ভুল সাইজের জুতা পরে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করছেন না তো?

ভুল জুতার ব্যবহারে পিঠ, কোমর, হাঁটুসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা হতে পারে, নষ্ট হয়ে যেতে পারে শরীরের স্বাভাবিক ভঙ্গি। এসব সমস্যার বিস্তারিত জেনে নিন, সঙ্গে জানুন কেমন করে নির্বাচন করবেন সঠিক সাইজের জুতা।

ভুল সাইজের জুতা পরলে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারেমিডজার্নির সাহায্যে তৈরি

প্রতিদিনের জীবনে মিশে থাকা অতিসাধারণ একটি উপকরণ জুতা। জিনিসটা সামান্য হলেও এর প্রতি যত্নশীল ও দায়িত্ববান হওয়ার শিক্ষা দিতে সুকুমার রায় ‘যতীনের জুতো’ নামে একটি গল্পও লিখেছেন। স্লেট-চক নিয়ে স্কুলে যাওয়া যতীনের প্রতিমাসে একজোড়া জুতা লাগে। লাফিয়ে, দৌড়িয়ে, কাদা মাখিয়ে সম্ভাব্য সব নির্যাতন সে চালায় জুতার ওপর। উপায় না পেয়ে বাবা বললেন, এবার ছিঁড়লে ছেঁড়া জুতো পরেই থাকতে হবে। তখন যতীন সতর্ক হলো, ধীর পায়ে পা ফেলে, পাছে জুতা ছিঁড়ে যায়!

আমরা যারা যতীনের বয়স পেরিয়ে এসেছি, তারা জুতার ওপর এমন নির্যাতন করি না। কিন্তু জুতা নির্বাচনে সতর্ক না হলে জুতাই উল্টো আমাদের ওপর নির্যাতন করতে পারে। অনেক আরামদায়ক জুতাও শারীরিক গঠনে প্রভাব ফেলে। নষ্ট করে দিতে পারে শরীরের স্বাভাবিক ভঙ্গি। প্রতিদিনের ব্যবহৃত সাধারণ জুতা পিঠ, কোমর, হাঁটুসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথার কারণ হয়। তাই সঠিক মাপের জুতা পরার ওপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি।

আমরা এগুলো কখনো খেয়াল করি না। অথচ স্থান-কাল ভেদেও জুতোর প্রভাব আছে। বাজার কিংবা স্কুল থেকে শিশুকে নিয়ে আসার জন্য আলাদা জুতা পরি, অফিসের জন্য আলাদা জুতা, এমনকি বাথরুমে যাওয়ার জন্যও আলাদা জুতা পরতে হয়। কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে আমরা ভাবি না। সামনে যেটা পাই, পরে ফেলি। গবেষণা বলছে, এই সাধারণ মুহূর্তের জুতা বাছাই আপনার স্বাস্থ্যের ওপর ধারণার চেয়েও বেশি প্রভাব ফেলতে পারে।

ভুল মাপের জুতা পরলে কী সমস্যা হয়

নতুন জুতা কিনতে গিয়ে দেখলেন, পরতে একটু অস্বস্তি লাগছে। দুদিন পর ঠিক হয়ে যাবে ভেবে কিনে নিলেন। ছোট্ট এই অস্বস্তিই হতে পারে বুনিয়নের মতো সমস্যার জন্মদাতা। এতে পায়ের আঙুলের গোড়ার হাড় বেরিয়ে আসে। এ ছাড়াও জুতার শক্ত চামড়া নখের জন্য সমস্যা।

পায়ের রোগ বিশেষজ্ঞ পডিয়াট্রিস্ট মিগুয়েল কুনহা জানান, ‘পা আমাদের পুরো শরীরের ভিত্তি। জুতা সঠিক মাপের না হলে তাতে পায়ে প্রভাব পড়ে। এতে শুধু পা-ই ক্লান্ত হয় না, পুরো শরীরের গঠনকাঠামো এলোমেলো হয়ে যায়। অর্থাৎ পা থেকে ব্যথা পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।’

রঙিন এমআরআই ধাঁচের এক্স-রে ছবি। ফিতা দেওয়া একটা বুট পুরো পায়ের তালুর খাঁজ ও গোড়ালির ওপর চাপ তৈরি করছে। এভাবে জুতার নকশা পায়ের নড়াচড়া ও ওজন বহনের ধরন বদলে দিতে পারে। শরীরের ভঙ্গি, ব্যথা ও হাঁটার ধরনের ওপর প্রভাব ফেলে
ছবি: নিক ভিসি, সায়েন্স ফটো লাইব্রেরি

ব্যথা যেভাবে শুরু হয়

ব্যায়াম ও থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা দেন ফিজিক্যাল থেরাপিস্টরা। তেমনই একজন থেরাপিস্ট অটো ল্যাম। তিনি বলেন, ‘হাঁটার সময় আমাদের পায়ের আকার কিছুটা বদলায়। প্রথমে গোড়ালি মাটি স্পর্শ করে, তারপর পা সামনের দিকে এগোয়। সবশেষে আঙুল ছড়িয়ে মাটি ঠেলে সামনে এগোনোর চূড়ান্ত কাজটি করে। কিন্তু ভুল জুতা পরলে এই প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে।’

স্বাভাবিকভাবে মাটিতে পা ফেলার প্রক্রিয়াকে বলে ‘প্রোনেট’। চওড়া পায়ে সরু জুতো পরলে পা মাটিতে ঠিকভাবে বসে না। পায়ের সম্পূর্ণ ভর মাটিতে পৌঁছাতে পারে না। ফলে ছোট ছোট পদক্ষেপ ফেলতে হয়। কার্যকারণ হিসেবে কোমর ও পিঠকে বাড়তি চাপ নিয়ে সামনের দিকে ঠেলতে হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামান্য এই বিষয়টি পরিণত হয় দীর্ঘস্থায়ী ব্যথায়। নষ্ট হয় হাঁটার ধরন। জয়েন্টে চাপ পড়ে এবং ভারসাম্যের সমস্যা দেখা দেয়।

কিছু নির্দিষ্ট ডিজাইনের জুতা অন্য সমস্যা তৈরি করে। সাধারণ চটি জুতা বা ফ্লিপ-ফ্লপ পরলে পায়ের আঙুলকে জুতোর ফিতা আঁকড়ে রাখতে হয়। ফলে পায়ের খিলানে টান পড়ে এবং পেশিতে ব্যথা হয়। আবার চ্যাপ্টা বা ক্ষয়ে যাওয়া জুতা হাঁটুর ভেতরের দিকে ব্যথার কারণ হয়। ভুল মাপ, ক্ষয়ে যাওয়া নরম অংশ ও সোলের অসামঞ্জস্যতার কারণে নিরবে শরীরের যেকোনো জায়গায় ব্যথা হতে পারে।

যেভাবে বুঝবেন জুতাই ব্যথার কারণ

পডিয়াট্রিস্ট মিগুয়েল কুনহার কাছে কোনো রোগী এলে শুরুতেই তিনি জুতা খুলে টেবিলে রাখতে বলেন। জুতার ক্ষয়ে যাওয়া অংশই অনেক কিছু বলে দেয়। আমাদের সাধারণ হাঁটা প্রোনেটের মাধ্যমে শেষ হয়। এতে পায়ের খিলান তার অবস্থান থেকে নিচে নেমে আসে। অতিরিক্ত প্রোনেটে জুতার ভেতরের দিক ও গোড়ালি বেশি ক্ষয়ে যায়। ফলে পা ভেতরের দিকে হেলে যায়, সঙ্গে পায়ের গোড়ালি ভেতরের দিকে ঘুরে যায়। এতে পায়ের পাতার টিস্যুতে প্রদাহ হয়। ধীরে ধীরে হাঁটুর ভেতরের ব্যথা, কোমরের ব্যথা এবং পিঠেও ব্যথা দেখা যায়। এসব সমস্যা দেখা দিলে বুঝতে হবে, পায়ের জুতাই সব নষ্টের গোড়া। 

রঙিন এক্স-রে ছবিটা একজন ৫৪ বছর বয়সী রোগীর। পায়ের বুড়ো আঙুলের এই দশাকে বুনিয়ন বলা হয়
ছবি: যেফাইর/সায়েন্স ফটো লাইব্রেরি

কীভাবে সঠিক জুতা খুঁজবেন

ব্যথার কারণ যদি জুতা হয়, তাহলে অবশ্যই পায়ের আকার ও নড়াচড়ার সঙ্গে মানানসই জুতা বেছে নিতে হবে। আমাদের পা সাধারণত শক্ত মিডসোলযুক্ত ফ্লাট জুতা পরে বেশি স্বস্তি পায়। অন্যদিকে উঁচু খিলানযুক্ত জুতায় বাড়তি কুশনিং লাগে। চওড়া পায়ের জন্য আঙুল রাখার টো-বক্স বেশি প্রশস্ত হতে হয়। আর সরু পায়ের জন্য দরকার টাইট-ফিট। এ জন্য জুতা কিনলে দিনের শেষে কেনা উচিত। কারণ, তখন পা সবচেয়ে বেশি ফোলা ও কাহিল অবস্থায় থাকে। এ অবস্থায় জুতো যদি ভালোভাবে ফিট হয়, তাহলে শরীর আরাম পাবে। নতুন জুতা পায়ে পরে একটু হেঁটে পরীক্ষা করে দেখলেই হবে।

জুতার হালহকিকত নিয়মিত খেয়াল রাখা জরুরি। সোল ক্ষয়ে গেল কি না, কুশনের অবস্থা কী, অস্বস্থি লাগছে কি না ইত্যাদি নানা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের শরীরের প্রতিটি অংশ একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। তাই কোনো অংশকেই কম গুরুত্ব দেওয়া উচিত হবে না।

লেখক: শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা কলেজ

সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক