ফোবিয়া

বাড়ির দেয়ালের কোণে বা সিঁড়ির ছাদে মাকড়সা দেখলেই হলো। আমার ভাতিজি প্রিয়া এমন বিকট এক চিত্কার দিয়ে গোটা বাড়ি কাঁপিয়ে দেবে! শুধু তা–ই নয়, তার মুখ যাবে ফ্যাকাশে হয়ে, নাড়িস্পন্দনও যাবে বেড়ে, এমনকি অনেকক্ষণ অবধি সে ভালো করে কথাই বলতে পারবে না। প্রিয়ার কাজিনরা দুষ্টুমি করে মাঝেমধ্যে তাকে মাকড়সার ছবি পাঠায়। ছবি দেখেও প্রায় একই দশা হয় ওর। এ রকমটা আমরা অনেকেরই হতে শুনি। কোনো কিছুর প্রতি এই মাত্রাতিরিক্ত ভয় বা আতঙ্কের নাম হলো ফোবিয়া। ফোবিয়া শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ফোবোস থেকে। ফোবোস অর্থ ভয়। গ্রিক মিথোলজিতে ফোবোস (ভয়) আর ডেমোস (সন্ত্রাস) দুই ভাই।

গবেষণা বলছে, বিশ্বজুড়ে ৮ থেকে ১৮ শতাংশের মতো মানুষ কোনো না কোনো ফোবিয়ায় আক্রান্ত। নারীদের মধ্যে একে সবচেয়ে কমন মানসিক সমস্যা হিসেবে ধরা হয়। ১ থেকে ৩ শতাংশ শিশু সোশ্যাল ফোবিয়ায় আক্রান্ত। ফোবিয়া আছে নানা রকমের। স্পেসিফিক ফোবিয়া হলো নির্দিষ্ট কোনো বস্তুর (যেমন মাকড়সা, তেলাপোকা, সাপ) প্রতি ভীতি। এই ভীতি সাধারণ ভীতি নয়। সেই জিনিসটির ছবি বা ভাবনা পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তির মনে ভয়ের উদ্রেক করে। অতিরিক্ত ভয়ে কেউ জ্ঞানও হারাতে পারে। অ্যাগারোফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষ নির্দিষ্ট গণ্ডি, যেমন পরিবার বা নিজের বাড়ির বাইরে অস্বস্তি বোধ করে, ভয় পায়। অপরিচিত পরিবেশে কখনো তাদের প্যানিক অ্যাটাক হয়। সোশ্যাল ফোবিয়া কিন্তু অনেকেরই আছে। বেশি মানুষ বা ভিড়ের মধ্যে, পার্টিতে বা নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসে। অনেকে বন্ধুবান্ধব বা বেশি লোকের সামনে তোতলাতে শুরু করে, ঘামতে থাকে, মুখে কথা সরে না। একা একা বা বাড়িতে নিজের লোকজনের সঙ্গে আবার এমনটা হয় না। ক্লস্ট্রোফোবিয়াও আমাদের চারপাশে অনেকের মধ্যেই দেখা যায়। এতে আক্রান্ত মানুষ বদ্ধ জায়গায় টিকতে পারে না। লিফটে উঠতে ভয় পায়।

ফোবিয়া কেন হয়, তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। বিজ্ঞানীরা একে মানসিক সমস্যা হিসেবেই দেখেন। আমাদের মস্তিষ্কের মিডিয়াল টেমপোরাল লোবের গভীরে বাদামের মতো একটা জায়গা আছে। এর নাম অ্যামিগডালা। ভীতি, উদ্বেগ ইত্যাদি অনুভূতির জন্ম হয় এখান থেকেই। এর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে হিপোক্যামপাস এবং আমাদের হাইপোথ্যালামিক-পিটুইটারি-অ্যাড্রিনাল এক্সিস। অ্যামিগডালা উদ্দীপ্ত হলে একধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়, যা ভীতির সঞ্চার করে মনে। সঙ্গে সঙ্গে সচল হয় হাইপোথ্যালামিক-পিটুইটারি-অ্যাড্রিনাল এক্সিস। হাইপোথ্যালাস থেকে আসে করটিকোট্রফিন, যা উদ্দীপ্ত করে পিটুইটারি গ্রন্থিকে। পিটুইটারি আবার এসিটিএইচ নিঃসরণ করে উদ্দীপ্ত করে অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিকে। অ্যাড্রিনাল থেকে প্রচুর পরিমাণে কর্টিসল আর অ্যাড্রিনালিন নিঃসৃত হয়। ফলে দম আটকে আসে, বুক ধড়ফড় করে, চোখ বড় বড় হয়ে যায়, ঘামতে শুরু করে মানুষ—একে বলে ফাইট অ্যান্ড ফ্লাইট রেসপন্স। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই এই রেসপন্স সক্রিয়, সত্যি বলতে কি, কোনো বিপদে এই রেসপন্সই আমাদের সতর্ক করে দেয় সব সময়। রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে; কিন্তু ফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের এই রেসপন্স শুধু অতিরিক্তই নয়, মাঝেমধ্যে অবান্তর ও অযৌক্তিকও।

