রান্না ছাড়াই ভাত

কর্মব্যস্ত জীবনে রান্নাবান্না করে খাওয়ার সময় কই! পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশের অধিবাসীরা তাই রান্নাবান্নার ঝামেলায় তেমনটা যান না। মুঠোফোনে অনলাইনে অর্ডার করে ঘরে আনিয়ে নেন পছন্দসই খাবার। অথবা কর্মস্থলে যাওয়া-আসার ফাঁকে পথেই কোনো রেস্তোরাঁয় সেরে নেন প্রাত্যহিক এই প্রয়োজন। আমাদের দেশে শহরাঞ্চলে এই সংস্কৃতি অল্পবিস্তর দেখা গেলেও উপশহর বা গ্রামাঞ্চলে এর এখনো প্রচলন ঘটেনি। সুস্বাদু রান্না আর স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য এখনো সবাই নিজ বাসায় রান্না করে খাওয়াকেই প্রাধান্য দেন। আর রান্না মানেই তো নানা ঝক্কি। প্রয়োজন চাল, চুলো, কাঠ, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির খরচ। সময়ের অপচয় তো রয়েছেই। এই ঝামেলায় অন্তত একটু কমানোর সুখবর দিচ্ছেন ধান বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, আর চাল সেদ্ধ করে ভাত নয়; এবার পানিতে চাল ভেজালেই তৈরি হয়ে যাবে ভাত।

হ্যাঁ, ভাত তৈরির এমনই অভিনব খবরটি দিয়েছেন ভারতের ওডিশা রাজ্যের কটকের কেন্দ্রীয় চাল গবেষণাকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলেছেন, এমন ধরনের এক চাল তাঁরা উদ্ভাবন করেছেন, যে চাল পানিতে ভেজালেই পাওয়া যাবে ভাত। এই চাল সেদ্ধ করার দরকার হবে না। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, আসামের ‘কোমল চাল’ নিয়ে গবেষণা করে উদ্ভাবন করা হয়েছে ‘অঘনিবোরা’ নামের নতুন জাতের এই ধান। কোথাও আবার এটি আগুনাবিন্নি ধান নামেও পরিচিত।

ভারতের কটকের কেন্দ্রীয় চাল গবেষণাকেন্দ্রের (সিআরআরআই) পরিচালক তপন কুমার আদ্য বলেছেন, এই চাল ঠান্ডা পানিতে ৪৫ মিনিট এবং গরম পানিতে ১৫ মিনিট ভিজিয়ে রাখলেই তৈরি হয়ে যাবে ভাত। অথচ অন্য সব জাতের চাল রান্না করে ভাত তৈরি করতে হয়। এই জাতের বীজ বপন করে ১৪৫ দিনের মধ্যে প্রতি হেক্টরে চার থেকে সাড়ে চার টন ধান উৎপাদন সম্ভব বলেও জানান তিনি।

তিন বছর গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা এই ধান উদ্ভাবন করেছেন। এই ধানের পুষ্টিমান ও জৈব রাসায়নিক প্যারামিটার নিয়েও গবেষণা করেছেন তাঁরা। তপন কুমার বলেন, ‘আমরা আনন্দিত। কারণ, আমাদের পরীক্ষা সফল হয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে এই ধান উত্পাদন করা যাবে।’ তিনি আরও বলেন, নতুন জাতের এই ধান উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। কৃষকেরা এই ধানের বীজ সংগ্রহ করে উত্পাদন শুরু করে দিতে পারেন।

ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশা এবং উপকূলীয় রাজ্য উত্তর প্রদেশে এই জাতের ধান উত্পাদন করা যেতে পারে। তবে ভারতের অন্য অঞ্চলেও এই ধান উত্পাদন সম্ভব। কারণ, এই ধান চাষে প্রায়োগিক কোনো বাধা নেই বলে জানান তপন কুমার।

সিআরআরআইয়ের পরিচালকের মতে, ‘ধানের বহু জাত থাকলেও এখন পর্যন্ত বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এই জাতের ধান উদ্ভাবন হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। মানুষের বাড়িঘরে রান্নার পেছনে কী পরিমাণ জ্বালানি প্রয়োজন, সে ব্যাপারে আমাদের স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। কিন্তু আমরা হলফ করে বলতে পারি, এই জাতের ধান জ্বালানি খরচ কমাবে (অন্তত ভাত রান্নার ক্ষেত্রে)। অন্যদিকে এই জাতের ধান পেয়ে গৃহকর্ত্রীরা ভাত রান্নার ঝামেলা থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন। বাঁচবে সময়ও।’

মূলত, আমন প্রজাতির এই ধানের চাল ঠান্ডা পানিতেই চিড়ার মতো ফুলে উঠবে। ঠিক ফোটানো ভাতের মতো না হলেও এটি এক বিশেষ রকমের ভাত। সবজি, মাছ-মাংস দিয়ে সেভাবে খাওয়া না গেলেও, দই-গুড় দিয়ে অনায়াসেই খেতে পারেন কোমল ভাত।

সিআরআরআইয়ের ভাষ্যমতে, ১০ বছর ধরে নদীয়ার ফুলিয়ায় রাজ্য সরকারের কৃষি প্রশিক্ষণকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা এই নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন। অবশেষে এল এই সাফল্য। এই ধান চাষে রাসায়নিক সারও লাগে না। কীটনাশকেরও প্রয়োজন কম। ফলে লাভের মুখ দেখবেন চাষিরাও। কোমল ধান চাষে উত্সাহ জোগাতে উদ্যোগী ওডিশার রাজ্য সরকার। ফলন বাড়লে ভিন্ন দেশ ও রাজ্যে চাল রপ্তানির ভাবনাও আছে তাদের। এই ধান চাষে প্রায়োগিক কোনো বাধা নেই। ভারতের অন্য অঞ্চলেও এই ধান উত্পাদন সম্ভব।

ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশা এবং উপকূলীয় রাজ্য উত্তর প্রদেশে এই জাতের ধান উত্পাদন করা যাবে। পরীক্ষামূলকভাবে নদীয়ার ফুলিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় কোমল প্রজাতির ধানের চাষ শুরু করেছে ভারতীয় কৃষি অধিদপ্তর। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী বেশ কিছু এলাকাতেও এই ধানের চাষ করা হচ্ছে।

তবে বাংলাদেশি গবেষকেরা বলছেন, আগুনাবিন্নি নতুন কোনো ধান নয়, এটি এই উপমহাদেশেরই ধানের আদিম একটি ভূসম্ভূত (Land Race) জাত। এই ধানের জার্মপ্লাজম আমাদের ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জার্মপ্লাজম সেন্টারে সংরক্ষিত রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এককালে আগুনাবিন্নি ধানের ভাত খেয়েই জীবনধারণ করত আমাদের দেশের উপকূলের মানুষ।

লেখক: ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর

সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া