সাগরতলে অভিযান

সাগরতলে অভিযানের কথা উঠে এসেছে ফরাসি কল্পবিজ্ঞান লেখক জুল ভার্নের কলমে। টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি—বাংলায় যার বিখ্যাত নাম আছে, সাগরতলে। সেই কল্পবিজ্ঞানের নটিলাস আসলে বাস্তব থেকে অনুপ্রাণিত। মানুষের সমুদ্র অভিযানের গল্পটি আরও বেশি রোমাঞ্চকর, মুগ্ধকর। সেই অভিযানের অনুপুঙ্খ বর্ণনা, বিজ্ঞান, ইতিহাস…

ছোটবেলায় আমরা রূপকথার পাতালপুরীর রহস্যময় জগতের কথা পড়েছি। তখন ভাবিনি, পাতাল বলতে আসলে আমরা কী বুঝি! আকাশ যে রকম আমাদের ঊর্ধ্ব দিকের দৃষ্টিসীমা নির্দেশ করে, সে রকম পাতাল কি আমাদের পৃথিবীর নিম্ন দিকের সীমানা? বড় হতে হতে আমরা জানলাম, অন্য সব গ্রহ-নক্ষত্রের মতো পৃথিবীও মহাশূন্যে ভাসমান সামান্য এক গোলাকার গ্রহ। এই ভাসমান পৃথিবী মানুষ এবং অন্য সব প্রাণী, উদ্ভিদ—সবকিছু নিজের পিঠের ওপরে নিয়ে প্রচণ্ড বেগে ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে ঘুরে আসছে সূর্যের চারপাশে নির্দিষ্ট নিয়মে অবিরাম। আমরা বুঝলাম, পাতাল খুঁজে বের করতে হলে আমাদের পৃথিবী খুঁড়ে ঢুকতে হবে তার ভেতরে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি কাজে লাগিয়ে মানুষ ইতিমধ্যে আকাশ জয় করে ফেলেছে। আকাশপথে ভ্রমণ এখন কোনো সমস্যাই নয়। পৃথিবী থেকে আকাশযান চলে গেছে সৌরজগতের সীমানা ছাড়িয়ে মহাশূন্যের অন্য অনেক নক্ষত্রলোকের দিকে, মহাবিশ্বের অজানা জ্ঞান অনুসন্ধানে। চাঁদের পিঠে হেঁটে এসেছেন পৃথিবীর ১২ জন। চাঁদে বসতি গড়ার কথা হচ্ছে, চেষ্টা চলছে মঙ্গলে যাওয়ার। পৃথিবীতে আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম চালানোর জন্য পৃথিবীর বাইরে স্থাপন করা হয়েছে শতাধিক স্যাটেলাইট। এগুলো সারাক্ষণ পৃথিবীর ওপর নজরদারি করছে। পৃথিবীর স্থলভাগের এমন কোনো জায়গা আর অবশিষ্ট নেই, যেখানকার কোনো ছবি তোলা হয়নি। শুধু মাটির উপরিভাগ নয়, গভীরেও চলছে অনুসন্ধান। মানুষ মাটি খুঁড়ে বের করে ফেলেছে তেল, গ্যাস, সোনা, রুপা, হীরা, তামা, কয়লাসহ প্রয়োজনীয় অনেক কিছু। ভূস্তরের শত শত মিটার নিচ থেকে তুলে আনছে বিশুদ্ধ পানি পান করার জন্য, শুকনা মৌসুমে চাষের জন্য। কিন্তু পৃথিবীর স্থল এবং অন্তরিক্ষ সম্পর্কে মানুষ যে পরিমাণ জ্ঞান আহরণ করেছে; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এত উন্নতির পরও সে তুলনায় স্থলভাগের দ্বিগুণের বেশি যে জলভাগ, সেই গভীর জলভাগ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান এখনো অনেক ক্ষেত্রেই ততটা গভীর নয়।

এর প্রধান কারণ প্রতিবন্ধকতা। মানুষ খালি চোখে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রগুলো পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি উদ্ভাবনের আগেই অনেক হিসাব-নিকাশ করে ফেলতে পেরেছিল মহাবিশ্ব সম্পর্কে। কিন্তু সাগরতলের গভীর পানির নিচে কী হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করা সহজ ছিল না। মানুষ পানিতে নেমে সাঁতার শিখেছে, ডুব দিতে শিখেছে। ডুব দিয়ে কতক্ষণ পানির নিচে নিশ্বাস বন্ধ করে থাকা যায়, দেখেছে। চেষ্টা করেছে যত দূর সম্ভব গভীরে যাওয়ার। কিন্তু অক্সিজেন ছাড়া পানির নিচে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। প্রয়োজনীয় কারিগরি ব্যবস্থা ছাড়া পানির গভীরে প্রচণ্ড চাপ সহ্য করা মানুষের শরীরের পক্ষে অসম্ভব। তা ছাড়া পানির অনেক নিচে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারে না বলে সেখানে ভীষণ অন্ধকার। সহনীয় গভীরতার নিচে সেই অন্ধকার, প্রচণ্ড চাপ এবং অক্সিজেনবিহীন পরিবেশে কোনো প্রাণী বাস করতে পারবে না বলেই ধারণা ছিল মানুষের। তাই যোগাযোগের প্রয়োজনে মানুষ যখন বিভিন্ন ধরনের জলযান তৈরি করে ফেলেছে, মহাসাগরগুলোর দ্বীপগুলো আবিষ্কৃত হয়ে গেছে, ধীরে ধীরে মনোনিবেশ করেছে পানির গভীরে। সেই ইতিহাস খুব বেশি পুরোনো নয়।

বৈজ্ঞানিকভাবে ডিপ সি বা গভীর সমুদ্র বলতে বোঝানো হয় পানির সেই গভীরতা, যেখানে পানির তাপমাত্রা আর সূর্যের আলোর ওপর নির্ভর করে না। পানিতে সূর্যের আলো পড়লে তাপমাত্রা কিছুটা বাড়ে। তার প্রভাব থাকে যত দূর পর্যন্ত সূর্যালোক প্রবেশ করে, তত দূর। ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বিশুদ্ধ পানির ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বাড়তে থাকলে কিংবা কমতে থাকলে পানির ঘনত্ব কমতে থাকে। পানির উপরিস্তর থেকে একটা গভীরতার পর পানির ওপর সূর্যালোকের আর কোনো প্রভাব থাকে না। এই গভীরতার নাম থার্মোক্লাইন স্তর (Thermocline Layer)। সাধারণত ২০০ মিটার থেকে ১ হাজার মিটার পর্যন্ত গভীরে এই স্তর থাকে। গভীর সমুদ্রে অনেক ক্ষেত্রে ১ হাজার ৮০০ মিটার গভীরতায় এই থার্মোক্লাইন স্তর থাকতে পারে। এই গভীরতায় পানির তাপমাত্রা শূন্য থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে।

পানির গভীরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাপ বাড়তে থাকে। ৩ হাজার মিটার গভীরে পানির চাপ প্রায় ১৫ হাজার ৭৫০ পিএসআই। অর্থাৎ প্রতি বর্গইঞ্চিতে চাপের পরিমাণ ১৫ হাজার ৭৫০ পাউন্ড। এটা পৃথিবীর বায়ুচাপের এক হাজার গুণের বেশি। এই চাপ সহ্য করার মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা উদ্ভাবনের আগপর্যন্ত গভীর পানিতে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান সম্ভব হয়নি।

এক্সপেডিশন চ্যালেঞ্জার-এ বিজ্ঞানীরা এ পথ ধরেই জাহাজে ঘুরে বেড়ান, নমুনা সংগ্রহ করেন ও পরিমাপ করেন সমুদ্রের গভীরতা

সাগরতলে অভিযানের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, প্রাচীনকালে দড়িতে পাথর বেঁধে পানির গভীরতা মাপার চেষ্টা করা হতো। পর্তুগিজ নাবিক ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান ১৫২১ সালে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতা মাপার চেষ্টা করেন। স্পেনের সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিজের সামুদ্রিক বাণিজ্য স্থাপনের লক্ষ্যে প্রশান্ত মহাসাগরে সমুদ্রযাত্রা করেছিলেন ফার্দিনান্দ ম্যাগেলান ১৫১৯ সালে। সমুদ্রপথে বিশ্বভ্রমণের সূচনা করেছিলেন তিনি। প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে সংযোগের জন্য নৌপথ আবিষ্কার করেছিলেন। তাই সেই সংযোগপথের নাম দেওয়া হয়েছে স্ট্রেইট অব ম্যাগেলান। প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতা মাপার জন্য তিনি ২ হাজার ৪০০ ফুট লম্বা দড়ির মাথায় ভারী লোহা বেঁধে জাহাজ থেকে পানিতে ফেলেছিলেন। ২ হাজার ৪০০ ফুট দড়ি দিয়েও তিনি সাগরের তল স্পর্শ করতে পারেননি। সে বছরই তিনি প্রতিপক্ষের হাতে নিহত হন। তাই আর চেষ্টা করার সুযোগ পাননি।

পরের ৩০০ বছর ধরে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হয়েছে সমুদ্রের গভীরতা মাপার। সমুদ্রের গভীরতা ভৌগোলিক কারণেই বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন। বিজ্ঞানীরা তখনো বিশ্বাস করতেন, থার্মোক্লাইন স্তরের নিচের গভীরতায় কোনো প্রাণী থাকতে পারে না। তাই শুধু নিষ্প্রাণ গভীর অন্ধকারের প্রতি তেমন কৌতূহল কারও ছিল না।

১৮১৮ সালে স্কটিশ রয়্যাল নেভি অফিসার স্যার জন রস আটলান্টিক মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিম অংশে সমুদ্র-জরিপ করেন। সমুদ্রের বিভিন্ন জায়গা থেকে সামুদ্রিক প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করেন তিনি। লম্বা তারের মাধ্যমে ধাতব খাঁচা পানিতে ফেলে বিভিন্ন গভীরতায় নমুনা সংগ্রহ চলছিল। তিনি আটলান্টিক মহাসাগরের প্রায় দুই হাজার মিটার গভীরতায় কিছু সামুদ্রিক পোকামাকড় এবং জেলি ফিশ পান। পূর্বধারণা অনুযায়ী, এই গভীরতায় কোনো প্রাণীর থাকার কথা নয়। তাহলে কি সেই ধারণা ভুল ছিল? এত চাপের মধ্যেও সমুদ্রে প্রাণ থাকা সম্ভব? বিজ্ঞানীদের কৌতূহল বেড়ে গেল। ছোট পরিসরে বিভিন্ন রকম সামুদ্রিক অভিযান চলতে থাকল।

কিন্তু বড় পরিসরে সামুদ্রিক বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান শুরু হয় ১৮৭০ সালে। ব্রিটিশ সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী চার্লস থমসন এবং উইলিয়াম কারপেন্টার প্রস্তাব করেন পৃথিবীর সব কটি মহাসাগরে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান শুরু করার। এর প্রায় ১০ বছর আগে থেকে তাঁরা স্কটল্যান্ডের সমুদ্রে এবং ফারো দ্বীপে গভীর পানিতে অনুসন্ধান চালিয়ে প্রমাণ পেয়েছেন, এক কিলোমিটারের বেশি গভীরে সামুদ্রিক প্রাণী আছে। এখন তাঁরা দেখতে চান, সমুদ্রের সর্বোচ্চ কত গভীরতায় সামুদ্রিক প্রাণী খুঁজে পাওয়া যায়। গেলে, সেগুলোর বৈশিষ্ট্য কী? একটি সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক জরিপ করতে চান তাঁরা। বিস্তারিত পরিকল্পনা তৈরি করে রয়্যাল সোসাইটি এবং ব্রিটিশ সরকারের কাছে তাঁরা আবেদন পাঠালেন।

ফরাসি কল্পবিজ্ঞানলেখক জুল ভার্নের সাগরতলের রহস্যজনক দৈত্যাকৃতি প্রাণীর অনুসন্ধানকেন্দ্রিক সামুদ্রিক অভিযানের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি প্রকাশিত হয় ১৮৭০ সালে।

সে সময় পৃথিবীর টেলিগ্রাফ যোগাযোগব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে টেলিগ্রাফ যোগাযোগের জন্য সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে টেলিগ্রাফের তার নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে টেলিগ্রাফের তার নিয়ে যেতে হলে সমুদ্রের গভীরতা কোথায় কত এবং পরিবেশ কী রকম, তা জানা খুব জরুরি। তাই থমসন ও কারপেন্টারের বৈজ্ঞানিক প্রস্তাবটি ছিল সময়োপযোগী। ব্রিটিশ সরকার তাঁদের বৈজ্ঞানিক প্রস্তাব অনুমোদন করে দুই লাখ পাউন্ড বরাদ্দ করল। সে সময়ের দুই লাখ পাউন্ড বর্তমানে প্রায় এক কোটি পাউন্ডের সমতুল্য। এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হলো রয়্যাল নেভির জাহাজ এইচএমএস চ্যালেঞ্জারের নামানুসারে—এক্সপেডিশন ‘চ্যালেঞ্জার’।

এদিকে কল্পকাহিনির জগতেও এর প্রভাব পড়ল। ফরাসি কল্পবিজ্ঞানলেখক জুল ভার্নের সাগরতলের রহস্যজনক দৈত্যাকৃতি প্রাণীর অনুসন্ধানকেন্দ্রিক সামুদ্রিক অভিযানের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি প্রকাশিত হয় ১৮৭০ সালে। এর চার বছর পর ১৮৭৪ সালে সাগরতলের অভিযান নিয়ে জুল ভার্নের আরও একটি কল্পকাহিনি দ্য মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড প্রকাশিত হয়। দুটো কাহিনিতেই দুর্ধর্ষ চরিত্র ক্যাপ্টেন নিমো ‘নটিলাস’ নামে যে সাবমেরিন ব্যবহার করেছিল, সেই সাবমেরিন পুরোপুরি কাল্পনিক ছিল না। প্রথম বাস্তব সাবমেরিনের নাম ছিল ‘নটিলাস’। মার্কিন ইঞ্জিনিয়ার রবার্ট ফুলটন ‘নটিলাস’ সাবমেরিন তৈরি করেছিলেন। ১৮০০ সালে তা প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে পানির নিচে চালানো হয়েছিল।

অবশ্য পানির নিচে চালানোর মতো নৌযানের ধারণা এবং প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল আরও প্রায় ২০০ বছর আগে। ১৬২০ সালে ওলন্দাজ (ডাচ) প্রকৌশলী করনেলিস ড্রেবেল বিশ্বের প্রথম সাবমেরিন তৈরি করেন। পরবর্তী ১৫০ বছর ধরে প্রয়োজনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে সাবমেরিন প্রযুক্তির। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রথমবার ব্যবহৃত হয়েছিল সাবমেরিন ‘টার্টল’। কচ্ছপের মতো পানির নিচে বিচরণ করতে পারত বলেই এ নাম। আমেরিকার কানেটিকাট রাজ্যের ডেভিড বুশনেল ছিলেন অসম্ভব দক্ষ একজন উদ্ভাবক। তিনি একাধারে ছিলেন চিকিৎসক, শিক্ষক, উদ্ভাবক ও প্রকৌশলী। তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাযোদ্ধা। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ১৭৭৫ সালে তিনি তৈরি করেছিলেন পানির নিচে থেকে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জাহাজে আক্রমণ করার উপযোগী সাবমেরিন ‘টার্টল’। ১৭৭৬ সালে নিউইয়র্ক হারবারে ব্রিটিশ জাহাজে আক্রমণ করার কাজে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয় এই সাবমেরিন। যদিও সেই আক্রমণ ব্যর্থ হয়। তবে টার্টল ইতিহাসে নাম লিখিয়ে ফেলে। ১৮০০ সালে রবার্ট ফুলটন যখন ‘নটিলাস’-এর নকশা করেন, তাতে ড্রেবেলের সাবমেরিন এবং বুশনেলের ‘টার্টল’-সাবমেরিনের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা ছিল। জুল ভার্নের কাল্পনিক সাবমেরিন ‘নটিলাস’ ছিল অনেকটাই বাস্তব নটিলাসের আধুনিক প্রতিফলন। কল্পকাহিনিতে অন্য যেসব যন্ত্রপাতি ও অনুষঙ্গের বর্ণনা আছে, সেসবের সঙ্গে বাস্তবের অনেক মিল। পানির নিচে শ্বাস নেওয়ার যন্ত্রপাতির প্রথম পেটেন্ট দেওয়া হয় ১৮৬৫ সালে ফরাসি প্রকৌশলী বেনট রকোয়ারল এবং অগাস্তি ডেনায়রসকে।

জুল ভার্নের টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি বইয়ের প্রচ্ছদ

চ্যালেঞ্জার অভিযানের জন্য ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি তাদের পুরোনো যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস চ্যালেঞ্জারকে কিছুটা পরিবর্তন করে ব্যবহারের জন্য দেয়। কাঠের তৈরি ২০০ ফুট লম্বা এই জাহাজ থেকে কামান এবং অন্যান্য যুদ্ধসরঞ্জাম সরিয়ে সেখানে ল্যাবরেটরি আর নমুনা রাখার ঘর তৈরি করে অভিযাত্রা শুরু হয় ১৮৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে। পোর্টসমাউথ বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে পরের চার বছর ধরে গভীর সমুদ্রপথে উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরের সব কটি দ্বীপ ভ্রমণ করে ১৮৭৬ সালে ইংল্যান্ডে ফেরে চ্যালেঞ্জার। প্রায় ৭০ হাজার নটিক্যাল মাইল পরিভ্রমণকালে ৩৬২টি জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছেন চ্যালেঞ্জারের বিজ্ঞানীরা। ধাতব জাল ও পাত্রের সাহায্যে তাঁরা সংগ্রহ করেছেন সামুদ্রিক প্রাণী, মাটি, পানি, কীটপতঙ্গ, মাছ ইত্যাদি নমুনা। ৫৬৩টি বাক্সভর্তি ২ হাজার ২৭০টি বড় কাচের পাত্র, ১ হাজার ৭৪৯টি ছোট কাচের বোতল, ১ হাজার ৮৬০টি কাচের টিউব এবং ১৭৬টি টিনভর্তি নমুনা নিয়ে ফিরেছিল চ্যালেঞ্জার। পরে আরও প্রায় ২০ বছর সময় লেগেছে সব কটি নমুনা পরীক্ষা করতে। পরীক্ষালব্ধ এসব ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে ৫০টি খণ্ডে, মোট ৩০ হাজারের বেশি পৃষ্ঠায়।

চ্যালেঞ্জার অভিযানে বিজ্ঞানী চার্লস থমসন ও উইলিয়াম কার্পেন্টারের তত্ত্বাবধানে যে অনুসন্ধান চালানো হয়েছিল, তাতে পৃথিবীর পাঁচটি মহাসাগরের বিভিন্ন স্থানের গভীরতা মাপা হয়েছে। গভীরতা মাপার জন্য সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল প্রায় ১৫০ মাইল লম্বা তামার তার। এই তারে ধাতব ওজন ঝুলিয়ে পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হতো। সে সময় গভীরতা মাপা হতো ফ্যাদমে। ৬ ফুটে এক ফ্যাদম। তারের প্রতি ফ্যাদমে একটি করে মার্কিং ফ্ল্যাগ লাগানো ছিল। কত গভীরতায় গিয়ে তারের মাথায় লাগানো ওজন সমুদ্রের তলে গিয়ে ঠেকেছে, তা দেখে সহজেই সেই জায়গার পানির গভীরতা মাপা যেত। চ্যালেঞ্জার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ গুয়াম ও পালাউর মাঝামাঝি জায়গায় খুঁজে পায় পৃথিবীর গভীরতম খাদ মারিয়ানা ট্রেঞ্চ। এই ট্রেঞ্চের গভীরতা মাপা হয়েছিল প্রায় আট কিলোমিটার।

ভূপদার্থবিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন মারিয়ানা ট্রেঞ্চের উৎপত্তির ইতিহাস। প্যাসিফিক ও ফিলিপাইন টেকটোনিক প্লেটের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল প্রায় ৬০ লাখ বছর আগে। সংঘর্ষের ফলে প্যাসিফিক প্লেট ঢুকে যায় সমুদ্রতলের ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার গভীরে। ফলে এমন গভীর খাদের সৃষ্টি হয়, যাতে পৃথিবীপৃষ্ঠের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টও ডুবে যাবে পুরোপুরি।

সমুদ্রের গভীরতা মাপার পদ্ধতির অনেক উন্নতি হয়েছে পরবর্তী সময়ে। ১৯১২ সালে টাইটানিক জাহাজ ডুবে যায় আটলান্টিক মহাসাগরে। পানিতে শব্দের প্রতিফলন কাজে লাগিয়ে বস্তুর অবস্থান এবং দূরত্ব হিসাব করার ইকো রেঞ্জিং পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে ১৯১৪ সালে। কানাডিয়ান উদ্ভাবক ও বেতার পদার্থবিজ্ঞানী রেজিনাল্ড ফেসেনডেন তাঁর তৈরি ফেসেনডেন অসিলেটর ব্যবহার করে পানির ভেতরের দূরত্ব ও গভীরতা নির্ণয়ের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তাঁর অসিলেটর পানির নিচে প্রচণ্ড শব্দ তৈরি করে পাঠায়। পরে সেই শব্দতরঙ্গ কোথাও প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এলে তা নির্ণয় করতে পারে। প্রেরণের সময় এবং গ্রহণের মধ্যবর্তী সময় হলো শব্দ যাওয়া এবং আসার মোট সময়। পানিতে শব্দের বেগ দিয়ে এই সময়কে গুণ করে শব্দের উৎস থেকে প্রতিফলক বস্তুর দূরত্ব নির্ণয় করা যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফেসেনডেনের ইকো রেঞ্জিং পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছিল ব্যাপকভাবে।

ইকো রেঞ্জিং পদ্ধতি থেকে উদ্ভাবিত হয়েছে আধুনিক সাউন্ড নেভিগেশন অ্যান্ড রেঞ্জিং বা সোনার (SONAR) পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে আলট্রাসাউন্ড পাঠিয়ে এবং তার প্রতিফলন শনাক্ত করে দুটো সময়ের পার্থক্যকে শব্দের বেগ দিয়ে গুণ করে দূরত্ব নির্ণয় করা হয়। সোনার পদ্ধতিতেই ডুবে যাওয়া টাইটানিক জাহাজের সঠিক অবস্থান খুঁজে বের করা সম্ভব হয়েছে আটলান্টিক মহাসাগরের ১২ হাজার ৬০০ ফুট গভীরে।

১৯৫১ সালে ব্রিটিশ জরিপ জাহাজ চ্যালেঞ্জার-২ আরও আধুনিক যন্ত্রপাতি নিয়ে চ্যালেঞ্জার অভিযাত্রার পুনরাবৃত্তি করে। সে সময় আবিষ্কৃত হয় পৃথিবীর গভীরতম স্থান—মারিয়ানা ট্রেঞ্চের সর্বনিম্ন অঞ্চল। দেখা যায়, এর গভীরতা আসলে ৩৬ হাজার ২০১ ফুট বা ১১ হাজার ৩৪ মিটার। মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতার চেয়ে ২ হাজার ১৮৫ মিটার বেশি। চ্যালেঞ্জার অভিযাত্রার নামানুসারে এই গভীরতম স্থানের নাম দেওয়া হয়েছে চ্যালেঞ্জার ডিপ।

পানির গভীরে অক্সিজেন নেই এবং চাপ অত্যন্ত বেশি। পানিতে স্কুবা ডাইভিংয়ের জন্য স্বয়ংক্রিয় শ্বাস-প্রশ্বাসের যন্ত্র একুয়ালাং আবিষ্কৃত হয়েছে ১৯৪৩ সালে।

পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গে হেঁটে উঠে গেছে, এমন মানুষের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি। পৃথিবী থেকে ৩ লাখ ৩৪ হাজার কিলোমিটার দূরে চাঁদের পিঠে গিয়ে হেঁটে এসেছেন ১২ জন। অথচ মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলদেশে গেছেন, এমন মানুষের সংখ্যা মাত্র তিন।

পানির গভীরে অক্সিজেন নেই এবং চাপ অত্যন্ত বেশি। পানিতে স্কুবা ডাইভিংয়ের জন্য স্বয়ংক্রিয় শ্বাস-প্রশ্বাসের যন্ত্র একুয়ালাং আবিষ্কৃত হয়েছে ১৯৪৩ সালে। ফরাসি বিজ্ঞানী জ্যাকস-ইয়েভিস কসটেউ এবং এমিল গ্যাংনান একুয়ালাং উদ্ভাবন করেন। একুয়ালাংয়ের সাহায্যে পানির গভীরে ভেসে বেড়ানো অনেকটাই সহজ হয়েছে সাহসী মানুষের জন্য। কিন্তু আরও গভীরে অনুসন্ধান চালানোর জন্য ডুবুরির সরঞ্জামের সঙ্গে দরকার আধুনিক সাবমেরিন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাবমেরিন প্রযুক্তির অনেক উন্নতি ঘটে।

১৯৬০ সালে মার্কিন নেভির তত্ত্বাবধানে সমুদ্রের গভীরে অভিযান এবং গবেষণা চলছিল। ‘প্রজেক্ট নেকটন’ নামে একটি প্রকল্প পরিচালিত হয় এ সময়। সাবমেরিনের মাধ্যমে সমুদ্রের অতল গভীরে গিয়ে সামুদ্রিক প্রাণ, তাপমাত্রা, চাপ ও শব্দের মিথস্ক্রিয়া কেমন—এসব বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানী প্রশ্নের উত্তর খোঁজে মানুষ এ প্রকল্পে। সাবমেরিন ট্রিয়েস্টি ছিল এই প্রকল্পের অংশ। ১৯৬০ সালের ২৩ জানুয়ারি প্রথম দুজন মানুষ—মার্কিন নেভির লেফটেন্যান্ট ডন ওয়ালশ ও এক্সপ্লোরার জ্যাকস পিকার্ড সাবমেরিন নিয়ে পৌঁছে যান মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলদেশে। মার্কিন নেভি এই সাবমেরিন কিনেছিল এ অভিযানের জন্য। সাবমেরিনের দেয়াল ছিল ৫ ইঞ্চি পুরু স্টিলের তৈরি, যেন ওটা ওই গভীরতায় পানির প্রচণ্ড চাপ (প্রতি বর্গইঞ্চিতে আট টন) সহ্য করতে পারে।

