প্লেটে সাজানো ছোট মস্তিষ্ক

মস্তিষ্কের মতো সংবেদী অঙ্গ শরীরে আর একটাও আছে কি না, সন্দেহ। এর সুরক্ষার জন্যও রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। বাইরের কোনো রকম ক্ষতিকর পদার্থ, তা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, মস্তিষ্কের ব্লাড-ব্রেন ব্যারিয়ার ভেদ করে ভেতরে ঢুকতে পারে না। তারপরও অ্যালঝেইমার, সিজোফ্রেনিয়া বা অটিজমের মতো অসুখে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেন এ রকম হয়? এত কঠিন সুরক্ষাচক্র ভেদ করার পথটাই–বা কী? বিজ্ঞানীরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলছেন এখনো। উত্তরগুলো জানতে হলে মস্তিষ্ককে করোটি থেকে ল্যাবের পেট্রি ডিশে নিয়ে আসতে হবে। কাজটা অবশ্যই খুব জটিল। ইঁদুর বা অন্য মডেল প্রাণীর মস্তিষ্কের ওপর গবেষণা করে মানুষের মস্তিষ্ককে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে ইঁদুরের মস্তিষ্কের সঙ্গে বুদ্ধিমান মানুষের মস্তিষ্কের মিল খুঁজে বেড়ানো খুব কাজের কথা নয়। তাই বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য এখন কৃত্রিম মস্তিষ্কের দিকে। সেই মস্তিষ্কের কথাই আজ বলব।

গবেষণাগারের ডেস্কের ওপর রাখা ডিশে সাজানো আছে মানুষের মস্তিষ্ক। এমন দৃশ্য কেবল সায়েন্স ফিকশনের ক্ষেত্রেই কল্পনা করা সম্ভব। তবে স্বপ্নচারী বিজ্ঞানীরা কল্পনাকেই বাস্তবে রূপ দিয়ে ফেলেছেন। অবশ্য খুব বুঝেশুনে বা সজ্ঞানে তাঁরা এমন মস্তিষ্ক বানিয়েছেন, তা কিন্তু নয়। নিতান্তই দুর্ঘটনাবশত জন্ম নিয়েছে এমন কাল্পনিক মস্তিষ্ক। যাঁর হাতে ঘটেছে এই দুর্ঘটনা, সেই ম্যাডলাইন ল্যানকাস্টারের কাছেও এমন মস্তিষ্ক বাস্তবে জন্মানোর চেষ্টা করা ছিল পাগলের বিলাপের মতোই। ল্যানকাস্টার এখন নিউরোবায়োলজিস্ট হিসেবে কাজ করছেন কেমব্রিজের এমআরসি ল্যাবরেটরি অব মলিকুলার বায়োলজিতে। পোস্টডক গবেষক থাকার সময় ভিয়েনাতে তিনি মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তিনি দেখতে চাইছিলেন মানবগর্ভে কীভাবে মস্তিষ্ক বেড়ে ওঠে। সে জন্য একটা ডিশে মস্তিষ্কের স্টেমকোষ জন্মানোর চেষ্টা করছিলেন।

সমতল ডিশে বেড়ে ওঠা মস্তিষ্ক নিয়ে তিনি ছিলেন অসন্তুষ্ট। কারণ, আসল মস্তিষ্কের নার্ভকোষের সঙ্গে এর কোনো মিলই ছিল না। আরেকটু উন্নত পদ্ধতি অনুসরণ করলেন তিনি। যেখানে মস্তিষ্ক সমতলভাবে বেড়ে ওঠে না, বরং গোলাপের মতো ফুলের আকারে বেড়ে ওঠে। এতে মোটামুটি ভালোভাবে দ্বিমাত্রিক মস্তিষ্ক পর্যবেক্ষণ করা যায়। কিন্তু একপর্যায়ে ল্যানকাস্টার দেখলেন সাধারণভাবে মস্তিষ্কের গঠন হচ্ছে না, বলের মতো কেমন অদ্ভুত গঠন তৈরি হচ্ছে। তিনি ধারণা করলেন, তাঁর রি–এজেন্ট যোগ করাতে হয়তো কোনো ভুল হয়েছে। বিষয়টা নিয়ে তিনি অন্যান্য গবেষকের সঙ্গে আলোচনা করলেন। অনেকেই বললেন যে তাঁরাও ল্যানকাস্টারের মতো এমন অদ্ভুত মস্তিষ্কের গঠন পেয়েছেন তাঁদের পেট্রিডিশে। অকেজো বলে তা ফেলেও দিয়েছেন তাঁরা, কিন্তু ল্যানকাস্টার সেই অকেজো মস্তিষ্ককে না ফেলে দিয়ে আরও কিছুদিন কালচার করলেন। এরপরই তিনি দেখতে পেলেন ম্যাজিক। বাইরে যতই অসম আকৃতি হোক না কেন, সেই কৃত্রিম মস্তিষ্কের ভেতরের অংশ মানুষের আসল মস্তিষ্কের মতোই। স্তরে স্তরে নিউরনের সংযোগগুলো ঠিক যেন সত্যিকারের ব্রেন! ল্যানকাস্টার আবিষ্কার করলেন, এই অকেজো মস্তিষ্কের ভেতর থেকেই জানা যাবে মানবগর্ভে বেড়ে ওঠা মস্তিষ্কের স্বরূপ।

পেট্রিডিশে জন্মানো এই ছোট বা মিনি মস্তিষ্ক মাত্র আধা সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধের একটি গোলক। তুলনা করলে বলা যায়, একটি কাঠপেনসিলের মাথায় লাগানো ছোট ইরেজারের সমান! আসল মস্তিষ্কের মতো এতে নেই কোনো রক্তনালি, তাই আকারে এর থেকে বড় হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সাধারণ মস্তিষ্কের তুলনায় একটু শক্ত প্রকৃতির। জীবাণুমুক্ত পরিবেশে জন্মানোর ব্যবস্থা করলে এই ব্রেন এক বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। এত সীমাবদ্ধতা থাকার পরও এই কৃত্রিম মস্তিষ্ক এখন নিউরোবিজ্ঞানীদের কাছে আরাধ্য বস্তু। কারণ, এর আগে প্লেটে জন্মানো আর কোনো মস্তিষ্কই আসল মস্তিষ্কের এতটা কাছাকাছি বৈশিষ্ট্য দেখাতে পারেনি। আগে ছোট বাচ্চাদের ব্রেনে এমআরআই স্ক্যানিং করে দেখার ব্যবস্থা করা হতো যে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলো জটিল সংযোগ স্থাপন করে। কিন্তু শিশু জন্মানোর আগে, মানে মাতৃগর্ভে শিশুর মস্তিষ্কের গঠনপ্রকৃতি বোঝার কোনো উপায় জানা ছিল না। ল্যানকাস্টারের এই কৃত্রিম মস্তিষ্ক, মানুষের ব্রেন ডেভেলপমেন্টের অনেক মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

শুধু সুস্থ মস্তিষ্কই নয়, মানসিক অনেক অসুখ, যেমন অটিজম, সিজোফ্রেনিয়া, এপিলেপসির মতো রোগে মস্তিষ্কের গতিবিধি পরীক্ষা করা যাবে এই কৃত্রিম মস্তিষ্কের সাহায্য নিয়ে, এমনটাই আশা করছেন ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক সারগিউ পাস্কা। বিভিন্ন মানসিক সমস্যার ওষুধগুলো আবিষ্কার হয়েছে আকস্মিকভাবে। মস্তিষ্কের ভেতরে এগুলো কীভাবে কাজ করে, সেটা আজও অজানা। ক্যানসার গবেষকেরা যেমন রোগীর দেহ থেকে টিউমার সার্জারি করে সহজে প্লেটে রেখে গবেষণা করতে পারেন, মস্তিষ্কের অসুখে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে এটা করা অসম্ভব। পাস্কা তাই আস্থা রাখছেন ল্যানকাস্টারের কৃত্রিম মস্তিষ্কের ওপরই। পাস্কা এটাকে আরও উন্নত করার চেষ্টা করছেন। তিনি এই মিনি ব্রেনকে ২ বছর ৮০০ দিন ধরে কালচার করে রেকর্ড গড়েছেন।

পাস্কা ও তাঁর দল এপিলেপসি বা অটিজমের মতো অসুখের ক্ষেত্রে গবেষণায় এই মিনি ব্রেন ব্যবহার করছেন। তাঁরা রোগাক্রান্ত শিশুদের ত্বকের কোষ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে আইপিএস (ইনডিউসড প্লুরিপটেন্ট স্টেম সেল) কোষের মাধ্যমে প্লেটে তৈরি করছেন মিনি ব্রেন। এরপর সুস্থ মিনি ব্রেনের সঙ্গে মিলিয়ে দেখছেন। ইলেকট্রোড ব্যবহার করে কোষের পারস্পরিক সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে। মাইক্রোস্কোপির সাহায্যে স্নায়ুকোষের গতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া এমন মস্তিষ্কের সমস্যার কারণে সৃষ্ট রোগে বিভিন্ন জিনের প্রকাশ নির্দিষ্ট করে ব্যাখ্যা করতে মিনি ব্রেন পাস্কা ও তাঁর দলকে সাহায্য করছে। তাঁরা আরও বিস্তারিত গবেষণার জন্য কয়েকটা মিনি ব্রেনকে জোড়া দিয়ে তাঁদের কার্যক্রম পরীক্ষা করে দেখছেন। ব্যাপারটা অনেকটা বাচ্চা লেগো মেলানোর মতো। আমাদের আসল মস্তিষ্ক নিজেও এমন কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। জোড়া লাগানো এই মিনি ব্রেনের মধ্যে স্নায়ুকোষগুলো চলাফেরা করে আর সংযোগ স্থাপন করে।

