গোলাপের গন্ধরহস্য

গোলাপের সেই তীব্র সুমিষ্ট সুগন্ধ আজ যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। উদ্ভিদ প্রজননবিদেরা গবেষণা করে ইয়া বড় বড় বিচিত্র রঙের অনেক গোলাপ জাতের সৃষ্টি হয়তো করেছেন, কিন্তু সেই আদি গোলাপের ঘ্রাণটাকে যেন কিছুতেই আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। বুনো গোলাপের সে সুমিষ্ট ঘ্রাণ, তা যেন আজকালকার গোলাপের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। ফিলিপ্পি হুগুয়েনি ফ্রান্সের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চে উদ্ভিদ বায়োকেমিস্ট্রি বিষয়ে কাজ করছেন। তিনি ও তাঁর দল গোলাপের গন্ধ রহস্য উন্মোচনে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, সাধারণত কেউ হাতে একটা গোলাপ পেলেই তার ঘ্রাণ শুঁকতে চায়। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই তারা সে ঘ্রাণ পায় না। গবেষণায় তাঁরা গোলাপ গন্ধের সেই কারণ খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছেন।

গোলাপের বাহারি রং-রূপ বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু মিষ্টি গন্ধ দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফুলের মিষ্টি গন্ধ সৃষ্টির পেছনে রয়েছে এক বিস্ময়কর রহস্য, এক অভিনব হাতিয়ার। সেটি হলো একটি এনজাইম বা উৎসেচক, একটি কর্মঠ অণু, যা ডিএনএকে যথাযথভাবে সাজিয়ে রাখতে সাহায্য করে। এই এনজাইম এখন অনেক গোলাপ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে এখন অনেক গোলাপেই সৌরভ আর আগের মতো পাওয়া যাচ্ছে না।

গোলাপ থেকে গোলাপের মতো সৌরভ সৃষ্টি করে আসলে কিছু রাসায়নিক পদার্থ। তিনি এসব রাসায়নিক পদার্থকে বলছেন মনোটারপিন। সুগন্ধি সব ফুলেই এই মনোটারপিন রয়েছে। তবে তার প্রকৃতি ও পরিমাণ থাকে আলাদা। এই ভিন্নতার কারণেই এক এক ফুলের গন্ধ হয় একেক রকম। মনোটারপিনের এই ভিন্নতা থাকলেও তাদের সবারই কিন্তু কার্বনের ১০টি অণু রয়েছে। গোলাপের এসব রাসায়নিক উপাদান মূলত ফুলেই সীমাবদ্ধ। তবে জানা ছিল না, গোলাপ ফুলে কীভাবে এই উপাদান তৈরি হয় আর কেনই–বা তা কমে যায়, মানে গোলাপ কেন তার গন্ধ হারায়।

আসলে আমরা যখন একটা গোলাপ ফুল নাকের কাছে এনে শুঁকি, তার ঘ্রাণ টের পাই। কিন্তু এই ঘ্রাণটা আসলে কি বস্তু? ঘ্রাণটা সম্পর্কে এত দিন আমরা অনেকেই বিশ্বাস করতাম যে ওটা আসলে কিছু রাসায়নিক পদার্থ বা পদার্থের সমষ্টি। গোলাপ ফুলের পাপড়ির মধ্যে সেসব ঘ্রাণ উদ্রেককারী রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতির কারণেই আমরা তার ঘ্রাণ টের পাই। সেসব রাসায়নিক দ্রব্য গোলাপ ফুল থেকে বাতাসে এসে মিশে বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে গোলাপের চারপাশ সুগন্ধময় করে তোলে। কিন্তু ওই রাসায়নিক পদার্থকে নিয়ন্ত্রণ করে কে? কোন গোলাপ কতটুকু ঘ্রাণ ছড়াবে, সে কথা বলে দেয় কে? গবেষকেরা অবশেষে সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছেন। একদল উদ্ভিদ প্রজননবিদ বলছেন, তাঁরা এ প্রশ্নের উত্তর এত দিনে খুঁজে পেয়েছেন। তাঁরা গোলাপের মধ্যে এমন জিনের সন্ধান পেয়েছেন, যা গোলাপের গন্ধ সৃষ্টিতে সাহায্য করে। গবেষকেরা মনে করছেন, তাঁদের এই আবিষ্কার উদ্ভিদ প্রজননবিদদের আরও বেশি সুগন্ধযুক্ত গোলাপের জাত উদ্ভাবনে সাহায্য করবে, পৃথিবীতে ফিরে আসবে সেই আদি গোলাপের মাতাল করা ঘ্রাণ।

গোলাপের ঘ্রাণ শোঁকার সময় আমাদের নাকের ফুটো দিয়ে হড়হড় করে ঢুকে পড়ে অনেক রাসায়নিক যৌগ। ঘ্রাণ সৃষ্টিকারী এসব যৌগের অধিকাংশ অ্যালকোহলস বা মনোটারপিনস। বর্তমানে অধিকাংশ আধুনিক জাতের গোলাপ বেশি পরিমাণে এই মনোটারপিন যৌগ উত্পাদন করতে পারছে না।

গোলাপ কেন গন্ধ সৃষ্টি করে—এটিও এক বিরাট প্রশ্ন। গোলাপ তো মানুষ চেনে না, মানুষের জন্য সে ঘ্রাণ তৈরি করে না। গোলাপ ঘ্রাণ তৈরি করে তার নিজের দরকারে। ঘ্রাণ শুঁকে তার ফুটন্ত গোলাপে কীটপতঙ্গরা আকৃষ্ট হয়ে ছুটে আসে ও তারা গোলাপের পরাগায়ন ঘটিয়ে ফল এবং বীজ গঠনে সাহায্য করে। পরাগায়ন না হলে অনেক বুনো গোলাপই পৃথিবী থেকে এত দিন বিলুপ্ত হয়ে যেত। রঙিন গোলাপদের কথা না হয় বাদ দিলাম, সেগুলো দিনে ফোটে, পোকারা সেসব গোলাপ দেখতে পায় ও মধুর লোভে তাদের বুকে আছড়ে পড়ে। কিন্তু রাতে ফোটা সাদা গোলাপদের কী করে দেখবে তারা? নিশাচর পতঙ্গরা সেসব গোলাপদের খুঁজে পায় ঘ্রাণের সুবাদে। এই শ্বাশ্বত কথাগুলো এ যুগের প্রজননবিদেরা যেন ভুলে যেতে বসেছিলেন। আসলে এ কালের প্রজননবিদদের দৃষ্টি ছিল গোলাপের বাণিজ্যিক গুরুত্বের দিকে, গোলাপের অস্তিত্ব বা মানুষের আবেগের বিষয়ে প্রজননবিদেরা যেন খানিকটা উদাসীন ছিলেন।

গবেষক ফিলিপ্পি হুগুয়েনি বলেছেন, অধিকাংশ গোলাপ প্রজননবিদদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল কী করে আকর্ষণীয় চেহারার সুন্দর সুন্দর গোলাপের জাত উদ্ভাবন করা যায়, কী করে নীল বা কালো গোলাপ তৈরি করা যায়। কী করে গোলাপকে ফুলদানিতে বেশি দিন তাজা রাখা যায়, কী করে গোলাপগাছ বিভিন্ন রোগ ও পোকা প্রতিরোধ করতে পারে অথবা পরিবহনের সময়ও গোলাপের চেহারা যাতে মলিন না হয়। এসব বিষয়ে বহু গবেষণা করেছেন গবেষকেরা। তাঁরা কেউই গোলাপের সুগন্ধকে গবেষণায় কখনো গুরুত্ব দেননি। এখন গবেষকদের সেই টনক নড়েছে। তাঁরা গোলাপের গন্ধ রহস্য উন্মোচনে নড়েচড়ে বসেছেন। ক্রেতারাও এখন আর শুধু গোলাপের রূপে মুগ্ধ হয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চাইছেন না। অনেকেই এখন চাইছেন, ফুলদানির গোলাপ ঘরের বাতাসকে প্রাকৃতিক সুগন্ধে ভরে তুলুক।

এ জন্য গবেষক প্রজননবিদেরা এখন উঠেপড়ে লেগেছেন গোলাপের সেই রহস্য উদ্‌ঘাটনে, তাঁদের খুঁজে দেখতে হচ্ছে গোলাপের গন্ধের জন্য আসলে দায়ী কী? গবেষকেরা জানতেন না যে গোলাপের গন্ধ সৃষ্টিকারী মনোটারপিনের পেছনে আসলে কী কাজ করছে? এ জন্য একদল গবেষক গোলাপের জেনোম রহস্য জানার চেষ্টা করেছেন। গবেষণার জন্য গোলাপের সবচেয়ে বেশি ঘ্রাণ সুগন্ধি পাপা মিলান্দ ও সবচেয়ে ঘ্রাণের রুগ মিলান্দ জাতকে বেছে নিয়েছিলেন। রম্নগ মিলান্দ ছিল আসলে গন্ধহীন গোলাপ। এ দুটি জাতের জেনোম রহস্য উন্মোচন করেন তাঁরা। অবশেষে তাঁরা জানতে সক্ষম হন যে কেন একটি জাতের গোলাপের এত ঘ্রাণ আর অন্যটিতে তা বিন্দুমাত্র নেই। তাঁরা ঘ্রাণের এই পার্থক্যের কারণ হিসেবে খুঁজে পেয়েছেন একটি জিনকে। তার নাম দিয়েছেন RhNUDX1. পরবর্তী সময়ে তাঁরা গোলাপের আরও ১০টি জাত নিয়ে একইভাবে গবেষণা করে এ বিষয়ে আশ্বস্ত হয়েছেন যে এই জিনই মনোটারপিন নামক রাসায়নিক যৌগ উত্পাদনকে নিয়ন্ত্রণ করে। বেশি মনোটারপিন মানেই বেশি ঘ্রাণ। গোলাপ মনোটারপিন তৈরি করতে RhNUDX1 এনজাইমকে ব্যবহার করে, যাকে বলা হয় জেরানিওল। গবেষকেরা দেখেছেন, এই জেরানিওল এনজাইম হলো গোলাপের গন্ধ সৃষ্টি করার মূল উপাদান, যা মনোটারপিনকে নিয়ন্ত্রণ করে।

বিজ্ঞানীদের এই নতুন আবিষ্কার গোলাপের সুগন্ধ সমস্যা সমাধানে সাহায্য করতে পারবে। গবেষক ফিলিপ্পি হুগুয়েনি ও তাঁর সাথিরা আশা করছেন, তাঁদের এই আবিষ্কারের ফলে গোলাপের আদি ঘ্রাণকে আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। যেসব গোলাপে কোনো গন্ধ নেই, সেসব গোলাপেও RhNUDX1 জিন রয়েছে। কিন্তু সেসব গোলাপে এই জিন রয়েছে অকার্যকর বা নিষ্ক্রিয়। গবেষণার মাধ্যমে সুপ্ত বা নিষ্ক্রিয় এই জিনকে সক্রিয় করা সম্ভব হলেই গোলাপ ফিরে পাবে তার আদি ঘ্রাণ। এই জিনকে সক্রিয় করতে তা গোলাপের অন্য কোনো বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সংঘর্ষ করবে না বলেও তাঁরা দাবি করেছেন। তাঁরা বলেছেন, এই জিনকে সক্রিয় করলেও তা গোলাপের ফুলদানিতে সতেজ থাকার কাল বা রঙের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে না। তাঁরা এসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কোনোরূপ কৌলিতাত্ত্বিক সংযোগ বা সংঘর্ষ দেখতে পাননি। তবে তাঁরা এ বিষয়ে ভবিষ্যতে আরও গভীর গবেষণার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। বলেছেন, বিজ্ঞানীরা চাইলে ভবিষ্যতে জিএমও (জেনেটিক্যালি মডিফায়েড অরগানিজম) গোলাপও সৃষ্টি করতে পারেন। অধিক গন্ধ সৃষ্টিকারী জাতের গোলাপ থেকে বাণিজ্যিকভাবে হয়তো গোলাপ তেল উত্পাদন লাভজনক হতে পারে, যা বিভিন্ন প্রসাধন সামগ্রীতে ব্যবহার করা যাবে।

লেখক: কৃষিবিদ ও প্রকল্প পরিচালক, আইএফএমসি-২ প্রকল্প, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, ঢাকা

সূত্র: সায়েন্স নিউজ ফর স্টুডেন্টস (২৮ এপ্রিল ২০১৫), ডিসকভার ম্যাগাজিন (৩ জুলাই ২০১৫)