বছরজুড়ে জীববিজ্ঞানের আলোচিত ১০

জীবনকে বোঝার লক্ষ্যেই জীববিজ্ঞান চর্চা। সেই লক্ষ্যে বিজ্ঞান অনেকখানি এগিয়েছে চলতি বছর। চেতনাকে বোঝার প্রচেষ্টা, স্টেমকোষ থেকে সিন্থেটিক ভ্রূণ তৈরি কিংবা সিকল সেল অ্যানিমিয়া রোধে ক্রিসপারের ব্যবহার, প্রাণীর মস্তিষ্কের মানচিত্র নির্মাণ, ওয়াই ক্রোমোজমের পূর্ণা মানচিত্র উন্মোচন—জীববিজ্ঞানের অগ্রগতি হয়েছে নানাদিকে। কোয়ান্টা ম্যাগাজিন, দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি সায়েন্স ফোকাস, লাইভ সায়েন্সসহ বেশ কিছু উৎসের সাহায্য নিয়ে এর মধ্য থেকে আলোচিত ১০ গবেষণার দিকে ফিরে তাকাতেই এই আয়োজন। এসব গবেষণার কোনোটাই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই ক্রমান্বয়ে সাজানো হয়নি।

চলুন, ফিরে তাকানো যাক।

চেতনা বোঝার প্রচেষ্টায় অগ্রগতি

চেতনা কী? আমাদের অনন্য অস্তিত্ব। যে অস্তিত্ব আমাদের মহাবিশ্বে বাস্তবতার একটা ছবি দেয়, টিকে থাকার অনুভূতি দেয়। তবে বিষয়টার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এখনো পরিষ্কার নয়। কয়েক হাজার বছর ধরে দার্শনিকেরা চেতনার প্রকৃতি (Nature of consciousness) বোঝার চেষ্টা করছেন। অর্ধশতাব্দী আগে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন জীববিজ্ঞানীরা। মস্তিষ্কের কোষগুলো তাদের বিভিন্ন কাজকর্মের জন্য একে অন্যের ওপরে কীভাবে নির্ভরশীল—এটা তাঁরা আবিষ্কার করেছেন। অভিজ্ঞতা বা এক্সপেরিয়েন্সের প্রতিটি আলাদা অংশের নাম দিয়েছেন কোয়ালিয়া (qualia)। কিন্তু এত কিছুর পরও নিউরোসায়েন্স বা স্নায়ুবিজ্ঞান আমাদেরকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির ব্যাপারে কিছুই বলতে পারেনি। নিউরন থেকে আনন্দ, রাগ কিংবা ক্ষোভ কীভাবে জন্ম নেয়—এ ব্যাপারে আজও আমাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।

তবে এই লক্ষ্যে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে চলতি বছর। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের স্নায়ুবিজ্ঞানী অনিল সেথের বক্তব্যের কথা বলা যায়। তাঁর হিসেবে, চেতনা একধরনের ‘নিয়ন্ত্রিত হ্যালুসিনেশন’। কেউই সরাসরি জানতে পারে না বাস্তবতা কী। তবে আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় থেকে গৃহীত তথ্যগুলোকে মস্তিষ্ক সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখে। তারপর এতদিনের জমা তথ্য ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা করে বোঝার চেষ্টা করে, কোনটা বাস্তবতা। সে জন্যই সাধারণত কল্পনা, মুভি বা বই পড়ে জানা কল্পবাস্তবতা বা স্বপ্নের সঙ্গে আমাদের সত্যিকার বাস্তবতা গুলিয়ে যায় না। এই যে তুলনার জন্য একটা ভিত্তি দাঁড় করানো, গবেষকেরা একে বলেন ‘রিয়েলিটি থ্রেশহোল্ড’, অর্থাৎ বাস্তবতার সীমা। আমাদের কল্পনার ফলে সৃষ্ট সিগন্যালগুলো এই সীমা পেরোতে পারে না, ফলে এগুলো বাস্তবতা থেকে আলাদা করতে পারে মস্তিষ্ক। কারো কারো জন্য এই সীমারেখা গুলিয়ে যেতে পারে, কিংবা কল্পনা হতে পারে অনেক শক্তিশালী—তখন হ্যালুসিনেশন বা বিভ্রম হয়।

