সুকুমার রায় লিখেছিলেন—‘গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, গোঁফ দিয়ে যায় চেনা।’ তবে গোফ দিয়ে শুধু মানুষই চেনা যায়। কিন্তু লেজ দিয়ে চেনা যায় অন্য অনেক প্রাণী। প্রাণীদের একেক জনের লেজ একেক রকম। কারোটা বাঁকা, করোটা সোজা, কারোটা ছোট, তো কারোটা বড়—এরকম। তাই প্রত্যেক প্রাণীকে স্রেফ তার লেজ দেখেই চেনা সম্ভব। সে জন্য সুকুমারের ছড়াটা এভাবেও লেখা যায়—‘লেজের আমি, লেজের তুমি, লেজ দিয়ে যায় চেনা।’
এককথায় উত্তর হলো, প্রাণিজগতে এই লেজের ভূমিকা অপরিসীম। পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা, স্বাস্থ্য বা মর্যাদার প্রতীক হিসেবে, যুদ্ধে, সংকেত জানাতে, আত্মরক্ষায়, চলাচলে, ভারসাম্য রাখতে প্রাণীরা লেজ ব্যবহার করে
লেজ না হয় চেনা গেল, কিন্তু এর আসলে কাজ কী? এককথায় উত্তর হলো, প্রাণিজগতে এই লেজের ভূমিকা অপরিসীম। পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা, স্বাস্থ্য বা মর্যাদার প্রতীক হিসেবে, যুদ্ধে, সংকেত জানাতে, আত্মরক্ষায়, চলাচলে, ভারসাম্য রাখতে প্রাণীরা লেজ ব্যবহার করে।
এই যেমন বনের রাজা সিংহের কথাই ধরা যাক। বিড়াল প্রজাতির মধ্যে একমাত্র সিংহের লেজের মাথায় ঝুঁটি আছে। মা সিংহের এই নরম ঝুঁটি সিংহছানার জন্য উপকারী। খাদ্য সংগ্রহ বা অন্য কাজে ঘন ও বড় বড় ঘাসের মধ্য দিয়ে তাদের চলাফেরা করতে হয়। সে সময় বাচ্চারা যাতে পথ না হারায়, সে জন্য মা সিংহ লেজ ওপরে তুলে রাখে। এতে ছানারা সহজেই মাকে অনুসরণ করতে পারে।
পদমর্যাদা বোঝাতে সেনাবাহিনী তারকাযুক্ত নানা প্রতীক ব্যবহার করে। প্রাণিবিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন, তেমনি কিছু প্রাণীও লেজ দিয়ে প্রকাশ করে পদমর্যাদা। অস্ট্রিচ দলে সবচেয়ে উঁচু পদের পুরুষের লেজ একদম সোজা থাকে
এদিকে লেজ দিয়ে নিজের সামাজিক অবস্থান ও সুস্বাস্থ্য প্রদর্শন করে ময়ূর। বিশেষ করে পুরুষ ময়ূর। কোনো ময়ূরের বড় ও সুন্দর লেজের অর্থ সে স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী। এই লেজ দেখিয়ে মেয়ে ময়ূরের হৃদয় জয় করতে চেষ্টা করে পুরুষরা। কারণ মেয়ে ময়ূর সুন্দর, রোগমুক্ত পুরুষকেই সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয়। কাজেই পুরুষের জন্য এমন লেজ থাকা বাধ্যতামূলক।
পদমর্যাদা বোঝাতে সেনাবাহিনী তারকাযুক্ত নানা প্রতীক ব্যবহার করে। প্রাণিবিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন, তেমনি কিছু প্রাণীও লেজ দিয়ে প্রকাশ করে পদমর্যাদা। অস্ট্রিচ দলে সবচেয়ে উঁচু পদের পুরুষের লেজ একদম সোজা থাকে। এভাবে সে দলের অন্যদের ওপর প্রভুত্ব বিস্তার করে। পদমর্যাদা অনুযায়ী তার পরের অস্ট্রিচ পুরুষের লেজ ভূমির সমান্তরাল থাকে। আর দলের অন্য অস্ট্রিচ নিচে নামিয়ে রাখে তাদের লেজ।
এদিকে যুদ্ধক্ষেত্রে লেজ ব্যবহার করে লেমুররা। এক দলের এলাকায় আরেক দল লেমুর ঢুকে পড়লে তাদের মধ্যে ঝগড়া লেগে যায়। এ ক্ষেত্রে তারা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে দুর্গন্ধ। মানে গন্ধবোমা। সেই গন্ধের কাছে টেকে কার সাধ্যি! এ সময় তারা লোমশ লেজ কাঁধ ও হাতের গন্ধগ্রন্থিতে ঘষে নেয়। তারপর এই দুর্গন্ধযুক্ত লেজ বাড়িয়ে দেয় শত্রুর দিকে। সাধারণত এসব যুদ্ধে শক্তিশালী লেমুর দলই জেতে এবং ওই এলাকার মালিক বনে যায়।
লেজ দিয়ে অন্যকে ভয় দেখায় র্যাটল স্নেক। এদের লেজের মাথায় ঝুনঝুনি থাকে। এটা বাজিয়ে তারা অন্যদের সর্তক করে। তারপরও কেউ কাছে আসার চেষ্টা করলে বিষাক্ত ছোবল দেয় প্রাণীটির দেহে। র্যাটল স্নেকের এ ভঙ্গি নকল করে গোফার ও কিং স্নেক শুকনো পাতায় লেজ দিয়ে খসখস শব্দ করে। এতে অন্যরা তাদের র্যাটল স্নেক ভেবে ভয়ে পালায়।
আবার লেজ দিয়েই আত্মরক্ষা করে শজারু ও টিকটিকি। শজারুর লেজের মাথায় কাঁটা থাকে। এই কাঁটা নাড়াচাড়া করলে ঝনঝন শব্দ হয়। শত্রুর কবলে পড়লে তারা এই কাঁটা নেড়ে শত্রুকে বুঝিয়ে দেয়—আমি যুদ্ধের জন্য তৈরি। আমার সঙ্গে লাগতে এসো না। এরপরও যদি শত্রু আক্রমণ করে, তাহলে শজারু তার লেজের একগুচ্ছ কাঁটা ছুড়ে দেয় ওই শত্রুর দিকে।
টিকটিকির খসে পড়া লেজ দেখেছেন নিশ্চয়ই। আসলে শত্রুপক্ষের আক্রমণে লেজ খসিয়ে পালায় টিকটিকি। দেহ থেকে খসে গেলেও এ লেজ লাফাতে থাকে। শত্রুপক্ষ এই লেজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ততক্ষণে টিকিটিকি পৌঁছে যায় নিরাপদ জায়গায়।
অনেক প্রাণী চলাফেরা বা ভারসাম্য রক্ষায় লেজ ব্যবহার করে। সরীসৃপরা লেজকে চলাচলের অঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করে। পানিতে সাঁতার কাটতে লেজকে প্রোপেলের মতো ব্যবহার করে কুমির। মাছও সাঁতার কাটতে লেজের ওপর নির্ভর করে। অনেক বানর লেজ দিয়ে গাছের ডাল শক্ত করে জড়িয়ে ধরে এক গাছ থেকে আরেক গাছে যাতায়াত করে। বিড়াল, বাঘ, সিংহ পাহাড়ের ওপর লাফিয়ে চলার সময় ভারসাম্য রাখে লেজ দিয়ে। গাছের ডালে স্থিরভাবে বসে থাকতে লম্বা লেজ ব্যবহার করে ম্যাকাও পাখি। লেজ না থাকলে তারা গাছের ডাল থেকে নিচে পড়ে যেত।
শান্তির প্রতীক হিসেবে লেজের ব্যবহার করে কুকর। প্রত্যেক পুরুষ কুকুর নিজ এলাকায় স্বঘোষিত রাজা। নিজ এলাকায় কুকুর লেজ সবসময় উঁচু করে রাখে। কিন্তু অন্য কুকুর ওই এলাকায় গেলে আগুন্তুককে নামিয়ে রাখতে হয় লেজ। এর অন্যথা হলে দুই কুকুরের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায়। তাই শান্তিপ্রিয় কুকুর এ ক্ষেত্রে লেজ নামিয়ে রেখে কুই কুই শব্দ করে অন্য কুকুরের বশ্যতা স্বীকার করে। এই হলো বিশাল প্রাণিজগতের কয়েক সদস্যের লেজকাহিনি। বাকি লেজমালিকদের নিয়ে না হয় বলা যাবে আরেক দিন।
