সূর্যমুখী ফুল কেন সূর্যের দিকে ফিরে থাকে

সূর্যমুখী ফুল সূর্যের দিকেই মুখ করে থাকেছবি: পপুলার সায়েন্স

সূর্যমুখী ফুলের নাম কেন সূর্যমুখী? উত্তরটা হয়তো সবাই জানে। কারণ, এই ফুল সূর্যের দিকে মুখ করে থাকে। সকালে পুব আকাশে সূর্য ওঠার পর থেকে বিকেলে পশ্চিম আকাশে অস্ত যাওয়া পর্যন্ত সূর্য যেদিকে যায়, এই ফুলও যেন ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে।

কবি বা সাহিত্যিকেরা একে আনুগত্য বলতে পারেন। কিন্তু বিজ্ঞানীরা তো আর কবিতার ভাষায় কথা বলেন না, তাঁরা খুঁজছিলেন এর পেছনের কারণ। এত দিন তাঁরা ভাবতেন, বিষয়টা খুব সহজ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকেরা সম্প্রতি গবেষণা করে দেখেছেন, ল্যাবরেটরির চার দেয়ালে আমরা যা শিখি, খোলা মাঠে প্রকৃতির নিয়ম তার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।

অধিকাংশ গাছপালার একটা স্বভাব আছে, গাছপালা আলোর দিকে বেঁকে যায়। একে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে ফোটোট্রপিজম। সাধারণত গাছের ভেতরে ফোটোট্রপিন নামে একধরনের অণু থাকে, যা নীল রঙের আলোর প্রতি সংবেদনশীল। বিজ্ঞানীরা এত দিন ধরে নিয়েছিলেন, সূর্যমুখীর এই সূর্যকে অনুসরণ করার পেছনেও নিশ্চয়ই এই একই মেকানিজম কাজ করে।

কিন্তু গবেষক স্টেসি হারমার এবং তাঁর দল যখন গভীরে ঢুকলেন, তখন দেখলেন গল্পটা মোটেও এত সরল নয়। গবেষণায় দেখা গেল, সূর্যমুখীগাছ যখন ল্যাবরেটরির কৃত্রিম পরিবেশে বড় হয়, তখন তারা ঠিকই ওই পুরোনো ফোটোট্রপিন মেকানিজম ব্যবহার করে আলোর দিকে ছোটে। কিন্তু নাটক শুরু হয় যখন গাছগুলোকে খোলা আকাশের নিচে, আসল সূর্যের আলোতে রাখা হয়। গবেষক ক্রিস্টোফার ব্রুকস এবং হাগাটপ আথামিয়ান সূর্যমুখীর জিনগুলোর ওপর নজরদারি চালিয়ে অবাক হয়ে গেলেন। তাঁরা দেখলেন, বাইরে থাকা গাছগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পদ্ধতিতে কাজ করছে!

বাইরে থাকা গাছগুলোর মধ্যে ফোটোট্রপিন বা নীল আলোর সেই চেনা মেকানিজম কাজ করছে না। গবেষকেরা নীল আলো, লাল আলো, এমনকি অতিবেগুনি রশ্মি বা ইউভি লাইট আটকে দিয়েও দেখলেন, সূর্যমুখীর সূর্যের দিকে ঘোরা বন্ধ হচ্ছে না। তার মানে, সূর্যমুখী শুধু একটা নির্দিষ্ট রঙের আলোর ওপর নির্ভর করে না। সে সূর্যের দিকে ঘোরার জন্য একাধিক পথ ব্যবহার করে। একটা রাস্তা বন্ধ হলে সে আরেকটা রাস্তা দিয়ে ঠিকই সূর্যের পিছু নেয়।

স্টেসি হারমার বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম ফোটোট্রপিনই সূর্যের দিকে ঘুরে থাকার মূল কারণ। কিন্তু দেখা গেল যেখানে ফোটোট্রপিন নেই, সেখানেও সূর্যমুখী সূর্যের দিকে ঘুরে থাকে। তবে এর জন্য কে দায়ী, তা এখনো আমরা জানতে পারিনি।’

আরেকটা প্রশ্ন হলো, সূর্যমুখী কীভাবে নড়াচড়া করে? এদের তো আর পেশি নেই। আসলে এরা কোষের বৃদ্ধির মাধ্যমে নড়াচড়া করে। দিনের বেলায় গাছের কাণ্ডের পূর্ব পাশের কোষগুলো একটু বেশি লম্বা হয়। ফলে গাছটা পশ্চিম দিকে মানে সূর্যের দিকে বেঁকে যায়। আর রাতের বেলা ঘটে উল্টো ঘটনা। পশ্চিম পাশের কোষগুলো লম্বা হয়, ফলে গাছটা আবার পূর্ব দিকে ফিরে আসে এবং সকালের সূর্যের জন্য অপেক্ষা করে।

সূর্যমুখী ফুল সূর্যের দিকেই মুখ করে থাকে
মিডজার্নির সাহায্যে তৈরি

গবেষকরা দেখেছেন, সূর্যমুখীরা দারুণ দ্রুত শিখতে পারে। ল্যাবে বড় হওয়া একটা গাছকে যখনই বাইরে আনা হয়, প্রথম দিনেই সে সূর্যের সঙ্গে তাল মেলাতে শিখে যায়। প্রথম দিন তার ছায়াযুক্ত অংশের জিনে একধরনের দ্রুত পরিবর্তন ঘটে, যা পরের দিন আর দরকার হয় না। অর্থাৎ গাছটি চট করে নিজেকে বাইরের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়।

এখন আপনার মনে হতে পারে, গাছ কীভাবে ঘুরল তা জেনে আমাদের কী লাভ? লাভ আছে। এই গবেষণা একটা বড় সত্য সামনে এনেছে। আমরা ল্যাবরেটরির নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে যা আবিষ্কার করি, আসল পৃথিবীতে বা কৃষিক্ষেত্রে তা সব সময় খাটে না।

এত দিন বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, তাঁরা সূর্যমুখীর রহস্য জানেন। কিন্তু প্রকৃতি প্রমাণ করল, তার ভাণ্ডারে জাদুর অভাব নেই। সূর্যমুখী শুধু আলোর দিকেই ঘোরে না, সে নিজের ঘড়ি বা সার্কাডিয়ান ক্লক মেনে চলে। এতে সূর্য ওঠার আগেই সূর্যমুখী পূর্ব দিকে ঘুরে থাকার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারে। আবার সে এটাও হিসাব করে রাখে, কখন পোকামাকড় আসবে পরাগায়নের জন্য।

বিজ্ঞানীরা এখনো খুঁজছেন, কোন জিনগুলো আসলে এই সূর্যের দিকে ঘুরে যাওয়ার জন্য দায়ী।

লেখক: ফ্রন্টেন্ড ডেভলপার, সফটবেঞ্চ

সূত্র: ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, পিএলওএস বায়োলজি জার্নাল ও ফিউচারিটি ডটকম