পেছনের প্রশ্নটিতে ফেরা যাক। এই চেতনা মস্তিষ্কে আসে কোত্থেকে? শুধু চিন্তা থেকে, নাকি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতা থেকে? এ নিয়ে দুটি হাইপোথিসিস অনেকখানি এগিয়েছে। হাইপোথিসিসগুলো অবশ্য অনেক আগের। এক, গ্লোবাল নিউরোনাল ওয়ার্কস্পেস থিওরি। এই হাইপোথিসিস বলে, চেতনা মানে সমান্তরাল বেশ কিছু প্রক্রিয়া ও তথ্যের সমন্বয়। ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য নানা তথ্য অবেচেতনে জমা হয়। মনযোগ এ ক্ষেত্রে স্পটলাইটের মতো কাজ করে ও কিছু জিনিসকে সামনে নিয়ে আসে। ফলে সচেতন চিন্তা তৈরি হয়।

আর দুই, ইন্টিগ্রেটেড ইনফরমেশন থিওরি। এ ক্ষেত্রে আইডিয়াটি হলো, একটা সিস্টেমের মধ্যে যে সাবসিস্টেমগুলো থাকে, তাদের মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদানের ফলে তৈরি হয় কনশাসনেস বা চেতনা। এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে গাণিতিক মডেলও নির্মিত হয়েছে। এ বছর দুই দল বিজ্ঞানী এই হাইপোথিসিস দুটো নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন। কোনটি সঠিক, এ বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে চেতনা বোঝার প্রচেষ্টায় তাঁদের কাজকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করছেন অনেক গবেষক ও স্নায়ুবিজ্ঞানী।

স্টেম সেল থেকে সিন্থেটিক ভ্রূণ

ভৌত বিজ্ঞানীরা যেমন নানা ধরনের মডেল নির্মাণ করেন, তেমনি যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (ক্যালটেক) একদল গবেষক যৌথভাবে কৃত্রিম ভ্রূণ তৈরি করেছেন। স্টেম কোষ—এমন কোষ, যা থেকে তৈরি হতে পারে একাধিক ও নানারকম কোষ; গাছের কাণ্ড থেকে যেমন শাখা প্রশাখা বেড়ে ওঠে, এটাও সেরকম—থেকে তাঁরা এই ভ্রূণ তৈরি করেছেন। এর মাধ্যমে তাঁরা মিসক্যারিজ ও জন্মগত বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের লক্ষ্যে গবেষণা করেছেন। তাঁদের দাবি, ভবিষ্যতে এসব সমস্যা অনেকখানি কমিয়ে আনা সম্ভব এই গবেষণার ফলে। তবে এ ধরনের ভ্রূণ তৈরি অনেক দেশে নিষিদ্ধ ও অনৈতিক। এই গবেষণা ফলপ্রসু হলেও কতটা সঠিক ও নৈতিক, তা নিয়ে তাই আবারও প্রশ্ন উঠেছে।

একাকীত্ব বোধ ও ডিপ্রেশন কেন হয়

ডিপ্রেশনের পেছনের কারণ হিসেবে এতদিন দায়ী করা হতো মস্তিষ্কে কিছু রাসায়নিকের ভারসাম্যহীনতাকে। বিশেষ করে সেরাটোনিন নামে একধরনের হরমোনের অভাবে এই সমস্যা হয় বলে মনে করা হতো। এই রাসায়নিক বিভিন্ন স্নায়ুর মধ্যে বার্তা আদান-প্রদানের কাজ করে। তবে একদল গবেষক চলতি বছর ৩৫০ গবেষণাপত্র ঘেঁটে দেখেছেন, সেরাটোনিনের অভাবই যে এ জন্য দায়ী, এরকম কোনো শক্ত প্রমাণ নেই। ফলে গবেষকেরা ডিপ্রেশনের নেপথ্যের কারণ নিয়ে আবারও ভাবতে শুরু করেছেন। এক হাইপোথিসিস বলছে, ঘুমের সমস্যা, খাবার রুচি বদলে যাওয়া বা রুচিহীনতা, ক্লান্তি, উদাসীনতাসহ বিভিন্ন রোগের সমন্বয়ই হয়তো ডিপ্রেশন। তবে এটা আসলেই সত্যি কি না, এর পেছনে আরও কোনো জটিলতা আছে কি না, তা নিয়ে গবেষণা চলছে।