আমাদের চারপাশে অনেকেরই যেমন এমন ফোবিয়া রয়েছে, তেমনি রয়েছে জগদ্বিখ্যাত ব্যক্তিদেরও। সাইকো আর ভারটিগোর মতো ফিল্ম দিয়ে দর্শকদের পিলে চমকে দিলেও পরিচালক আলফ্রেড হিচকক নিজে জীবনে কোনো দিন নাকি ডিম খাননি, ছুঁয়েও দেখেননি। ডিমের প্রতি তীব্র এক ভয় আর বিতৃষ্ণা আছে এই পরিচালকের, তাই ডিম দেখতেও ভালো লাগে না তাঁর! সারা জীবন আলোকিত মঞ্চে নেচে–গেয়ে ঝড় তুলেছেন যে ম্যাডোনা, সেই বিখ্যাত গায়িকা ঝড়–বৃষ্টি আর বজ্র–বিদ্যুৎকে যমের মতো ভয় পান। আশ্চর্যের বিষয়, পামেলা অ্যান্ডারসনের মতো তারকা নাকি ভয় পান আয়না দেখতে। নিজেকে আয়নায় বা টিভিতে দেখতে চান না তিনি, টিভিতে নিজের কোনো শো শুরু হওয়ামাত্র চ্যানেল পাল্টে ফেলেন। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট নাকি ভীষণ ভয় পেতেন বিড়াল, আর আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ভয় পেতেন হাসপাতালকে (এর একটা আলাদা নাম আছে—নসোকোমোফোবিয়া, আরও অনেকেরই আছে এই ভয়, হাসপাতালের গন্ধ, পরিবেশ, রং এদের অসুস্থ করে তোলে)। এমনকি মনোবিদ্যার জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েড এত কিছুর সাইকো অ্যানালাইসিস করেছেন, কিন্তু নিজে যে হপলোফোবিয়া বা অস্ত্রভীতিতে ভুগতেন। কেন, তার কোনো কিনারা করতে পারেননি!

জেনে রাখতে হবে যে ফোবিয়া একধরনের মানসিক রোগ। অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার বা অতি-উদ্বেগ প্রবণতা থেকে এর উত্পত্তি। তাই এর চিকিত্সাও আছে। মনোরোগবিদেরা এর চিকিত্সায় কিছু ওষুধের পাশাপাশি বিহেভিয়ার থেরাপি দেন। এর মধ্যে একটি হলো ডিসেনসিটাইজেশন। মানে ধীরে ধীরে ভয়ের বস্তুটির প্রতি ভয় কমিয়ে আনা বা একে সহ্যের মধ্যে নিয়ে আসা। জনপ্রিয় টিভি সিরিজ এ টিম-এর মিস্টার টি বিমানকে ভয়ংকর ভয় পেত, নিশ্চয় মনে আছে। বিমানে কোথাও যেতে হলে তার বন্ধুরা তাকে অজ্ঞান করে নিয়ে যেত। তো এই মিস্টার টিকে ডিসেনসিটাইজেশন করতে হলে প্রথমে তাকে নানা রকম প্লেনের ছবি দেখাতে হবে। তারপর তাকে কল্পনা করতে শেখানো হবে যে সে প্লেনে উঠেছে, তারপর তাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে গিয়ে প্লেন দেখিয়ে আনতে হবে মাঝেমধ্যে। তারপর সে থেমে থাকা প্লেনে এক দিন কি দুই দিন উঠে বসে নিজেকে ধাতস্থ করবে। সব শেষে তাঁকে দিয়ে বিমানভ্রমণ করানো সম্ভব হবে। এই হলো থেরাপি। এ ছাড়া হিপনোথেরাপি, কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি ইত্যাদিও করা হয়। তবে এসব চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে করা যাবে না। তাতে হিতে বিপরীতও হতে পারে।

লেখক: চিকিৎসক, গ্রিনলাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা