আমরা প্রতিদিন বাসা থেকে বের হই, অফিসে যাই, কাজ করি, ফেরার পথে কারও সঙ্গে দেখা করি, কেনাকাটা করি, তারপর দিন শেষে বাসায় ফিরে আসি। আমাদের প্রতিদিনের গতিবিধি খেয়াল করলে দেখা যাবে, আমরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে যাই কিছু কাজ সম্পাদন করার জন্য। আমরা যদি প্রত্যেকে একটা করে প্রোটিন হই আর আমাদের জীবন যদি হয় কোষের অভ্যন্তরে, তাহলেও কিন্তু জীবনধারা অনেকটা একই রকম। প্রোটিন এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম থেকে তৈরি হওয়ার পর তারা নিজের কাজ করার ক্ষেত্র খুঁজে নেয়, কেউ যায় মাইটোকন্ড্রিয়ায়। কেউ যায় প্লাজমা মেমব্রেনে, কেউ যায় ক্লোরোপ্লাস্টে। এর ফলে কোষের মধ্যে সর্বদা প্রোটিনগুলো কার্য সম্পাদনের জন্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ভ্রমণ করতে থাকে। তাদের এই চলাফেরাকে বলা হয় ‘প্রোটিন ট্র্যাফিকিং’।
ধরা যাক, আজ প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই বৈরী আবহাওয়ার কারণে আপনি অনেক জায়গায় যাতায়াত করতে পারবেন না। এর ফলে প্রতিদিনকার মতো সব কাজ সম্পাদন করা সম্ভব হবে না। ঠিক একই ধরনের ঘটনা ঘটে যখন উদ্ভিদ কোনো বৈরী পরিবেশের সম্মুখীন হয়। তখন তার কোষের কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এর কারণ হলো সব প্রোটিন তার নিজস্ব কার্য সম্পাদনের জন্য এক গন্তব্য থেকে অন্য গন্তব্যে যেতে পারে না। অর্থাৎ প্রোটিন ট্র্যাফিকিং ব্যাহত হয়। উদ্ভিদের সঙ্গে আমাদের বড় পার্থক্য হলো আমরা বৈরী পরিবেশ থেকে নিজেদের বাঁচাতে অন্যত্র ছুটে যেতে পারি, যা উদ্ভিদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই উদ্ভিদ নিজেকে ওই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে অথবা অভিযোজনের দিকে মনোনিবেশ করে।
জাপানের ইয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক বাংলাদেশি বিজ্ঞানী আবিদুর রাহমান। তিনি আর তাঁর দল কাজ করেন স্বাভাবিকের চেয়ে কম তাপমাত্রায় উদ্ভিদের বেড়ে ওঠা এবং তাঁর অন্তর্নিহিত সেলুলার মেকানিজম নিয়ে। তাঁরাই প্রথম দেখান, কম তাপমাত্রায় উদ্ভিদের মূলে জমা হয় প্ল্যান্ট হরমোন অক্সিন। আর এই জমা হওয়া অক্সিন উদ্ভিদের মূলের বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। তাঁরা আরও দেখান, কম তাপমাত্রায় প্ল্যান্ট হরমোন অক্সিনের ট্রান্সপোর্টার (PIN FORMED2/PIN2) সঠিকভাবে কাজ সম্পাদন করতে পারে না। অর্থাৎ অক্সিনের ট্রান্সপোর্টার প্রোটিনের ট্র্যাফিকিং ব্যাহত হয় কম তাপমাত্রায়। ট্রান্সপোর্টার সঠিকভাবে কাজ করতে না পারায় এক কোষ থেকে অন্য কোষে অক্সিনের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে স্বাভাবিকের চেয়ে জমা হওয়া অতিরিক্ত অক্সিন উদ্ভিদের বৃদ্ধিকে বাধা দেয়।
বৃষ্টি হলে শুধু যে আমার কাজে যাওয়া বাধার সম্মুখীন হয় তা নয়, আরও অনেকেরই হয়। সেভাবে চিন্তা করলে খুব সহজেই অনুমান করা যায়, কম তাপমাত্রায় ঠিক তেমনি শুধু পিন ফরমড২/পিন২ (PIN FORMED2/PIN2) প্রোটিনের ট্র্যাফিকিং ব্যাহত হয় না, আরও অনেক প্রোটিনেরও হয়। সেই ভাবনা থেকেই তাঁরা খুঁজতে শুরু করেন আর কোন প্রোটিন এই কাজে ভূমিকা রাখে তা বের করার। ২০১৮ তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন জিএনওএম (GNOM) প্রোটিনকে। এই প্রোটিনই নিয়ন্ত্রণ করে পিন ফরমড২/পিন২-এর ট্র্যাফিকিং। তাঁরা পরীক্ষণে দেখান, কোষের ভেতর জিএনওএম প্রোটিন অনেক বেশি তৈরি হলে তা পিন ফরমড২/পিন২-এর ট্র্যাফিকিংয়ে সাহায্য করে। এর ফলে কম তাপমাত্রায়ও অক্সিনের ট্রান্সপোর্টার পিন ফরমড২/পিন২-এর এক কোষ থেকে অন্য কোষে অক্সিন প্রবাহের কাজ চালিয়ে যেতে পারে এবং অক্সিন জমা হওয়ার সুযোগ পায় না। ফলে কম তাপমাত্রায়ও উদ্ভিদ নিজের বৃদ্ধি বজায় রাখতে পারে। উল্লেখ্য, যখন প্রোটিন কোষের ভেতর জিএনওএম অধিক পরিমাণে তৈরি হয়, অধিকাংশ প্রোটিন গিয়ে জমা হয় প্লাজমা মেমব্রেনে। সাইটোপ্লাজমের তুলনায় প্লাজমা মেমব্রেনে জমা হওয়া জিএনওএম প্রোটিন কীভাবে কম তাপমাত্রা মোকাবিলায় সাহায্য করে, তা খুব সহজ একটা উদাহারণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
ধরা যাক, আপনার কাছে কিছু সেনা আছে। আপনার দায়িত্ব হলো ওই সেনাদের ব্যবহার করে রাষ্ট্রকে রক্ষা করা। তাহলে আপনি কী করবেন? যখন খবর পাবেন, কেউ আপনার রাষ্ট্র আক্রমণ করতে আসছে, আপনি নিজেকে রক্ষা করার জন্য দুইভাবে সাজাতে পারেন সেনাদলকে। সেনাদের রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় দাঁড় করাতে পারেন অথবা বেশির ভাগ সেনাকে পাঠাতে পারেন সীমানার কাছে। যদি সীমানার কাছে পাঠানো হয়, তাহলে তারা শত্রু ঢোকার মুখেই বাধা দিতে পারবে। এটাই শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায়। কোষের জন্য প্লাজমা মেমব্রেন হলো তার সীমানার মতো। কম তাপমাত্রা থেকে বাঁচার জন্য সে তাই জিএনওএম প্রোটিনকে পাঠানোর চেষ্টা করে প্লাজমা মেমব্রেনে।
ড. আবিদুর রাহমান আরও দেখান, জিএনওএম প্রোটিনের মাত্র একটা অ্যামাইনো অ্যাসিডকে পরিবর্তন করে কোষের ভেতর আরও বেশি জিএনওএম প্রোটিন তৈরি এবং ট্র্যাফিকিং নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর এ ধরনের পরিবর্তন অথবা পয়েন্ট মিউটেশন প্রাকৃতিকভাবেই বিভিন্ন প্রজাতিতে বিরাজ করে। উদ্ভিদ ছাড়াও অন্য জীবকোষে জিএনওএমের মতো কিছু প্রোটিন পাওয়া যায়। ইস্টকোষেজি এনওএম-এর মতো একটি প্রোটিন তাপমাত্রার পরিবর্তন বোঝাতে সাহায্য করে। ধারণা করা হচ্ছে, তাপমাত্রা অনুধাবনে সক্ষম এই প্রোটিন অভিযোজনের মাধ্যমে উদ্ভিদ থেকে মানুষ পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণির প্রাণীতে জায়গা করে নিয়েছে। গবেষক দল নতুন আবিষ্কৃত এই মেকানিজমকে কাজে লাগিয়ে কম তাপমাত্রায় উৎপাদনযোগ্য টমেটো প্রজাতি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইওয়াতে বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান
সূত্র: প্ল্যান্ট সেল, দ্য প্ল্যান্ট জার্নাল