব থাকে কম। অনেক বিজ্ঞানীর মতে, শরীর চাপের মধ্যে থাকলে প্রতিক্রিয়ামূলক কান্নার তুলনায় বেসাল টিয়ারে হরমোনের ঘনত্ব বেশি হয়।

চোখে অশ্রু তৈরি হওয়ার পর তা চোখের সামনের একটি পাতলা আবরণীতে জমা হয়। এ আবরণ কর্নিয়া নামে চোখের সামনের স্বচ্ছ টিস্যুকে ঢেকে রাখে ও সুরক্ষা দেয়। এই পাতলা অশ্রু আবরণের তিনটি স্বতন্ত্র স্তর রয়েছে। বাইরের দিকের চোখের পাতায় থাকে মেইবোমিয়ান গ্রন্থিতে উত্পাদিত একটি তৈলাক্ত স্তর। এটি চোখকে শুকাতে বাধা দেয়। পরবর্তী স্তরটি চোখকে ভিজিয়ে রাখতে সাহায্য করে। এটি মূলত ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি দিয়ে তৈরি। এ ছাড়া কর্নিয়ার সবচেয়ে কাছের স্তরটিতে একটি স্লাইমের মতো প্রোটিন রয়েছে। নাম মিউসিন। এ প্রোটিন চোখে অশ্রুর আবরণটিকে আটকে রাখতে সাহায্য কর।

ড্যানিয়েলা ওহরিংয়ের মতে, মানবদেহে প্রতি মিনিটে প্রায় ১ থেকে ৪ মাইক্রোলিটার অশ্রু তৈরি হয়। গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১ দশমিক ৪৪ থেকে ৫ দশমিক ৭৬ মিলিলিটারের সমতুল্য। অশ্রু কতটুকু উৎপাদিত হবে, তা নির্ভর করে আমাদের কাজের ওপর। যেমন মোটর সাইকেল চালানোর সময় আমাদের চোখে বাতাসের ঝাপটা বেশি লাগে। ফলে বাতাসের বাষ্পীভবনের হার বেশি থাকে। এতে অশ্রু কম উৎপাদন হয়। কারণ এ সময় চোখের পানি তৈরির প্রয়োজন পড়ে না। চোখের পানিই অশ্রুনালি দিয়ে বেরিয়ে আসে।

অনেক সময় আমাদের চোখ শুকিয়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ১৬০ লাখ মানুষ এ সমস্যায় ভুগছে। তা ছাড়া আরও অনেক কারণে চোখ শুকিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ধূমপান করা, পুষ্টি কমে যাওয়া, দীর্ঘ সময় কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা এবং পর্যাপ্ত চোখের পলক না ফেলা এর অন্যতম কারণ। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। কারণ আমাদের অশ্রুগ্রন্থিগুলো কাজ করা বন্ধ করে দেয়।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, সিটি কলেজ, ঢাকা

সূত্র: লাইভ সায়েন্স