পাস্কা মূলত দেখতে চেয়েছেন কিছু ইনহিবিটরি বা দমনমূলক স্নায়ুর গতিপ্রকৃতি। এবং তিনি বেশ কিছু আকর্ষণীয় জিনিস দেখতে পেয়েছেন। যেসব রোগী অটিজমে আক্রান্ত আর একই সঙ্গে মৃগীরোগ রয়েছে, তাদের ইনহিবিটরি স্নায়ু মিনি ব্রেনের ভেতর যত্রতত্র ছোটাছুটি করে। তারা ভুলপথে যাতায়াত করে বলে সঠিক সংযোগ স্থাপন করতে পারে না। পাস্কা এদের ঠিক পথে আনার জন্য ওষুধেরও সন্ধান পেয়েছেন। সেই ওষুধ প্রয়োগের ফলে স্নায়ুগুলো সঠিক পথে ভ্রমণ করে ঠিক সুস্থ মস্তিষ্কের মতোই। তাই আশা করা যায়, অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় এই ওষুধ বেশ ভালো ফল বয়ে আনবে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান কিন্তু সেই মিনি মস্তিষ্কের, যার মাধ্যমে প্লেটে রেখেই সম্ভব হয়েছে ব্রেন নিয়ে বিশদ গবেষণা।

মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করছেন এমন আরেকজন হলেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের নিউরোলজিস্ট সেলিনা রে। তাঁর কাজটা অবশ্য কিছুটা ভিন্নধর্মী ছিল।

এতক্ষণ যাঁদের কাজ সম্পর্কে জানলাম, তাঁরা মানুষের জন্মের আগে বা শিশু বয়সের মস্তিষ্কের গঠন নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। সেলিনা আবার কাজ করতেন রোগীর মৃত্যুর পর তাদের পোস্টমর্টেম করা ব্রেন টিস্যু নিয়ে। এতে অবশ্য সেলিনা বেশি খুশি ছিলেন না। কারণ, তাঁর কাছে ব্যাপারটা চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ার মতো মনে হতো। আলঝেইমার বা ডিমেনশিয়া রোগীর শেষ পর্যায়ে ব্রেনের অবস্থা হয়তো বোঝা যেত, কিন্তু কীভাবে বা কোথা থেকে এ রোগের উৎপত্তি হলো, তা বোঝার জন্য অবশ্যই সেলিনার দরকার শুরু থেকে পর্যবেক্ষণ করা। ল্যানকাস্টার বা পাস্কার মতো সেলিনা ডিমেনশিয়া রোগীর ত্বকের কোষকে স্টেমকোষে পরিণত করে সেখান থেকে প্লেটে তৈরি করলেন মিনি ব্রেন। কয়েক মাসের মধ্যে দেখতে পেলেন, সাধারণ মিনি ব্রেন থেকে বেশ কিছু উপাদান বেশি পরিমাণে তৈরি হচ্ছে, যা রোগ সৃষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত। অবশ্য এখানেও অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। মিনি ব্রেনের জীবনকাল বেশ সংক্ষিপ্ত। অন্যদিকে ডিমেনশিয়ার মতো রোগ তৈরি হতে লেগে যায় বছরের পর বছর।

এ ধরনের রোগ নিয়ে গবেষণার জন্য মিনি ব্রেনের বয়স বাড়িয়ে দিতে হবে কয়েক গুণ। যাতে বুড়ো বয়সের ব্রেনের মতো আচরণ করতে পারে। এর জন্য প্রজেরিয়ার (দ্রুত বুড়িয়ে যায় যে রোগের কারণে) জিনকে কাজে লাগিয়ে মিনি ব্রেনের বয়স বাড়ানোর কথা ভাবা হচ্ছে। বিকল্প ভাবনাও আছে। মিনি ব্রেনকে সাধারণ মস্তিষ্কের মতো দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য টেলোমিয়ার দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন করার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। সেলিনা রে এই কৃত্রিম মিনি ব্রেন নিয়ে বেশ আশাবাদী। পারসোনালাইজড বা ব্যক্তিগত মেডিসিনের ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে সাহায্য করবে এই মিনি ব্রেন, এমনটাই আশা করছেন সেলিনা। ক্যানসার বায়োলজিতে যেমন টিউমার পর্যবেক্ষণ করে ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে হয়তো মস্তিষ্কের অসুখে, রোগীর ত্বকের কোষ থেকে স্টেমকোষের মাধ্যমে প্লেটে জন্মানো মিনি ব্রেন পর্যবেক্ষণ করে নির্দিষ্ট চিকিৎসা করা যাবে। তাই প্লেটে সাজানো ছোট মস্তিষ্ক এখন বিজ্ঞানীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।

লেখক: শিক্ষার্থী, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়