খুঁজে পাওয়া গেছে সবচেয়ে প্রাচীন পিঁপড়ার জীবাশ্ম

সম্প্রতি গবেষকেরা নতুন এক প্রজাতির পিঁপড়া খুঁজে পেয়েছেন। একে বলা হচ্ছে 'হেল অ্যান্ট' বা ‘নরকের পিঁপড়া’। এই প্রজাতির পিঁপড়া পৃথিবীতে বাস করেছে প্রায় ১১ কোটি ৩০ লাখ বছর আগে। তখন ছিল ক্রিটেশিয়াস যুগ, মানে ১৪.৫ কোটি থেকে ৬.৬ কোটি বছর আগের কথা। সে সময় টিকে ছিল এই হেল অ্যান্ট। এটি সম্ভবত এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে প্রাচীন পিঁপড়ার জীবাশ্ম। গত ২৪ এপ্রিল কারেন্ট বায়োলজি জার্নালে এ বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে।

নতুন এই জীবাশ্ম পিঁপড়ার প্রজাতি খুঁজে পাওয়াটা কয়েকটা কারণে বিশেষ। যেমন পিঁপড়ার ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রাচীন রেকর্ড এটি। আরেকটি কারণ হলো, এরা 'হেল অ্যান্ট' নামে বিলুপ্ত একটি পিঁপড়াগোষ্ঠীর অংশ। এরা অদ্ভুত ধরনের চোয়াল দিয়ে শিকার করত। এই চোয়াল পিঁপড়ার শিকারী বৈশিষ্ট্যের অভিযোজনের জন্য পরিচিত।

গবেষকেরা এই প্রাচীন পিঁপড়া প্রজাতির নাম দিয়েছেন ভলকানিদরিস ক্রেটিনসিস (Vulcanidris cratensis)। এদের চোয়াল ছিল কাস্তের মতো। ওপরের দিকে বাঁকানো চোয়াল দিয়ে শিকার ধরত। এই চোয়ালে শিকারকে গেঁথেও ফেলতে পারত বলে মনে করা হয়। পিঁপড়ার প্রজাতিগুলোর মধ্যে এমন চোয়াল ও শিকারের পদ্ধতি অনন্য।

বর্তমান পৃথিবীতে ১২ হাজারের বেশি পিঁপড়ার প্রজাতি আছে। রেইনফরেস্ট থেকে শুরু করে মরুভূমি পর্যন্ত, নানা পরিবেশে এদের পাওয়া যায়। এই পিঁপড়ারা ফরমিসাইড পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হাইমেনপটিরা পর্বের সদস্য। এই পর্বে মৌমাছি ও বোলতাও আছে। মনে করা হয়, পিঁপড়ার পূর্বপুরুষেরা প্রায় ১৪ কোটি বছর আগে বোলতার মতো প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়েছিল।

হেল অ্যান্ট ছিল একটি বিলুপ্ত সাবফ্যামিলি। ক্রিটেশিয়াস যুগের পিঁপড়া হেল অ্যান্টের কয়েকটি প্রজাতির জীবাশ্ম এর আগেও বিভিন্ন দেশে পাওয়া গেছে। মিয়ানমার, ফ্রান্স এবং কানাডার অ্যাম্বারে আবিষ্কৃত হয়েছে এরা। তবে সেগুলো প্রায় ১০ কোটি বছর পুরনো। এগুলোই ছিল এতদিন পর্যন্ত পরিচিত সবচেয়ে পুরনো পিঁপড়ার জীবাশ্ম। এদের তুলনায় পুরোনো হওয়ার দিক দিয়ে সম্প্রতি খুঁজে পাওয়া জীবাশ্মটি ১ কোটি ৩০ লাখ বছর এগিয়ে আছে।

হেল অ্যান্টদের মাথা এবং চোয়ালের গঠন বর্তমান পিঁপড়ার চেয়ে একেবারে আলাদা। এদের চোয়াল ছিল ওপরের দিকে বাঁকানো। অন্যদিকে এখনকার পিঁপড়ার চোয়াল ভেতরের দিকে বা নিচের দিকে বাঁকানো। এর আগে ৯.৯ কোটি বছর পুরোনো জীবাশ্মও পাওয়া গেছে। এমন জীবাশ্ম আছে, যেখানে একটি হেল অ্যান্ট শিকারের ওপর আক্রমণ করার মুহূর্তে জমাটবদ্ধ অবস্থায় আটকে পড়েছে।

গবেষকরা মাইক্রো-কম্পিউটেড টমোগ্রাফি ইমেজিং পদ্ধতি ব্যবহার করে এক্স-রের মাধ্যমে কোনো বস্তুর ভেতরের অংশ দেখতে পারেন।

নতুন আবিষ্কৃত এই হেল অ্যান্টের প্রজাতিটি ব্রাজিলের ক্রাটো কনজারভাট-ল্যাজারস্ট্যাট নামে ভূতাত্ত্বিক স্তরের চুনাপাথরে সংরক্ষিত ছিল। একসময় এই অঞ্চল প্রাচীন অতিমহাদেশ গন্ডোয়ানার উত্তর অংশে অবস্থিত ছিল। খুঁজে পাওয়া জীবাশ্মটি ব্রাজিলের সাও পাওলো ইউনিভার্সিটির প্রাণিবিদ্যা জাদুঘরে সংরক্ষিত একটি সংগ্রহের মধ্য থেকে গবেষকরা পুনরায় আবিষ্কার করেছেন। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে প্রাচীন পিঁপড়া এটি। প্রথম পাথরে সংরক্ষিত অবস্থায় পাওয়া হেল অ্যান্টও এটি।

গবেষকরা মাইক্রো-কম্পিউটেড টমোগ্রাফি ইমেজিং পদ্ধতি ব্যবহার করে এক্স-রের মাধ্যমে কোনো বস্তুর ভেতরের অংশ দেখতে পারেন। এই পদ্ধতিতে নিশ্চিত হওয়া গেছে, এটি সত্যিই একটি হেল অ্যান্ট। কারণ, এর মুখের ওপরের দিকে বাঁকানো চোয়াল এই প্রজাতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

গবেষকেরা জানতে পেরেছেন, নতুন আবিষ্কৃত পিঁপড়ার প্রজাতিটি মিয়ানমারে অ্যাম্বারে সংরক্ষিত অন্যান্য হেল অ্যান্টদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ছিল। তার মানে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে পিঁপড়ারা বিজ্ঞানীদের ধারণার চেয়েও আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল।

এই জীবাশ্মটিকে বিজ্ঞানীরা এক টুকরো পাজল মনে করছেন। এর মাধ্যমে আগেকার পোকামাকড়কে আরও ভালোভাবে বোঝা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন তাঁরা।

হেল অ্যান্টরা ছিল খুব বৈচিত্র্যময় ও সফল। তিনটি মহাদেশজুড়ে প্রায় ২ কোটি বছর ধরে বাস করেছে এরা। এখন ডাইনোসর যুগকে আরও জটিলভাবে কল্পনা করা যাবে। সে যুগে ডাইনোসরদের পাশাপাশি বাস করত অসাধারণ সব পোকামাকড়। যাদের বিশেষ ধরণের স্বভাব ও শারীরিক গঠন ছিল। মানুষ সাধারণত বিশাল ডাইনোসর, স্তন্যপায়ী প্রাণী বা বড় প্রাণীদের জীবাশ্মের কথা ভাবে। এর বাইরেও ছিল পোকামাকড়ের বিচিত্র জগৎ। হেল অ্যান্ট সেই জগতের প্রতিনিধি। 

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, কিশোর আলো

সূত্র: লাইভ সায়েন্স ও ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক