আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অর্গানিক খাবারে জিএমও বা জিই ব্যবহৃত হয় না। জিএমও মানে জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম আর জিই মানে জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড প্ল্যান্ট
আজকাল বিভিন্ন সুপারশপের কোনো একটা কোণে বড় করে লেখা থাকে—অর্গানিক ফুড। স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ সেই কোণে ভিড় করেন। অর্গানিক ফুডের প্রতি ভোক্তাদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। দাম বেশি হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই এখন অর্গানিক খাবার কিনতে আগ্রহী। কিন্তু কী আছে এই অর্গানিক ফুডে? আর কেনই–বা এটি স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী?
অর্গানিক খাবার হলো যে শস্য বা খাদ্য উৎপাদনে কোনো প্রকার কৃত্রিম সার, কীটনাশক, আগাছানাশক ব্যবহার করা হয় না। এগুলো উৎপাদনে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় না। অর্থাৎ যে খাদ্য একেবারেই প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদিত হয়েছে। শস্য বা শাকসবজি, ফলমূল ছাড়া প্রাণিজ খাদ্যও অর্গানিকের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। যেমন ডিম, দুধ বা মাংস। সে ক্ষেত্রে সেই গবাদি পশুপাখিকে প্রাকৃতিক উপায়ে পালন করতে হবে। মানে গ্রামে হাঁস, মুরগি বা গরু, ছাগল যেমন মাঠেঘাটে চরে সাধারণ প্রাকৃতিক খাবার খেয়ে বেড়ে ওঠে, তেমন। এগুলো লালন-পালনে কোনো কৃত্রিম খাবার, পোলট্রি ফুড, অ্যান্টিবায়োটিক বা হরমোন ব্যবহার করা যাবে না।
এখন কথা হলো, কেন আমরা বেশি দাম দিয়ে অর্গানিক খাবার কিনব? এতে কি পুষ্টি উপাদান বেশি থাকে? আর সাধারণ বা সনাতন পদ্ধতিতে উৎপাদিত খাবার কি খুব বেশি ক্ষতিকর? আর অর্গানিক চাষে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের খাদ্যচাহিদা কীভাবে মিটবে?
তার আগে আসুন জেনে নিই, অর্গানিক ফুড আর কনভেনশনাল বা সনাতন ফুডের মধ্যে পার্থক্য।
অর্গানিক শস্য উৎপাদনে প্রাকৃতিক সার, যেমন গোবর, কমপোস্ট ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়, অন্যদিকে সাধারণ শস্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় রাসায়নিক সার। অর্গানিকে আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা হয় প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে। যেমন হাত দিয়ে আগাছা পরিষ্কার করা, ক্রপ রোটেশন বা শস্যচক্র বজায় রাখা ইত্যাদি। সাধারণ চাষবাসের ক্ষেত্রে হার্ভিসাইড ব্যবহার করা হয়। পোকামাকড় দমনে সাধারণ চাষে পেস্টিসাইড বা কীটনাশক ব্যবহৃত হয়। কিন্তু অর্গানিক চাষে ব্যবহার করা হয় পাখি, ফাঁদ, অন্য পোকা ইত্যাদি। শস্য ছাড়া প্রাণিজ খাবার উৎপাদনে গবাদিপশু–পাখিকে হরমোন ও জিএমওমুক্ত প্রাকৃতিক খাবার খাওয়ানো হয়, কোনো কৃত্রিম খাবার দেওয়া হয় না। পশুপাখিকে সুস্থ রাখতে কোনো প্রকার অ্যান্টিবায়োটিক বা ওষুধ দেওয়া হয় না; বরং পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্যকর খাবার ইত্যাদির দিকে জোর দেওয়া হয়। আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এই পশুপাখিকে বাইরে প্রাকৃতিক পরিবেশে চরতে দেওয়া হয়, রোদ–আলো–হাওয়া–বৃষ্টিতে বেরোতে দেওয়া হয়, যা সাধারণত পোলট্রি বা ডেইরি ফার্মে করতে দেওয়া হয় না। এরা অন্দরে বা ছাদের নিচেই বেশি থাকে।
এখন দেখা যাক অর্গানিক খাবারে উপকারিতাগুলো কী। প্রথমত, এগুলোতে কোনো কৃত্রিম সার, কীটনাশক, হরমোন ব্যবহৃত হয় না বলে সেগুলো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে পুরোপুরি মুক্ত। পুষ্টিমানে যে খুব তফাত আছে তা নয়, তবে অর্গানিক খাবারে ওমেগা–৩ ফ্যাটি অ্যাসিড বেশি। কারণ, এরা সাধারণ প্রাকৃতিক ঘাস–লতাপাতা, পোকামাকড় খায়, ফলে এদের মাংসে বা ডিমে ওমেগা–৩ ৫০ শতাংশ বেশি পাওয়া যায়। ফ্ল্যাভনয়েড ও অন্যান্য অ্যান্টি–অক্সিডেন্টের পরিমাণও বেশি থাকে অর্গানিক খাবারে। গবেষণায় দেখা গেছে, অর্গানিক শস্যে ক্ষতিকর ধাতু, যেমন আর্সেনিক বা ক্যাডমিয়ামের পরিমাণ কম। তবে ফলমূলের ক্ষেত্রে এই প্রমাণ মেলেনি। ফার্মিংয়ে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক পরিবেশে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া তৈরিতে ভূমিকা রাখে। একইভাবে পশুপাখির বৃদ্ধি ও প্রজননের জন্য যে হরমোন ব্যবহৃত হয়, তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষ করতে কীটনাশক একেবারেই ব্যবহৃত হয় না, এই ধারণা অবশ্য ভুল। তবে এই কীটনাশকও প্রাকৃতিক। তাই কম ক্ষতিকর। অন্যদিকে রাসায়নিক কীটনাশকের অতি ব্যবহার ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। কারণ, এতে কারসিনোজেন বা ক্যানসার উৎপাদনকারী উপাদান থাকে।
পরিবেশবিদেরা অর্গানিক ফার্মিংয়ের পক্ষে। কারণ, কীটনাশক, সার এবং জিএমওর ব্যবহার পরিবেশ, ইকোসিস্টেম, বায়োডাইভারসিটি, সুপেয় পানির উৎসের জন্য যে ক্ষতিকর, তা প্রমাণিত
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অর্গানিক খাবারে জিএমও বা জিই ব্যবহৃত হয় না। জিএমও মানে জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম আর জিই মানে জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ার্ড প্ল্যান্ট। এর দ্বারা কোনো শস্যের ডিএনএ রূপান্তর করা হয়, যাতে ফলন বেশি হয় আর পোকামাকড় ও আগাছা প্রতিরোধী হয়। এফডিএ যদিও জিএমওকে নিরাপদ বলে ঘোষণা দিয়েছে, কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এতে দ্বিমত পোষণ করে। তাদের বক্তব্য হলো জিএমও ফুড অ্যালার্জি, ক্যানসার আর পরিপাকতন্ত্রের নানা সমস্যার জন্য দায়ী হতে পারে।
