বাদুড়ের শব্দ শোনা যায় না কেন?

বাদুড়

পৃথিবীর অদ্ভুতুড়ে প্রাণীদের অন্যতম বাদুড়। স্তন্যপায়ী প্রাণী, কিন্তু এদের ডানা আছে। মানে উড়তে পারে। মজার ব্যাপার হলো, উড়তে পারলেও এরা পাখি নয়। আছে খরগোশের মতো বড় বড় দুটো কান আর ছাতার মতো দেখতে অদ্ভুত দুটো পাখনা। আরও অবাক করা বিষয় এদের বড় বড় দুটো চোখ। চোখ আছে বটে, কিন্তু ভালোমতো দেখতে পায় না। চোখে না দেখলেও ঠিক ঠিক পথ চিনে নিয়ে চলতে পারে। যেসব প্রাণী চোখে দেখে, তাদের মতোই। তবে দিনের আলোয় নয়, এরা পথ চলে রাতের আঁধারে।

ভাবছেন, তাহলে কীভাবে? আসলে বাদুড়ের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ। তাই এরা চলে মূলত শ্রবণশক্তির ওপর নির্ভর করে। শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করে প্রতিধ্বনি শুনে চিনে নেয় পথ। উড়ে চলে। শুরুতে অদ্ভুতুড়ে বলার এটাও একটা কারণ। বাদুড় পৃথিবীর একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী, যারা উড়তে পারে।

 পৃথিবীতে প্রায় ১১০০ প্রজাতির বাদুড় রয়েছে। এদের প্রায় ৭০ ভাগ পতঙ্গভুক। বাকিরা ফলমূল খায়। নিশাচর এই প্রাণী দিনের বেলা অন্ধকার স্থানে ঝুলে থাকে উল্টো হয়ে।

পথ চলতে বা খাবার চিনে নিতে বাদুড় শব্দোত্তর বা শ্রবণোত্তর শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করে। শ্রবণোত্তর শব্দতরঙ্গ কী, সেটা বোঝার জন্য প্রথমে শব্দ কী, তা জানা প্রয়োজন। শব্দের উৎপত্তি কম্পন থেকে। কোথাও কম্পন হচ্ছে মানেই শব্দ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু শব্দ হলেই মানুষ শুনতে পায় না। সেকেন্ডে ২০টি কম্পনের কম হলে বা ২০ হাজার কম্পনের বেশি হলে, সেই শব্দ আমাদের শ্রবণেন্দ্রীয় টের পায় না। সেকেন্ডে ২০টি কম্পন মানে, এই তরঙ্গের কম্পাংক ২০ হার্জ। একে বলা হয় ইনফ্রাসোনিক বা শব্দোতর তরঙ্গ। অর্থাৎ, আমরা যে শব্দ শুনতে পাই, তার চেয়ে কম। আর ২০ হাজারের বেশি কম্পাংকের শব্দকে বলে আল্ট্রাসোনিক বা শব্দোত্তর তরঙ্গ। অর্থাৎ, আমরা যে শব্দ শুনতে পাই, এর কম্পাংক তার চেয়ে বেশি।

পৃথিবীতে প্রায় ১১০০ প্রজাতির বাদুড় রয়েছে। এদের প্রায় ৭০ ভাগ পতঙ্গভুক। বাকিরা ফলমূল খায়। নিশাচর এই প্রাণী দিনের বেলা অন্ধকার স্থানে ঝুলে থাকে উল্টো হয়ে।

চলার সময় বাদুড় মুখ দিয়ে ক্রমাগত শব্দোত্তর তরঙ্গের শব্দ তৈরি করে বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। সেই শব্দ ঘরবাড়ি, গাছপালা বা পাহাড়-পর্বতে বাধা পেয়ে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে বাদুড়ের কানে। সেই প্রতিধ্বনির ফিরে আসার সময় ও প্রকৃতি থেকে বাদুড় আশেপাশের সম্ভাব্য বাধা সম্পর্কে ধারণা লাভ করে।

বাদুড়ের মস্তিষ্ক প্রতিফলিত শব্দ থেকে বুঝতে পারে সামনের বাধা আসলে কতটুকু দূরে। আর শব্দ ছুড়ে দেওয়ার ঠিক কতক্ষণ পরে সেটা আবার কানে ফিরে এল। এ থেকেই বাদুড় খোলা পথের দিক-ঠিকানা বুঝতে পারে। প্রয়োজনে এড়িয়ে চলতে পারে বাধা। চিনে নিতে পারে, সামনে খাবার আছে কি না ইত্যাদি।

আসলে বাদুড়ের মস্তিস্ক এক্ষেত্রে সূক্ষ্ম কম্পিউটারের মতো কাজ করে। কারণ, সামনে বাধা বা খাবারের দূরত্ব কত, সেটা বুঝতে শব্দের বেগ হিসেব করতে হয়। বাদুড়ের মস্তিস্ক এটা বোঝে। মুহূর্তের মধ্যেই শব্দের বেগ, দূরত্ব  ও সময়ের হিসেব কষে নিয়ে পথ চিনে নিতে পারে। খাবারের খোঁজে বের হলে ঠিক চিনে নেয় লক্ষ্য।

এ থেকে হয়তো বুঝতে পারছেন, দিনের বেলায় পথ চলতে এদের মোটেই সমস্যা হওয়ার  কথা না। তবু দিনে তেমন দেখা যায় না এদের। প্রশ্ন হলো, কেন? সম্ভাব্য যৌক্তিক উত্তরটি আপনিও বুঝতে পারছেন। কোনো কারণে এরা দিনের বেলা চলাফেরা করতে পারে না। এবারে প্রশ্ন আসে, কেন পারে না?

দিনের বেলা মানুষসহ পৃথিবীর বেশিরভাগ প্রাণীই জেগে থাকে। তাদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের কারণে নিয়মিত প্রচুর শব্দ ছড়িয়ে পড়তে থাকে পরিবেশে। দিবাচর প্রাণীদের কোলাহলে বাদুড়ের পথ চলার সেই বিশেষ শব্দতরঙ্গ হারিয়ে যায়। বিভিন্ন কম্পাংকের এতরকম শব্দের ভীড়ে নিজের শব্দতরঙ্গ সে আর খুঁজে পায় না। হারিয়ে ফেলে দিশা। এভাবে কালের আবর্তে বাদুড় শিখে নিয়েছে, দিনে পথ চলা তার কম্মো নয়। তাই বাসা ছেড়ে বেরই হয় না দিনে।

আগেই বলেছি, পথ চলার জন্য বাদুড় শ্রবণোত্তর শব্দতরঙ্গ বাতাসে ছুড়ে দেয়। এই শব্দ আমরা শুনতে পাই না। রাতে লিচু বা পেয়ারা গাছে বাদুড় আক্রমণ করলে যে কিচিরমিচির শব্দ শোনা যায়, সেটা ওদের পথ চলার জন্য করা শব্দ নয়। সাধারণ ডাক। এই ডাক শোনা যায়।

মজার বিষয় হলো, বাদুড়ের পথ চলার জন্য করা শব্দ না শোনাটা আমাদের জন্য বরং আশীর্বাদ। কারণ শব্দোত্তর বা আলট্রাসোনিক শব্দ মানুষের কানের পর্দা শনাক্ত করতে পারলে আমাদের বিপদ হতো। সে আঘাতে ছিঁড়ে যেত কানের পর্দা। প্রকৃতির অসংখ্য নিপুণ কারিকুরির এটিও একটা। নিজেদের ভালোর জন্যেই বাদুড়ের পথ চলার শ্রবণোত্তর শব্দ আমরা শুনতে পাই না।

লেখক: শিক্ষার্থী, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: নেচার