ডিপ্রেশন হলে মানুষ বিচ্ছিন্ন বোধ করে। তবে ডিপ্রেশন ও একাকীত্ব বোধ এক নয়। স্নায়ুবৈজ্ঞানিক এক গবেষণা বলছে, এটি মূলত মস্তিষ্কের সামাজিক বিভিন্ন তথ্যকে নেগেটিভ বা মন্দ অর্থে গ্রহণ করা ও আত্মশাস্তির প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত। বিষয়টা একধরনের চক্রের মতো কাজ করে। অর্থাৎ দিন দিন এই বোধ আরও বাড়তে থাকে। এই বিষয়গুলোর চিকিৎসা কীরকম হতে পারে, কোনো নির্দিষ্ট হরমোনের বাড়া-কমার সঙ্গে কতটা জড়িত, তা এখনো জানা যায়নি। তবে বিষয়টার মূল কথা বোঝার ফলে এখন বাকি বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা এবং এ ধরনের সমস্যা কমিয়ে আনার পথে এগোনো সহজ ও দ্রুততর হবে বলে মনে করছেন অনেক গবেষক।

দেহের ভেতরে অণুজীবেরা বেড়ে চলে আমাদের সঙ্গে

আমাদের দেহের ভেতরের অণুজীবদের বলা হয় মাইক্রোবায়োম। গত একযুগের গবেষণায় আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর এগুলোর প্রভাব কেমন, তা জানা সম্ভব হয়েছে আরও ভালোভাবে। এগুলো কোত্থেকে আসে, কীভাবে বেড়ে চলে—সে বিষয়ে এ বছর জানা গেছে আরও বিস্তারিতভাবে।

মাইক্রোবায়োম প্রথম শিশুদেহে আসে মা থেকে—জন্মের সময় ও মায়ের দুধ খাওয়ার মাধ্যমে। এক গবেষণা বলছে, শুধু এগুলোই নয়, ‘মোবাইল জেনেটিক এলিমেন্ট’ নামে একধরনের ডিএনএ খণ্ডও মায়ের দেহ থেকে শিশুদেহে আসে। জন্মের প্রথম বছরজুড়েই ‘হরাইজনাল জিন ট্রান্সফার’ নামে এক প্রক্রিয়ায় শিশুর দেহে আসে এগুলো। বছরজুড়েই এগুলো সক্রিয় থাকে, বেড়ে ওঠে অণুজীবেরা। জন্মের এত সময় পরেও মায়ের দেহের অণুজীব শিশুদেহে এত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে দেখে একটু অবাকই হয়েছেন গবেষকেরা। ফলে অসংক্রামক বলে ভাবা হতো, এমন কিছু রোগ সংক্রামক হতেও পারে—এমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। শুধু অপকারী নয়, উপকারী অণুজীবও শিশু মায়ের দেহ থেকে এভাবে পায়। এই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য মা ও শিশুর রোগ প্রতিকার ও প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, এমনটাই মনে করছেন গবেষকেরা।

প্রাণীর মস্তিষ্কের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র

প্রথমবারের মতো এ বছরের মার্চে একটি মাছির মস্তিষ্কের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র তৈরি করেছেন বিজ্ঞানীরা। ১২ বছর পরিশ্রমের পর ৩ হাজার ১৬টি নিউরন ও ৫ লাখ ৪৮ হাজার স্নায়বিক সংযোগবিশিষ্ট মাছির মস্তিষ্কের এ মানচিত্র তৈরি করেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির একদল বিজ্ঞানী। এর ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্রম বোঝার ক্ষেত্রে অগ্রগতি যেমন হয়েছে, তেমনি ভবিষ্যতের অনেক গবেষণায় এ মানচিত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সিকল সেল অ্যানিমিয়া রোধে ক্রিসপার

সিকল সেল অ্যানিমিয়া একটি বংশগত রোগ। বেটা-গ্লোবিন নামে একটি জিনে মিউটেশনের ফলে এ রোগ হয়৷ এই জিন মূলত রক্তের হিমোগ্লোবিন প্রোটিন তৈরির নির্দেশনা দেয়৷ এতে মিউটেশন হলে হিমোগ্লোবিনের গঠন বদলে যায়। ফলে লোহিত রক্তকণিকা তার স্বাভাবিক আকার বদলে সিকল বা কাস্তের মতো হয়ে যায়। এ আকৃতি অনেকটা অর্ধচন্দ্রের মতো। সিকল সেলের আকৃতি অস্বাভাবিক দেখে এটি রক্তনালিতে আটকে যায়। তখন রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয় ও রক্তে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়৷ এর ফলে অনেকের মৃত্যুও হয়।

এ রোগ প্রতিকারের জন্য এফডিএ ক্রিসপারনির্ভর ‘ক্যাসজেভি’ চিকিৎসা পদ্ধতি অনুমোদন করেছে এ বছর। এটি একধরনের জিন থেরাপি—অর্থাৎ জিন বদলে দিয়ে চিকিৎসা করা। ক্যাসজেভি ব্যবহার করতে মূলত তিনটি জিনিস প্রয়োজন—ক্যাস৯ প্রোটিন, গাইড আরএনএ এবং সুস্থ জিন। গাইড আরএনএর কাজ হলো ক্যাস৯-কে গাইডের মতো পথ দেখিয়ে ডিএনএর যে জায়গায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন, সেখানে পৌঁছে দেওয়া। আর ক্যাস৯ প্রোটিন আণবিক কাঁচির  কাজ করে। অর্থাৎ আক্রান্ত ডিএনএর নির্দিষ্ট অংশ ছেঁটে ফেলে৷ পরে ছেঁটে দেওয়া অংশটি সুস্থ জিন দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। সিকল সেল অ্যানিমিয়াও অনেকটা একইভাবে নিরাময় করা সম্ভব৷ প্রথমে গাইড আরএনএ ব্যবহার করে রোগীর স্টেম কোষে ত্রুটিপূর্ণ বেটা-গ্লোবিন জিন শনাক্ত করে ক্যাস৯ প্রোটিনের আণবিক কাঁচি দিয়ে ছেঁটে ফেলা। পরে সে অংশটিতে বিজ্ঞানীদের সরবরাহকৃত সুস্থ জিন বসানো। এই সুস্থ বেটা-গ্লোবিন জিন হিমোগ্লোবিন তৈরির যে নির্দেশনা দেয়, তার গঠন ঠিকঠাক থাকে৷ লোহিত রক্তকণিকাও তার স্বাভাবিক আকার বজায় রাখে।

এতদিন প্রচলিত অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন পদ্ধতি থেকে এর জটিলতা অনেক কম। এ পদ্ধতি অনেক নিরাপদ। তা ছাড়া বছরখানেকের মধ্যেই এ চিকিৎসায় রোগটি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

শিশুর শ্বসনতন্ত্রের সমস্যা প্রতিরোধে গর্ভবতী নারীদের জন্য টিকা

প্রথমবারের মতো গর্ভবতী মায়েদের জন্য নতুন একধরনের টিকার অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ (ড্রাগ) নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ এফডিএ। এই টিকা গর্ভের শিশুর ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা, যেমন নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস, ঠান্ডা-কাশি ইত্যাদি সমস্যা রোধ করবে। গর্ভকালের ৩২ থেকে ৩৬তম সপ্তাহের মধ্যে হবু মায়েরা এই টিকা নিতে পারবেন। এখন পর্যন্ত চালানো সব গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যাবরিসভো নামের এই টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে টিকাগ্রহীতা যেখানে ইঞ্জেকশন নিয়েছেন, সেখানে ব্যথা, মাথা ও পেশী ব্যথা ও বমিভাব হতে পারে। এ ছাড়া আর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। চিকিৎসাবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি বলেই বিবেচনা করা হচ্ছে এটিকে।

শীতকে রক্ষিত ইঁদুরের কিডনি প্রতিস্থাপন

প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মিনেসোটার একদল গবেষক ১০০ দিন ক্রায়োশীতকে রক্ষিত ইঁদুরের কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন সফলভাবে। এই গবেষণার গুরুত্ব বুঝতে প্রথমে জানা প্রয়োজন, কিডনি প্রতিস্থাপন বেশ জটিল ব্যাপার। বিবিসি বাংলার তথ্যানুসারে, প্রতি বছর দেশে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ কিডনি বিকল হয়ে মারা যান। ২০১৯ সালে সংখ্যাটা ছিল ১০ হাজারের মতো, যা এই কয় বছরে অনেক বেড়েছে। পুরো বিশ্বেই এই সমস্যা প্রকট হয়ে উঠছে দিন দিন। খরুচে, ডোনার ম্যাচ করতে হয়, এসব সমস্যার পাশাপাশি এর আরেকটা বড় কারণ, প্রতিস্থাপনের জন্য দান করা ২০% কিডনি প্রতিস্থাপনের আগেই অকেজো হয়ে যায়। বেশি সময় সংরক্ষণ করা যায় না। এই গবেষণা সে ক্ষেত্রে আশার আলো দেখাচ্ছে। তবে মানুষের ক্ষেত্রে এ গবেষণা প্রয়োগ করতে আরও সময় ও গবেষণা প্রয়োজন। আগে অন্যান্য অনেক প্রাণীর ওপর প্রয়োগ করে, অর্থাৎ ট্রায়াল দিয়ে দেখতে হবে, এটা আসলে বড় পরিসরে কার্যকর কি না।

জিন গবেষণায় অগ্রগতি

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের (এনআইএইচ) গবেষকেরা এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি দারুণ সফটওয়্যার বানিয়েছেন। ২০২২ সালে বিজ্ঞানীরা মানুষের জিন বিন্যাসের সম্পূর্ণ মানচিত্র নির্মাণ শেষ করেন। এর ওপর ভিত্তি করেই বানানো হয়েছে ভেরকো নামের এই সফটওয়্যার। বিজ্ঞানীদের আশা, মানুষের জিনগত বিভিন্ন রোগের কারণ এর সাহায্যে সহজে নির্ণয় করা যাবে। এদিকে, আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশন্যাল ইনস্টিটিউট অব স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেকনোলজির (এনআইএসটি) একদল গবেষক পুরুষের ওয়াই ক্রমোজমের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র তৈরির পাশাপাশি ৪১টি নতুন জিন আবিষ্কার করেছেন। পুরুষের প্রজননবিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা ও রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে এ গবেষণা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

কৃষিব্যবস্থা পাখিদের মৃত্যুর জন্য দায়ী

পরিবেশের জন্য এই বছরটা নেতিবাচক অর্থে রেকর্ড করেছে নানাভাবে। বাড়ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা, রেকর্ড পরিমাণ গরম পড়া, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে পদক্ষেপসহ নানা সমস্যা দেখা গেছে এ বছর। তবে পাখিদের বিষয়টি সব ছাড়িয়ে বেশি বিপদজনক বলে মনে করছেন অনেকেই।

গত চার দশকে ইউরোপে পাখির সংখ্যা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। সংখ্যাটা প্রায় ৫৫ কোটির মতো! গোটা পৃথিবীতে সংখ্যা কত বিশাল, তা ভাবলে থমকে যেতে হয়। এর পেছনের মূল কারণ হিসেবে এতদিন দূষণ ও পাখিদের বাসস্থান ধ্বংস করার বিষয়টিকে দায়ী করা হতো। চলতি বছর ফ্রান্সের ইউনিভার্সিটি অব মন্টপেলিয়েঁর পরিবেশবিজ্ঞানী স্ট্যানিসলাস রিগালের নেতৃত্বে একদল গবেষক ২০টি দেশের ২০ হাজার পাখির বাসস্থান ঘুরে ১৭০টি প্রজাতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। এ জন্য তাঁরা সিটিজেন সায়েন্টিস্ট বা অপেশাদার, উৎসাহী সাধারণ মানুষের সাহায্যও নিয়েছেন। সংগৃহীত তথ্য থেকে তাঁরা সিদ্ধান্তে এসেছেন, পাখিদের মৃত্যুর পেছনে মূলত দায়ী কীটনাশক, বালাইনাশক, আগাছানাশক ও কৃত্রিম সার। অর্থাৎ আধুনিক কৃষিব্যবস্থাই পাখিদের মৃত্যুর জন্য দায়ী। এগুলো পাখিদের খাবার নষ্ট করে ফেলছে, প্রভাব ফেলছে তাদের স্বাস্থ্যে। বিষয়টি শুধু পাখিদের জন্য নয়, মানুষের জন্যও ভয়ংকর। একে তো বিষের প্রভাবের বিষয়টি এসে যায়। তার ওপর বাস্ততন্ত্রের কোনো একটি উপাদান—যেমন পাখি বা মৌমাছি, কোনো একটি বিলুপ্ত হয়ে গেলেই ধসে পড়তে পারে গোটা বাস্তুতন্ত্র। ২০২৪ সালে এ বিষয়ে ইতিবাচক উদ্যোগ না নিলে এটি আরও বড় সমস্যা হয়ে উঠতে পারে।

সূত্র: বিবিসি সায়েন্স ফোকাস, কোয়ান্টা ম্যাগাজিন, দ্য গার্ডিয়ান, লাইভ সায়েন্স, উইকিপিডিয়া, বিজ্ঞানচিন্তা