তবে সাধারণ বা কনভেনশনাল চাষপদ্ধতির সঙ্গে তুলনা করার মতো বড় গবেষণা উপাত্ত ও তথ্যপ্রমাণের অভাব রয়েছে বলে সাধারণ চাষি বা উৎপাদকেরা এসব মানতে পুরোপুরি রাজি নন। ১৯৯২ সালে সায়েন্স পত্রিকায় এ নিয়ে বিশদ গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয় যে চাষপদ্ধতিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক ছাড়াও আমরা প্রকৃতিতে নানা রকম রাসায়নিকের সম্মুখীন হই, যেগুলোর প্রভাব পড়ে স্বাস্থ্যের ওপর। চারপাশের বৃক্ষরাজি ও প্রাণী নিজেরাই নানা রকম রাসায়নিক পরিবেশে নিঃসরণ করে; আর কলকারখানা, যানবাহন তো আছেই। একজন মার্কিন নাগরিক দৈনিক শূন্য দশমিক শূন্য ৯ মিলিগ্রাম রাসায়নিকের সম্মুখীন হন খাবারে ব্যবহৃত কৃত্রিম সার বা কীটনাশক থেকে। অন্যদিকে দৈনিক ১ হাজার ৫০০ মিলিগ্রাম রাসায়নিকের সম্মুখীন হন চারপাশের পরিবেশ থেকে। তাই অর্গানিক খাবার খেলেই যে কেউ রাসায়নিক বা কেমিক্যাল এক্সপোজারমুক্ত থাকতে পারবে, ব্যাপারটা অত সহজ নয়। ওদিকে ২০১২ সালে আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস বলে যে শিশুদের অর্গানিক পদ্ধতিতে তৈরি খাবার খাওয়ানোর বাড়তি পুষ্টিসুবিধা বা বেনিফিট আছে, এমনটা সত্য নয়। শস্য উৎপাদনে কৃত্রিম সার ও কীটনাশক ব্যবহারে বন্ধ্যত্ব বাড়ে বা পুরুষের শুক্রাণুর সংখ্যা কমে যায় বলে যে ধারণা প্রচলিত, তারও প্রমাণ মেলেনি কোনো মেডিকেল গবেষণায়। তবে চাষপদ্ধতিতে কীটনাশক বা সারই হোক, তার মাত্রা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত, এমনটাই বলেন বিজ্ঞানীরা।
তবে পরিবেশবিদেরা অর্গানিক ফার্মিংয়ের পক্ষে। কারণ, কীটনাশক, সার এবং জিএমওর ব্যবহার পরিবেশ, ইকোসিস্টেম, বায়োডাইভারসিটি, সুপেয় পানির উৎসের জন্য যে ক্ষতিকর, তা প্রমাণিত। কেবল তা–ই নয়, সনাতন চাষ ও ফার্মিং পদ্ধতি নতুন নতুন সুপারবাগ বা ভয়ংকর জীবাণুর জন্ম দিচ্ছে। অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণও কম। অর্গানিক খাবার ও অর্গানিক চাষের প্রতি তাই বিশ্বজুড়ে আন্দোলন জোরদার হচ্ছে। ২০০২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে অর্গানিক খাবার ইন্ডাস্ট্রির চাহিদা বেড়েছে ১৭০ শতাংশ। অর্গানিক খাবারের পক্ষেই মূলত গড়ে উঠেছে ভেগান নামে আলাদা এক খাদক গোষ্ঠী। তবে সনাতন পদ্ধতির চেয়ে অর্গানিক পদ্ধতিতে খাদ্য উৎপাদনে খরচ বেশি। এ ধরনের খাবার মজুত করতে বা কৃত্রিমভাবে পাকাতে কোনো কৃত্রিম পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় না, তাই সহজে নষ্ট হয়। এসব কারণে অর্গানিক খাবারের দামও বেশি। তবে পৃথিবী যত বেশি অর্গানিক পদ্ধতির দিকে ফিরবে, তত বেশি এর চাহিদা বাড়বে আর ব্যয় কমবে। বর্তমানে বিশ্বের খাদ্য উৎপাদনের মাত্র ১ শতাংশ অর্গানিক পদ্ধতিতে হয়ে থাকে। কিন্তু পশ্চিমে এই বাণিজ্য প্রতিবছর ৫-১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমরা খাদ্য উৎপাদনের জন্য আবার প্রাচীন প্রাকৃতিক পদ্ধতির দিকেই ফিরতে বাধ্য হব।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড মেটাবলিজম, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