বুদ্ধিমান ৫ প্রাণীর কথা

মানুষকে পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু প্রকৃতিতে বসবাসকারী অনেক প্রাণীই নিজেদের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে আমাদের অবাক করে। এদের বুদ্ধিমত্তা কখনো কখনো আমাদের চিন্তাশক্তিকেও ছাপিয়ে যায়। আজ আমরা এমন ৫টি প্রাণীর কথা জানব, যাদের চতুরতা ও বুদ্ধিমত্তা অন্য প্রাণীদের থেকে এদের আলাদা করেছে।

১. সাংকেতিক ভাষা বুঝতে পারে গরিলা

কোকোকে যখন একটা খেলনা বিড়াল দেওয়া হয়, তখন সে খুশি হয়নি
ছবি: লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমস

প্রশিক্ষণ দিলে গরিলা সাংকেতিক ভাষা বুঝতে পারে। কিছু গরিলাকে সাংকেতিক ভাষা শেখানোর মাধ্যমে এর সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। সবচেয়ে ভালো শিখতে পেরেছে কোকো নামে একটি গরিলা। ফ্রান্সিন প্যাটারসন এই গরিলাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। তিনি একজন প্রাণী মনোবিজ্ঞানী। তিনি কোকোকে এক হাজার মার্কিন সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের একটি পরিবর্তিত রূপ শিখিয়েছিলেন। একে গরিলা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ (GSL) বলা হয়। মোটামুটি তিন বছর বয়সী একটা শিশু এই পরিমাণ শব্দ শেখে। দুই হাজারের বেশি ইংরেজি শব্দ বুঝতে পারত কোকো। প্যাটারসন কোকো সম্পর্কে বলেন, ‘কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে কোকোর স্মৃতি এত ভালো।’ শব্দভান্ডার ছাড়াও কোকো আরও অনেক জটিল কাজ করতে পারত। প্রায় আটটি চিহ্ন ব্যবহার করে দীর্ঘ বাক্য তৈরি করতে পারত সে।

প্যাটারসন ও তাঁর সহকর্মীরা কোকোর জীবন ও শেখার প্রক্রিয়া নিয়ে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক জার্নাল ও ওয়েবসাইটে বিস্তারিত বর্ণনা প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে অনেকগুলোই পিয়ার রিভিউ করা নিবন্ধ। কোকো ১৯৭১ সালের ৪ জুলাই সান ফ্রান্সিসকো চিড়িয়াখানায় জন্ম নেয়। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা তাঁদের পিএইচডি গবেষণার অংশ হিসেবে সান ফ্রান্সিসকো চিড়িয়াখানায় কোকোর ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। ১৯৭২ ও ১৯৭৭ সালের মধ্যে কোকোর আইকিউ টেস্ট নেওয়া হয়। সেখানে কোকো স্কোর করে ৭০-৯০ এর মধ্যে। একটা সাধারণ মানবশিশুর বুদ্ধির স্কোরও এমন হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘দ্য গরিলা ফাউন্ডেশন’-এর গবেষকরা জানিয়েছেন, ১৯৮৩ সালের ক্রিসমাসে কোকো একটা পোষা বিড়াল চেয়েছিল। আসলে সাংকেতিক চিহ্নের সাহায্যে বুঝিয়েছিল যে কোকো একটা বিড়াল চায়। ওই ফাউন্ডেশনের জীববিজ্ঞানী রোনাল্ড কোহন লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসকে বলেছিলেন, ‘কোকোকে যখন একটা খেলনা বিড়াল দেওয়া হয়, তখন সে খুশি হয়নি। খেলনা বিড়ালটির সঙ্গে খেলেনি। বরং দুঃখের চিহ্ন প্রকাশ করে। পরে তার পছন্দ অনুযায়ী একটি বিড়াল শাবক দেওয়া হয়। এটা পেয়ে সে খুশি হয়। অর্থাৎ কোকোর আচরণ থেকে বোঝা যায়, গরিলারা জটিল চিন্তা করতে এবং অনুভূতি প্রকাশে সক্ষম।

২. কুকুর ও বিড়াল ৫০টির বেশি শব্দ বুঝতে পারে

কিছু প্রজাতির কুকুর ১০০টিরও বেশি শব্দ বুঝতে পারে। অন্য দিকে বিড়ালকে ৫০টির বেশি শব্দ শেখানো একটু মুশকিল

ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়ই বুদ্ধিমান বিড়াল ও কুকুর দেখা যায়। বিশেষ করে কুকুরকে দেখা যায়, বিভিন্ন বোতাম টিপে নিজেদের ইচ্ছা প্রকাশ করছে। এটি দর্শকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় মনে হয়। অনেকে মনে করেন, কুকুরগুলো মানুষের মতো কথা বলে ভাব প্রকাশ করছে।

কিছু প্রজাতির কুকুর ১০০টিরও বেশি শব্দ বুঝতে পারে। অন্য দিকে বিড়ালকে ৫০টির বেশি শব্দ শেখানো একটু মুশকিল। মজার বিষয় হলো, বিড়াল ও কুকুরের বোতাম টেপার পদ্ধতি আলাদা। বিড়াল সাধারণত এক বা দুটি বোতাম টিপে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয়, তারা কী চায়। কিন্তু কুকুর নিজেদের মতামত বা ইচ্ছা জানাতে বেশি বোতাম ব্যবহার করে।

যদিও প্রাণীপ্রেমীদের কাছে এটা খুব আগ্রহ জাগানো ঘটনা, তবে গবেষকরা এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এরা কিছু সংকেতিক ভাষা বুঝতে পারলেও মানুষের মতো ভাষার জটিলতা বুঝতে পারে না।

৩. কাকের স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর

কিছু কাক জিনিসপত্র বা সরঞ্জাম ব্যবহারে অত্যন্ত ভালো

কাক ও দাঁড়কাক একই পরিবারের পাখি। গবেষণায় দেখা গেছে, এরা নিজেদের মধ্যকার ঝগড়া অনেকদিন মনে রাখে। শুধু নিজেদের ঝগড়াই নয়, যেকোনো রাগ, ক্ষোভ ও ঘৃণার ঘটনা এরা মনে রাখে দীর্ঘদিন। বিজ্ঞানীরা গবেষণায় দেখেছেন, কাক ও দাঁড়কাক অনেক পাখির তুলনায় বুদ্ধিমান। এরা ক্ষোভ ও ঘৃণার কোনো ঘটনা প্রায় পাঁচ বছর পর্যন্ত মনে রাখতে পারে। এর মানে এই নয় যে ৫ বছর পরে আর মনে থাকবে না। তবে, বিজ্ঞানীদের মতে, অন্তত ৫ বছর এসব কথা মনে রাখতে পারে কাক।

কাকের মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যকারিতা এদের কিছু ঘটনা মনে রাখতে সাহায্য করে। এ ছাড়াও কিছু কাক জিনিসপত্র বা সরঞ্জাম ব্যবহারে অত্যন্ত ভালো। পূর্ব অস্ট্রেলিয়ার নিউ ক্যালেডোনিয়ান ক্রো নামে একধরনের কাক আছে। এরা ছোট লাঠি বা ডাল দিয়ে ফাঁদ তৈরি করে শিকার ধরে। শিকার করে পোকা। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এত ছোট মস্তিষ্ক থাকা সত্ত্বেও এই পাখিরা এত জটিল কাজ করতে পারে।

৪. হাতির শোক প্রকাশ

হাতিরা মৃত হাতিদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে

হাতি অনেক বুদ্ধিমান প্রাণী। এ কারণেই সার্কাসে হাতি ব্যবহার করা হয়। কারণ, হাতিকে সহজে শেখানো যায়। বিশালাকার এই প্রাণীরা বিশ্বের অন্যতম বুদ্ধিমান প্রাণী। গবেষণায় দেখা গেছে, হাতিরা পরস্পরের সঙ্গে ইনফ্রাসাউন্ডের মাধ্যমে অনেক দূর পর্যন্ত যোগাযোগ করে। এই ইনফ্রাসাউন্ড মানুষ শুনতে পায় না। মানুষ ২০ হার্জ থেকে ২০ হাজার হার্জ কম্পাংক পর্যন্ত শুনতে পায়। বিজ্ঞানীদের মতে, এই সাউন্ড ১০ কিলোমিটারের বেশি দূরত্ব পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।

হাতিরা মৃত হাতিদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, হাতিরা মৃত হাতির কাছে গিয়ে শোক প্রকাশ করে।মৃতদেহকে ঘিরে চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝেমধ্যে কাঁদেও।

৫. মালিকের নাম, গন্ধ ও কণ্ঠস্বর মনে রাখে বিড়াল

মুখ চেনার চেয়ে গন্ধ ও শব্দকে বেশি গুরুত্ব দেয় বিড়াল

বিড়ালকে নাম ধরে ডাকলে কি বুঝতে পারে? এ প্রশ্ন নিয়ে অনেকের মধ্যে রয়েছে কৌতূহল। কারণ, নাম শুনে বিড়ালকে অনেকবার সাড়া দিতে দেখা গেছে। তবে আগে অনেক গবেষক মনে করতেন, বিড়াল কুকুরের মতো আদেশ পালন করে না। ২০১৯ সালে সায়েন্টিফিক রিপোর্টস জার্নালের গবেষণায় দেখা গেছে, বিড়ালের নাম ধরে ডাকলে ওরা বুঝতে পারে। যখন এদের নাম ধরে ডাকা হয়, তখন সাড়া দেয়। কিন্তু সব সময় সাড়া দেয় না। কারণ বিড়াল খুব স্বাধীনচেতা প্রাণী। তারা মালিকের দেওয়া নামকে নিজের নাম বলে মেনে নিলে সে নামে সাড়া দেয়। আর নিজের নাম মেনে না নিলে ওই নামে যতই ডাকুন, সাড়া দেবে না।

বিড়ালের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। তবে আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, মুখ চেনার চেয়ে গন্ধ ও শব্দকে বেশি গুরুত্ব দেয় বিড়াল। আপনি যতই চেহারা পরিবর্তন করুন না কেন, বিড়াল আপনার গন্ধ ও কণ্ঠস্বর চিনতে পারবে। অর্থাৎ আপনি যদি মুখোশ পরেন বা ভিন্ন ধরনের সুগন্ধি ব্যবহার করেন, তবু বিড়াল আপনাকে চিনতে পারবে। এ থেকে বোঝা যায়, বিড়াল অনেক প্রাণীর চেয়ে বেশি তীক্ষ্ণ গন্ধ এবং শ্রবণশক্তি সম্পন্ন।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা

সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, টপটেনজ ডট কম ও উইকিপিডিয়া