নীল তিমি সম্পর্কে ১০ মজার তথ্য

রহস্যময়, বিশাল, সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের জন্য অত্যাবশ্যক—সবগুলো বৈশিষ্ট্যই নীল তিমির। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই প্রাণী দেখতে মাছের মতো হলেও একে মাছ বলে ভুল করবেন না। এরা আসলে স্তন্যপায়ী প্রাণী। বাচ্চা জন্ম দেয় এবং বাচ্চাকে দুধ খাওয়ায়। হাজার বছর ধরে এরা পৃথিবীতে টিকে আছে। বিশালাকার এই নীল তিমির ১০টি চমৎকার তথ্য জানা যাক।

১০০ ফুটের বেশি লম্বা

বিশালাকার নীল তিমির দৈর্ঘ্য সাধারণত ৮০ থেকে ১০০ ফুট। পুরুষ তিমির তুলনায় মহিলা তিমি বেশি বড় হয়। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় তিমির দৈর্ঘ্য রেকর্ড করা হয়েছে ১০৮ ফুট। পরপর ৩টা স্কুল বাস সাজিয়ে রাখলে যতটা লম্বা হবে, এই তিমির আকার ততটা।

৩০টি হাতির ওজনের সমান

নীল তিমির ওজন সাধারণত ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ ৩৬ হাজার কেজি পর্যন্ত হতে পারে। অর্থাৎ প্রায় ১০০-১৫০ টন। তবে সমুদ্রে কিছু বড় আকারের নীল তিমি রয়েছে, সেগুলোর ওজন প্রায় ২ লাখ কেজি বা ২২০ টন হতে পারে। কিন্তু এই ওজন আসলে কতটা? প্রথমে হাতির সঙ্গে তুলনা করা যাক। অন্তত ৩০টা হাতির ওজনের সমান হতে পারে একটা নীল তিমির ওজন। যদিও তাতেও বুঝতে সমস্যা হয়, তাহলে মানুষের সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। প্রায় আড়াই হাজার পূর্ণবয়স্ক মানুষের ওজন যা হবে, একটা নীল তিমির ওজন তাই। ওদের জিহ্বার ওজনই হবে একটা হাতির ওজনের সমান। ভাবা যায়!

গাড়ির ওজনের সমান হৃৎপিণ্ড

ছবি: ন্যাশনাল জিওগ্রাফি

এত বড় তিমির হৃৎপিণ্ডটাও যে বড় হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কত বড়? লম্বা প্রায় একটা একজন কিশোরের সমান, ৪ ফুট। ওজন হবে প্রায় একটা গাড়ির সমান। ৪০০-৬০০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। এমন বড় আকারের হৃৎপিণ্ড মিনিটে মাত্র ২-১০ বার ধুকপুক করতে পারে। ডাইভ দেওয়ার সময় এদের হার্টবিট কমে যায় আরও, মাত্র ২ বার। হৃৎপিণ্ডে রক্ত প্রবাহের ধমনীও কিন্তু অনেক বড়। এদের প্রধান ধমনীর মধ্য দিয়ে আপনি হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতে পারবেন অনায়েসে। 

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাচ্চার জন্ম দেয়

নীল তিমিই সবচেয়ে বড় বাচ্চা জন্ম দেয়। জন্মের সময় একটা বাচ্চার দৈর্ঘ্য হয় প্রায় ২৬ ফুট। মোটামুটি ৪ জন পূর্ণবয়স্ক পুরুষ পরপর শুয়ে থাকলে যতটা লম্বা দেখাবে, ততটা লম্বা হয়ে জন্মে একটা তিমির বাচ্চা। ওজন হয় প্রায় ৪ হাজার কেজি। একটা গাড়ির ওজনের সমান। জন্মের পর থেকে প্রতিদিন প্রায় ৯০ কেজি করে এদের ওজন বাড়ে। সম্ভবত প্রাণিজগতের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত এদের ওজন বাড়ে। জন্মের দিনের তুলনায় দেড় বছরের মধ্যে এদের শরীরে কয়েকশ কোটি গুণ টিস্যু বৃদ্ধি পায়। 

অস্বাভাবিক জোরে শব্দ করতে পারে

তিমির চেয়ে জোরে শব্দ করার মতো প্রাণী পৃথিবীতে নেই। একটা জেট ইঞ্জিন ১৪০ ডেসিবল পর্যন্ত শব্দ উৎপন্ন করতে পারে। নীল তিমি শব্দ করতে পারে প্রায় ১৮৮ ডেসিবল পর্যন্ত। ডেসিবল হলো শব্দের তীব্রতা পরিমাপের একক। মানুষ সর্বোচ্চ ১২০ ডেসিবল পর্যন্ত শব্দ শুনতে পায়। এ শব্দ আমাদের পক্ষে শোনা সম্ভব নয়। তিমিরা প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার দূর থেকেই এই শব্দ শুনতে পায়। তবে কীভাবে তিমি এত উচ্চস্বরে ডাকতে পারে, তা এখনো জানেন না বিজ্ঞানীরাও। 

এরা পেটুক প্রাণী

নীল তিমি ক্রিল নামে একধরনের সামুদ্রিক প্রাণী খায়। ক্রিল হলো চিংড়ির মতো দেখতে ছোট ছোট প্রাণী। এগুলো পানির তলদেশে ঝাঁক বেঁধে থাকে। তিমি সেই ঝাঁকে গিয়ে আক্রমণ করে। প্রতিদিন একটা তিমি প্রায় ৪ হাজার কেজি ক্রিল খায়। এদের খাওয়ার পদ্ধতিটা একটু অদ্ভুত। তিমি চাইলেই বড় মাছ যেমন হাঙর বা সেলফিশ খেতে পারে না। এদের মুখে জালের মতো একটা জিনিস থাকে যা বেলিন প্লেট নামে পরিচিত। এটা জালের মতোই কাজ করে। যেখানে ক্রিল আছে সেই অঞ্চলে গিয়ে নীল তিমি একসঙ্গে অনেক পানি মুখে পুড়ে নেয়। সেখান থেকে ক্রিলগুলো ওদের জালে আটকে পড়ে, আর মুখের পানিগুলো পরে বের করে দেয়। একবারে প্রায় ৯০-১০০ কেজি ক্রিল ধরতে পারে একটা নীল তিমি। সাধারণত খাবার খাওয়ার সময় এরা সমুদ্রের এমন জায়গায় যায় যেখানে প্রচুর ক্রিল পাওয়া যায়। এমন অঞ্চলকে বলে ফিডিং গ্রাউন্ড। এসব অঞ্চলে প্রতি ঘন মিটার পানিতে প্রায় ১০ হাজার ক্রিল পাওয়া যায়। একটা তিমির প্রতিদিন প্রায় ৪ লাখ ক্রিল খেতে হয়।

বেশ দ্রুত ছুটতে পারে

সাধারণত নীল তিমি ধীরে চলতে পছন্দ করে। ঘণ্টায় ৮ কিলোমিটার গতিতে এরা সাঁতার কাটে, মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াত সমুদ্রে। কিন্তু বিপদে পড়লে বা উত্তেজিত হলে ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার গতিতেও সাঁতার কাটতে পারে। তবে এমন গতিতে বেশি সময় ছুটতে পারে না। কারণ ওদের ওই বড় শরীর। তবে ধীর গতিতে সাঁতার কাটতে এরা খুবই দক্ষ। 

১০০ বছরের বেশি বাঁচে

নীল তিমি দীর্ঘজীবী প্রাণী। গড়ে ৮০-৯০ বছর পর্যন্ত বাঁচে এরা। তবে কিছু নীল তিমির ১০০ বছরের বেশি বাঁচার রেকর্ড রয়েছে। এদের বয়স নির্ধারণের জন্য বিজ্ঞানীরা কানের মোমের স্তর পরীক্ষা করেন। এই মোমের স্তর প্রতিবছর একটা করে বাড়ে। সেগুলো হিসাব করেই তিমির বয়স নির্ধারণ করা যায়। তবে ওদের দাঁত পরীক্ষা করেও বিজ্ঞানীরা বয়স নির্ধারণ করতে পারেন। 

জেগে থেকেই ঘুমায়

নীল তিমি কখনও পুরোপুরি ঘুমাতে পারে না। মানে আমরা যেমন ঘুমিয়ে পড়লে আর কোনো কিছু সম্পর্কে ধারণা রাখি না, শুধু শান্তিতে ঘুমাই, তিমিরা তা করতে পারে না। ওরা যখন ঘুমায়, তখনও অন্তত মস্তিষ্কের অর্ধেক জেগে থাকে। এরা যদি পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়ে এবং ঘুমটা বেশ গাঢ় হয়, তাহলে সময় মতো ঘুম ভাঙবে না। আর তাতেই দম আটকে মারা যেতে পারে। তাই তিমিরা কোনো রিস্ক নেয় না। সবসময় সজাগ রাখে মস্তিষ্কের একাংশ। এ কারণেই বলা হয়, তিমি জেগে জেগে ঘুমায়।

বিপন্ন হতে পারে নীল তিমি!

অতীতে পৃথিবীতে প্রচুর নীল তিমি ছিল। তবে এখন সংখ্যাটা ক্রমশ কমছে। এর বড় কারণ, মানুষ তিমির তেল নিয়ে বাণিজ্য করছে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের মতে, ১৯০৪-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে সাড়ে তিন লাখের বেশি নীল তিমি হত্যা করা হয়েছে। ১৯৩১ সালে শুধু এক বছরে ২৯ হাজার তিমি শিকার করা হয়। বিভিন্ন দেশে আইন করে তিমি শিকার বন্ধ করা হয়েছে। তবুও চোরাচালানকারী ও অসাধু জেলেদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না অতিকায় এই বড় প্রাণী। অচিরেই তিমি হত্যা বন্ধ করতে হবে, নয়তো একদিন পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে সবচেয়ে বড় এই প্রাণী।

সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, ট্রিহাগার ডটকম ও ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড ফান্ড ডটঅর্গ