মারিয়ানা ট্রেঞ্চে পৃথিবীর সব ময়লা ফেললে কী হতো?

মারিয়ানা ট্রেঞ্চ পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর খাত। অবস্থান প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে। এর গভীরতম স্থানটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার নিচে অবস্থিত।

পুরো পৃথিবীজুড়ে বেশিরভাগ মানুষ হয়তো জলাভূমিকে ময়লা ফেলার অন্যতম জায়গা মনে করে। এর প্রমাণ নদীনালা, হ্রদ বা সমুদ্র- যেদিকেই তাকান না কেন, পাওয়া যাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের এই স্বভাব প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করছে জীববৈচিত্র্যকে। কিন্তু কেমন হতো যদি আমরা জীববৈচিত্র্যের কোনো ক্ষতি না করে সমুদ্রে ময়লা ফেলতে পারতাম? নিশ্চয়ই ভালো হতো। কিন্তু সেরকম কোনো সুযোগ নেই। সমুদ্র ময়লা ফেললে সেটা প্রাণ ও পরিবেশের ক্ষতি করবেই। তার চেয়ে বরং জানার চেষ্টা করা যাক, গভীরতম সমুদ্রখাত মারিয়ানা ট্রেঞ্চে ময়লা ফেললে কী কতো? সেখানে কি পানির চাপে সব ময়লা গিয়ে সমুদ্রখাতের নিচে জমত? পরিবেশের ওপর প্রভাবটা কেমন পড়ত ওখানটায় ময়লা ফেললে? যৌক্তিক কল্পনার মাধ্যমে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজব আজ।

মারিয়ানা ট্রেঞ্চ পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর খাত। অবস্থান প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে। এর গভীরতম স্থানটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার নিচে অবস্থিত। খাতটি এত বড় যে বিশেষজ্ঞদের মতে পৃথিবীবাসির প্রায় এক হাজার বছরের আবর্জনা এখানে অনায়াসেই এঁটে যাবে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত মাত্র তিনজন মানুষ পৌঁছাতে পেরেছিলেন মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলায়। এর দুজন হলেন মার্কিন সমুদ্রবিজ্ঞানী ডন ওয়ালস ও সুইস সমুদ্রবিজ্ঞানী জ্যাকুয়া পিকার্ড। তাঁরা দুজন সেখানে গিয়েছিলেন ১৯৬০ সালে। তৃতীয়জনের নাম শুনলে আপনি হয়তো চমকে যেতে পারেন। এর প্রায় ৫২ বছর পর এই মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলদেশের চ্যালেঞ্জার ডিপ অঞ্চলে পৌঁছান চলচ্চিত্র পরিচালক জেমস ক্যামেরুন! ২০১৯ সালের পর ‘লিমিটিং ফ্যাক্টর’ নামে বিশেষ ধরনের সাবমেরিন বানায় মার্কিন সাবমেরিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ট্রাইটন সাবমেরিন। এ সাবমেরিন সমুদ্রের তলদেশের গভীরতম অঞ্চলগুলোতে যাত্রীদের নিয়ে ঘুরে আসে। তবু আজ পর্যন্ত মাত্র ২২ জন মানুষ পৌঁছাতে পেরেছেন এ অঞ্চলে।

মারিয়ানা ট্রেঞ্চ পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর খাত
তৃতীয়জনের নাম শুনলে আপনি হয়তো চমকে যেতে পারেন। এর প্রায় ৫২ বছর পর এই মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলদেশের চ্যালেঞ্জার ডিপ অঞ্চলে পৌঁছান চলচ্চিত্র পরিচালক জেমস ক্যামেরুন!

যাহোক, প্রশ্ন হলো, এত দুর্গম জায়গায় ময়লা ফেলার উপায়টা আসলে কী? সে আলোচনায় যাওয়ার আগে দেখে নেওয়া যাক, কী পরিমাণ আবর্জনার কথা বলছি আমরা। পৃথিবীজুড়ে মানুষ প্রতিবছর প্রায় ২০০ কোটি টন বর্জ্য তৈরি করে। ২০৫০ সাল নাগাদ এটা বেড়ে প্রায় সাড়ে তিন শ কোটি টন হতে পারে। এই পরিমাণ আবর্জনা এক জায়গায় স্তুপ করলে সেটার আয়তন হবে গিজার পিরামিডের প্রায় ১ হাজার গুণ।

আবর্জনা থেকে বাঁচতে আমরা নানা কাজ করি। ভূমিতে ছুঁড়ে ফেলি, পুড়িয়ে ফেলি বা ফেলে দিই পানিতে। যা-ই করি না কেন, কোনো পদ্ধতিই ঠিক কাজে লাগে না। ভূমিতে আবর্জনা ফেলা বা পুড়িয়ে ফেলা, দুটোই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। আবর্জনা থেকে আসা দুর্গন্ধ ও বিষাক্ত বিভিন্ন পদার্থ পৃথিবীর মাটি, বায়ু ও ভূগর্ভস্থ পানিকে দূষিত করে। এটি পৃথিবীর প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

এই ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে সব বর্জ্যকে মারিয়ানা ট্রেঞ্চে ফেলার কথা ভাবছি আমরা। আসলে, কল্পনা করছি যৌক্তিকভাবে। স্বাভাবিকভাবে এ সমুদ্রখাতের মধ্যে এঁটে যাবে প্রায় ৯ লাখ ৭০ হাজার বিলিয়ন টন বর্জ্য। আগেই বলেছি, এ পরিমাণ বর্জ্য তৈরি করতে পৃথিবীবাসির প্রায় ১ হাজার বছর সময় লাগবে। অর্থাৎ, মারিয়ানা ট্রেঞ্চে আবর্জনা ফেলা গেলে ১ হাজার বছরের জন্য পৃথিবীর স্থলভাগ থাকবে আবর্জনা মুক্ত। তা ছাড়া পানির যত গভীরে যাওয়া যায়, চাপ তত বাড়ে। এ কারণে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলদেশে চাপের পরিমাণ অনেক বেশি। সেটা কত? প্রতি বর্গমিটার জায়গায় প্রায় ২ হাজার হাতির ওজনের সমান। এই চাপ আবর্জনাকে সঙ্কুচিত করবে। ফলে আরও আবর্জনা ফেলা যাবে সেখানে। আবর্জনা ফেলার কিছু সুবিধা তো পাওয়া গেল, এবার কীভাবে ফেলা যায়, বের করতে হবে সে উপায়।

সেখানে টন টন আবর্জনা নিতে কত বড় সাবমেরিনের প্রয়োজন বা কী পরিমাণ খরচ হতে পারে, তা হয়তো কল্পনা করতে পারছেন। অর্থনৈতিকভাবে এটা একবারেই লাভজনক নয়। এর চেয়ে ভালো উপায় হলো, পাইপের মাধ্যমে সরাসরি ভূমি থেকে মারিয়ানা ট্রেঞ্চে ময়লা ফেলা।

মারিয়ানা ট্রেঞ্চে আবর্জনা ফেলার একটি উপায় হতে পারে সাবমেরিন। বন্দর থেকে আবর্জনা সাবমেরিনে বোঝাই করে নিয়ে গিয়ে মারিয়ানা ট্রেঞ্চে ফেলা যেতে পারে। তবে সেটা হবে ভীষণ ব্যায়বহুল।

আগেই বলেছি, খ্যাতনামা চলচ্চিত্রপরিচালক জেমস ক্যামেরন গিয়েছিল মারিয়ানা ট্রেঞ্চে। সমুদ্রখাতটির গভীর চাপ মোকাবেলার জন্য তাঁকে বিশেষ ধরনের সাবমেরিন ব্যবহার করতে হয়েছিল। পুরো অভিযানটিতে তাঁর খরচ হয়েছিল প্রায় ১ কোটি মার্কিন ডলার। বলা প্রয়োজন, সেই সাবমেরিনটি শুধু একজন মানুষ অবস্থানের উপযোগী ছিল। সেখানে টন টন আবর্জনা নিতে কত বড় সাবমেরিনের প্রয়োজন বা কী পরিমাণ খরচ হতে পারে, তা হয়তো কল্পনা করতে পারছেন। অর্থনৈতিকভাবে এটা একবারেই লাভজনক নয়। এর চেয়ে ভালো উপায় হলো, পাইপের মাধ্যমে সরাসরি ভূমি থেকে মারিয়ানা ট্রেঞ্চে ময়লা ফেলা। একবার এই পাইপ ব্যবস্থাটি তৈরি করতে পারলে দীর্ঘসময় ধরে তা ব্যবহার করা যাবে কোনো অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই।

সমস্যা হলো, মারিয়ানা ট্রেঞ্চে ময়লা ফেললেও মারাত্মকভাবে দূষিত হবে পরিবেশ। ক্ষতিকর ধাতু, রাসায়নিক ও মাইক্রোপ্লাস্টিকে ভরা থাকে আবর্জনা। এসব ক্ষতিকর উপাদান খুব সহজেই মারিয়ানা ট্রেঞ্চ থেকে ছড়িয়ে পড়তে পারে সমুদ্রে। সেখান থেকে সামুদ্রিক মাছ ও প্রাণীর দেহে বা বাষ্পীভূত হয়ে বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এসব প্রাণী খাবার হিসেবে খেলে বা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে দূষিত পদার্থ প্রবেশ করতে পারে মানবদেহে। অর্থাৎ, মারিয়ানা ট্রেঞ্চে ময়লা ফেললে আসলে পরিবেশ দূষণ কমছে না। তা ছাড়া, মারিয়ানা ট্রেঞ্চে আবর্জনা ফেলার অর্থ সেখানকার জীববৈচিত্র্যকে চিরতরে ধ্বংস করে দেওয়া। তাই, মারিয়ানা ট্রেঞ্চে আবর্জনা ফেলার চিন্তা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

তারচেয়ে বরং আমাদের নজর দিতে হবে আবর্জনা কীভাবে কমানো যায় বা কীভাবে পরিবেশন দূষণ কমানো সম্ভব। পরিবেশ দূষণ কমানোর জন্য আবর্জনা রিসাইক্লিং বা পুনরায় ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে হবে। কমাতে হবে প্লাস্টিকের মতো ক্ষতিকর পণ্য ও রাসায়নিকের ব্যবহার। পৃথিবীজুড়ে অনেকেই এখন এসব বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। আমরাও নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হলে ভবিষ্যতে পরিবেশ দূষণমুক্ত হতেও পারে। আমাদের পরের প্রজন্মের জন্য এমন একটা পৃথিবীই তো আমরা রেখে যেতে চাই, তাই না?

লেখক: শিক্ষার্থী, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা

সূত্র: হোয়াটইফশো ডট কম, উইকিপিডিয়া, লাইভসায়েন্স