একজন মানুষ জীবনের এক–তৃতীয়াংশ সময় ঘুমিয়েই কাটায়। বেঁচে থাকার জন্য খাবারের মতো ঘুমও গুরুত্বপূর্ণ। প্রাণিজগতের সবাই ঘুমায়। একেক প্রজাতির ঘুমের ধরন ও সময়কাল একেক রকম। এমনকি মানুষের জীবনেও একেক পর্যায়ে ঘুমের প্রয়োজনীয়তা একেক রকম। নবজাতকেরা দিনে ১৮ ঘণ্টার বেশি ঘুমিয়ে কাটায়, আবার বৃদ্ধদের পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টার বেশি ঘুমানোর দরকার পড়ে না।
ঘুম নিয়ে মানুষের আগ্রহ প্রাচীন। খ্রিষ্টের জন্মের ৪৫০ বছর আগে গ্রিক চিকিৎসক আলকেমিওন প্রথম বর্ণনা করেন ঘুম কী। তিনি বলেন, ঘুম হলো মানুষের অচেতনতার একটি পর্যায়, যখন মস্তিষ্কে রক্তপ্রবাহ কমে যায়। ঘুমের সময় শরীরের তাপমাত্রাও যে কমে, সেটাও তিনি লক্ষ করেছিলেন। এর ৫০ বছর পর অ্যারিস্টটলও ঘুমের ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেন। তিনি অবশ্য হৃদ্যন্ত্র আর পরিপাকতন্ত্রের কার্যক্রমকে ঘুমের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে মস্তিষ্কের নিউরন বা স্নায়ুকোষ এবং এর কাজ সম্পর্কে ব্যাপক ধারণা লাভ করতে থাকেন বিজ্ঞানীরা। মজার বিষয় হলো, ঘুমের ফিজিওলজি বা সারকাডিয়ান রিদম সম্পর্কে পুরোপুরি জানার আগেই পৃথিবীতে প্রথম ঘুমের ওষুধ আবিষ্কার করা হয়ে যায় ১৯৩০ সালে—বারবিটাল বা বারবিচুরেট। ৩০ বছরের মধ্যে বারবিচুরেট যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে ব্যবহৃত ‘আসক্তিকর’ বা অ্যাবিউজড ওষুধে পরিণত হয়। ১৯১১ সালে বিজ্ঞানী হেনরি পিয়েরন প্রথম বলেন যে মস্তিষ্কে কিছু রাসায়নিক পদার্থ আমাদের ঘুম পাড়াতে সাহায্য করে, যার নাম তিনি দেন হিপনোটক্সিন। তখনো নিউরোট্রান্সমিটার আর এর কাজের ধরন নিয়ে বিজ্ঞানীদের ধারণা স্পষ্ট হয়নি। তবে ঘুমের ফিজিওলজির সবচেয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দেন বিজ্ঞানী নাথানিয়েল ক্লেইটমেইন, ১৯২৫ সালে। তার আগের বছরই আবিষ্কৃত হয়ে গেছে ইইজি যন্ত্র। ফলে এক নতুন দিক উন্মোচিত হয়ে গেছে। একই সঙ্গে বায়োলজিক্যাল ঘড়ি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন জার্মান গবেষক বানিং, আর মস্তিষ্কের কর্মকাণ্ডের তরঙ্গগুলো আবিষ্কার করছেন হার্ভে আর হোবার্ট। বিজ্ঞানের ইতিহাসে যা হয়—অনেকে মিলে একটা জুতসই ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। তবে নাথানিয়েল ক্লেইটম্যানের সফরটি ছিল বেদনাদায়ক। কথিত আছে, একবার তিনি টানা ১৮০ ঘণ্টা জেগে ছিলেন ঘুমের অভাবে শরীরে কী কী সমস্যা হয় তা দেখতে। আরেকবার সহকর্মী রিচার্ডসনকে নিয়ে তিনি কেন্টাকির ম্যামথ গুহায় এক মাস অন্ধকারে লুকিয়ে থাকেন টানা অন্ধকার সারকাডিয়ান রিদমে কী প্রভাব ফেলে তা দেখার জন্য। অবশেষে ১৯৩৯ সালে ক্লেইটম্যানের যুগান্তকারী গ্রন্থ স্লিপ অ্যান্ড ওয়েকফুলনেস প্রকাশিত হয়। পরে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন আরেক বিজ্ঞানী ইউজেন এসিরিনস্কি। ঘুম-জাগরণ-স্বপ্নের রহস্যময় জগতের সিংহভাগই এ দুই গবেষকের হাতে উন্মোচিত।
আমাদের ঘুমের আছে নির্দিষ্ট ফিজিওলজি বা শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। মূলত ঘুমের দুটি পর্যায়—রেম স্লিপ (র্যাপিড আই মুভমেন্ট) আর ননরেম (ননর্যাপিড আই মুভমেন্ট) স্লিপ। ননরেমের আবার চারটি উপপর্যায় আছে। ঘুমের মধ্যে অবিরত এই ননরেম আর রেম পর্যায়ের চক্র চলমান থাকে। এই চক্রের বিশৃঙ্খলা ঘটলেই নানা ধরনের স্লিপ ডিজঅর্ডার ঘটে। ঘুম শুরু হয় ননরেমের প্রথম পর্যায় বা স্টেজ ওয়ানের ক্ষুদ্র এপিসোড দিয়ে। তারপর দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায় শেষ করে প্রবেশ করে রেম পর্যায়ে। ঘুমের কালের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশজুড়ে থাকে ননরেম পর্যায়, আর রেম থাকে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। ননরেম ও রেমের প্রথম চক্রটি সাধারণত ৭০-১০০ মিনিট স্থায়ী হয়। পরবর্তী সময়ে স্থায়িত্ব বাড়তে থাকে। রাত গভীর হতে থাকলে একেকটি চক্র ৯০ থেকে ১২০ মিনিট স্থায়ী হতে থাকে। রাত যত গভীর হয়, রেম পর্যায়ের স্থায়িত্ব তত বাড়ে।
ননরেমের প্রথম পর্যায়টি খুবই কম স্থায়িত্বের, সাধারণত ১ থেকে ৭ মিনিটের, হালকা ঘুম। এ সময় মস্তিষ্কে লো ভোল্টেজ আলফা ওয়েভ দেখা যায়। আলফা ওয়েভ জাগরণমুখী রিল্যাক্সেশন পর্যায়। ফলে এ সময় অল্পতেই ঘুম ভেঙে যায়। দ্বিতীয় পর্যায় ১০ থেকে ২৫ মিনিটের, লো ভোল্টেজ স্লিপ স্পিন্ডল আর কে কমপ্লেক্স দেখা দেয় মস্তিষ্কে। এই স্লিপ স্পিন্ডল আমাদের স্মৃতি সঞ্চয়ের কাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় মস্তিষ্ক মেমোরি বা স্মৃতিকে সুরক্ষিত করার কাজটি করে। পরবর্তী দুটি পর্যায় হাই ভোল্টেজ স্লো ওয়েভ অ্যাকটিভিটির। এরপরই মস্তিষ্ক প্রবেশ করে রেম স্লিপে। রেম মানে র্যাপিড আই মুভমেন্ট, এ সময় চোখের মণি দ্রুত নড়াচড়া করে। মাংসপেশি শিথিল হয়ে পড়ে আর আমরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। কেউ যদি এই রেম স্লিপের সময় হঠাৎ জেগে ওঠে, তবে স্বপ্নগুলো মনে করতে পারে, নয়তো পারে না। রেম পর্যায়েও মস্তিষ্ক স্মৃতি সঞ্চয়ের কাজ করে।
ঘুমের সময় যে কেবল মস্তিষ্কের তরঙ্গগুলোর পরিবর্তন ঘটে তা নয়, সমস্ত শরীরেই চলতে থাকে নানা পরিবর্তন। যেমন হৃদ্স্পন্দন, রক্তচাপ, শ্বাসপ্রশ্বাসের ওঠানামা চলতে থাকে বিভিন্ন পর্যায়ে। রেম স্লিপের সময় মস্তিষ্কের কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকায় বিপাকক্রিয়া ও রক্তপ্রবাহ বাড়ে, লিমবিক সিস্টেম ও ভিজ্যুয়াল এলাকায় কমে। হরমোনের ওঠানামা চলতে থাকে। প্রথম কয়েক ঘণ্টা গ্রোথ হরমোন নিঃসৃত হতে থাকে বেশি, যে জন্য প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, শিশুরা ঘুমের মধ্যেই বাড়ে। ওদিকে কর্টিসোল ও অ্যাড্রিনালিনের মাত্রা কমে। ঘুমের একটি অন্যতম হরমোন হলো মেলাটোনিন, যা আলো বা অন্য উদ্দীপকে হ্রাস পায়।
ঘুম ও জাগরণকে মস্তিষ্কের যেসব এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ব্রেন স্টেম ও হাইপোথ্যালামাস। এতে মস্তিষ্কের পোনস এবং মিডব্রেন এলাকায় রেটিকুলার অ্যাকটিভেটিং সিস্টেম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঘুমন্ত অবস্থায় রেটিকুলার অ্যাকটিভেটিং সিস্টেম নিষ্ক্রিয় অবস্থায় থাকে, আর থ্যালামাস থেকে কোনো সংবেদন সেখানে পৌঁছায় না। জাগ্রত অবস্থায় উল্টোটা ঘটে। জীবজগৎ কেন রাতকে ঘুমের জন্য বেছে নিয়েছে? জীবনের ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে জীবদেহ এভাবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, তাই। মস্তিষ্কের সুপ্রাকায়সমেটিক নিউক্লিয়াস হলো আলোকসংবেদী সার্কাডিয়ান পেসমেকার। দিনের আলো রেটিনা হয়ে হাইপোথ্যালামাস দিয়ে পিনিয়াল গ্রন্থি থেকে মেলাটোনিন নিঃসরণ ঘটায়। ফলে আমরা দিনের আলোয় জাগ্রত হই। আদিমকাল থেকে সূর্যোদয়ের সঙ্গেই তাই প্রাণিজগতের ঘুম ভাঙে। এ ছাড়া গাবা, হিস্টামিন, অ্যাসিটাইলকোলিন, গ্লুটামেটসহ আরও কিছু নিউরোট্রান্সমিটার কাজ করে ঘুমের পেছনে।
নাথানিয়েল ও ইউজেন যখন ঘুম নিয়ে কাজ করছিলেন, তখন বিজ্ঞানের জগতে তাঁরা ছিলেন প্রায় অচ্ছুত। কারণ, এত সাধারণ ও ‘কম গুরুত্বপূর্ণ’ বিষয় নিয়ে তখন কারও আগ্রহ ছিল না। তাঁরা জানতেন না বিংশ শতাব্দীর পর এই ঘুম হয়ে উঠবে আধুনিক মানুষের সবচেয়ে আগ্রহের ও আলোচ্য বিষয়গুলোর একটি। আধুনিক জীবনযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠবে ইনসমনিয়া, প্যারাসমনিয়া, স্লিপ অ্যাপনিয়া, হিপনাগোগিক হ্যালুসিনেশন, রেস্টলেস লেগ সিনড্রোম ইত্যাদি স্লিপ ডিজঅর্ডার। ঘুমজনিত সমস্যায় ভুগতে শুরু করবে কোটি কোটি মানুষ। ঘুমের ওষুধ ও ঘুমের চিকিৎসা হয়ে উঠবে বিশ্বের অন্যতম লাভজনক গবেষণা। স্থূলতা, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হরমোনজনিত সমস্যা, ডিপ্রেশনসহ নানান শারীরিক রোগবালাইয়ের সঙ্গে ঘুমের সম্পর্ক স্থাপিত হবে। স্লিপ হাইজিন নিয়ে প্রচুর কাজ হবে। এত কিছুর পরও ঘুমের অনেক কিছুই রয়ে যাবে রহস্যাবৃত। ভবিষ্যতে হয়তো এসব রহস্য বিজ্ঞানের হাত ধরে উন্মোচিত হবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি অ্যান্ড মেটাবলিজম, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা