ফটিকজলের শিস

সফেদাগাছের পাতার ছাতার তলার সরু ডালে বুক-পেট মিশিয়ে ডাকছে হলদে রঙের ছোট পাখিটি। মনের মাধুরী মিশিয়ে ওটা থেমে থেমে একটানা গেয়ে চলেছে ডিম পাড়ার গান। গানের ভাষাটা হলো চিরি চিরি, ঝিরি ঝিরি, ছিরি ছিরি। টানা প্রায় ৩০ সেকেন্ড পর গানটা শেষ করছে হুইসেলের মতো মিষ্টি একটা শব্দ তুলে। আবার শুরু করছে গোড়া থেকে। গানটা তার শুরু হয়েছে দিন দশেক আগে থেকে। বাসায় ইতিমধ্যে ডিমও পেড়েছে একটি। সেই ডিমে বসে এখন তা দিচ্ছে তার স্বামী। তবু ডিম পাড়ার গান সে চালিয়ে যাবে আরও দু-তিনটি ডিম না পাড়া পর্যন্ত। মেহগনিগাছের খাড়া সরু তিনখানা ডালের সংগমস্থলে ছোট গোলগাল পরিপাটি বাটির মতো কী সুন্দর বাসাটি যে গড়েছে দুজনে মিলে! বাসার উপকরণ হলো মরা কলাগাছের সুতোর মতো আঁশ, বাঁশের সরু শিকড়, সরু ঘাস-লতা, মাকড়সার জাল ইত্যাদি। তার আগে বাসা নির্বাচনের জায়গা পছন্দ করতে দুজনে ব্যয় করেছিল তিন-চার দিন। বাসা বাঁধার ফাঁকে ফাঁকে স্বামী-স্ত্রী প্রচুর নৃত্যগীত করেছে গাছের ডালে ডালে, তালে তালে। বাসাটি তৈরি করতে সময় লেগেছে পাঁচ-ছয় দিন। বাসা বাঁধার মৌসুম এদের বসন্ত থেকে শরৎ। ডিমে দুজনে পালা করে তা দেবে ১৪ থেকে ১৮ দিন। তারপর ফুটবে ফুটফুটে-টকটকে হলুদ রঙের তিন–চারটি ছানা। মা–বাবা মিলে পাল্লা দিয়ে ছানাদের খাওয়াবে। ছানারা উড়তে শিখবে ১৯ থেকে ২০ দিনে। হায় রে ছানারা! যেনবা গোলগাল হলুদ রঙের পিংপং বল! ছানারা বসবে আশপাশের ডালে—পাশাপাশি লাগালাগি হয়ে। লেজ তো তখন নেই! গজায়নি। তা–ও নজরে পড়তে চায় না সহজে, তিন-চারটি ছানাকে মাঝখানে রেখে দুই পাশে বাবা ও মা যখন বসে পাশাপাশি গায়ে গা মিশিয়ে—হয় বিশ্রাম করতে, না হয় রাতের আশ্রয়ের জন্য। রাতে ওরা ঘাড় ঘুরিয়ে ঠোঁট পিঠে গুঁজে ঘুমায় যখন, তখনকার সৌন্দর্য অবর্ণনীয়। এই ছানাদের শত্রু হলো গেছো সাপ, গেছো ইঁদুর, কাক, হাঁড়িচাঁচা পাখিরা।

এতক্ষণে স্ত্রী পাখিটি ডিম পাড়ার গান থামায়। উঠে দাঁড়ায়। তারপর শরীরের পালক ফুলিয়ে-দুলিয়ে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে যেন শরীরের ক্লান্তি-শ্রান্তি দূর করে। তারপর পাশের গাছে খায় গিয়ে কিছু খাবার। ঝুলন্ত-দুলন্ত একখানা পেয়ারার ডালে গিয়ে উপুড় হয়ে ঝুলে-দুলে পাতার তলার সাদা আবরণে ঢাকা শুঁয়োপোকা আর লার্ভা খায়। তারপর নিচের দিকে উড়ে নেমে সাবধানী কুশলতায় মাকড়সার জালে জড়ানো মাকড়সার খোলসবদ্ধ ডিম খায়। তখন দক্ষ অ্যাক্রোব্যাটদের মতো লাগে পাখিটিকে। হলদে এই পাখি লতা ও গাছের শীর্ষদেশে ঝুলে–দুলে প্রায়ই চমত্কার অ্যাক্রোব্যাটিক শো প্রদর্শন করে। এরা মাকড়সাকেও পাকড়াও করে জাল থেকেই। খাওয়া শেষ করে মেয়েটি উড়ে গিয়ে বসে বাসার পাশে। পুরুষ পাখিটি ‘ফটিকজল ফটিকজল’ ডাক ছেড়ে বউকে স্বাগত জানায়। তারপর বাসা ছাড়ে। স্ত্রীটি বাসায় বসে যায় ডিমে তা দিতে। হয়তোবা দ্বিতীয় ডিমটা সে আজই পাড়বে!

অতি নিরীহ হলুদ সুন্দর এই পাখির নাম ফটিকজল। তৌফিক নামেও পরিচিত। বাগেরহাট অঞ্চলে এরা হলদে টুনি, জলফুটি ও পরানপাখি নামে পরিচিত। ঢাকা শহরসহ সারা দেশেই আছে এরা। প্রজনন মৌসুমে পুরুষটির চিবুক, থুতনি, কানপট্টি ও বুক, পেটের দুই পাশসহ বুক এবং পেট চকচকে হলুদ। পিঠ তথা ডানা ও কপাল সবুজ, ঘাড় ও পিঠে অবশ্য সোনালি হলুদের একটা আভা ঝিলমিল করে। ডানার ওপর গোলগোল সাদা রঙের ছোপ আছে, আছে রেখা। পা ও ঠোঁট নীলচে সবুজ। অন্য সময়ে মেয়ে ও পুরুষ পাখি প্রায় একই রকম হয় দেখতে।

মূল খাদ্য এদের মাকড়সা ও মাকড়সার ডিম, বাচ্চাসহ নানান রকমের পোকামাকড়, ফুলের মধু, রেণু। তাল ও খেজুরের রস পান করে। পান করে টলটলে শিশিরকণা। তাই বুঝি গলাটা ওদের এতটা মিষ্টি, সুরেলা। মাঝেমধ্যে শিশিরস্নানও করে। প্রতি ভোরে পাতার আড়ালে বসে সুরেলা শিস বাজায়, বাজায় বুক হিম করা হুইসেল। আমি একবার পাখিখেকো একটি তুরমতি বাজকে একটি উড়ন্ত ফটিকজলকে হিট করতে দেখেছিলাম। কিছু পালক খসে গিয়েছিল দখিনা বাতাসে তখন, যেন ভেসে বেড়াচ্ছিল গুচ্ছ গাঁদা ফুলের পাপড়ি। প্রচণ্ড বৃষ্টি ও শিলাপাতের সময় এরা কলাপাতা, মানকচুর পাতা ও সেগুনপাতার ছাতার তলায় আশ্রয় নেয়।

ফটিকজলের ইংরেজি নাম কমন আয়োরা। বৈজ্ঞানিক নাম Aegithina tiphia.

লেখক: পাখিবিশারদ