সমুদ্রের তলদেশে পৌঁছানোর আগে সাবমেরিনের হেডলাইটের আলোয় তাঁরা একটি শোল মাছের মতো মাছ দেখতে পান। তার মানে, সমুদ্রের অত গভীরেও মাছের শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার মতো অক্সিজেন আছে, খাদ্য আছে। সেখানে একটি মাছ আছে মানে আরও মাছ আছে, যেগুলো সমুদ্রের তলদেশে থাকে। তলদেশে পৌঁছে তাঁরা কোনো ছবি তুলতে পারেননি। কারণ, সাবমেরিনটি সমুদ্রের তলদেশ স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে বালু এবং কাদা ছিটকে চারপাশের পানি প্রচণ্ড ঘোলা হয়ে যায়। সমুদ্রের তলদেশে তাঁরা সাবমেরিনের ভেতর আধঘণ্টা ছিলেন। এরপর ওপরে চলে আসেন। যাওয়া-আসা মিলিয়ে প্রায় ২২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে তাঁদের সময় লেগেছিল প্রায় ৫ ঘণ্টা।

স্বয়ংক্রিয় মানুষবিহীন সাবমেরিনের মাধ্যমেও বর্তমানে সামুদ্রিক গবেষণা চলছে। সমুদ্রের তলদেশে নোঙর করা স্বয়ংক্রিয় ল্যাবরেটরি পানির গভীরে থেকে সমুদ্রের গভীরের অনেক প্রাকৃতিক ঘটনার দিকে নজর রাখছে, ডেটা পাঠাচ্ছে নিয়মিত।

পরের ৫০ বছরে আর কেউই যাননি মারিয়ানা ট্রেঞ্চের তলদেশে। ১৯৬০ সালে যে দুজন পৃথিবীর গভীরতম স্থানে গিয়েছিলেন, তাঁদের মৃত্যু হয়েছে অনেক বছর আগে। তাঁদের অভিযাত্রার ৫২ বছর পর যে সাহসী মানুষ পা রাখলেন পৃথিবীর গভীরতম স্থানে, তিনি আমাদের সবার পরিচিত জেমস ক্যামেরন। টার্মিনেটর, এলিয়েন, টাইটানিক, অ্যাভাটার ইত্যাদি বিপুল জনপ্রিয় সিনেমার পরিচালক জেমস ক্যামেরন যে একজন অভিযাত্রিক, তা আমরা অনেকেই জানি না। অনেক বছর ধরে তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন গভীর সমুদ্রে অভিযান চালানোর জন্য। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, রোল্যাক্স এবং নিজের টাকায় তিনি তৈরি করিয়েছেন অত্যাধুনিক সাবমেরিন ‘ডিপ সি চ্যালেঞ্জার’। ২০১২ সালের ২৬ মার্চ তিনি পৌঁছান মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীরতম স্থান চ্যালেঞ্জার ডিপে। তলদেশে পৌঁছানোর পর তিনি সাবমেরিন থেকে বের হয়ে পাঁচ ঘণ্টা ধরে পানির নিচে ছবি ও ভিডিও ধারণ করেন। পরে ডিপ সি চ্যালেঞ্জ নামে ত্রিমাত্রিক তথ্যচিত্র তৈরি করেন তিনি। এতে মারিয়ানা ট্রেঞ্চের পুঙ্খানুপুঙ্খ বাস্তব চিত্র দেখা সম্ভব হয় আমাদের। বর্তমানে জেমস ক্যামেরনই পৃথিবীর একমাত্র জীবিত ব্যক্তি, যিনি ৫৮ বছর বয়সে পৃথিবীর গভীরতম স্থানে পা রেখেছিলেন।

বর্তমানে সামুদ্রিক অভিযান ক্রমাগত চলছে আধুনিক রোবটের মাধ্যমে। রিমোটলি অপারেটেড ভেহিকল বা রোভ-এর সাহায্যে সমুদ্রের তলদেশে ক্যামেরা, সোনার এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে বসেই তথ্য সংগ্রহ করছেন। অটোনোমাস আন্ডারওয়াটার ভেহিকলস, অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয় মানুষবিহীন সাবমেরিনের মাধ্যমেও বর্তমানে সামুদ্রিক গবেষণা চলছে। সমুদ্রের তলদেশে নোঙর করা স্বয়ংক্রিয় ল্যাবরেটরি পানির গভীরে থেকে সমুদ্রের গভীরের অনেক প্রাকৃতিক ঘটনার দিকে নজর রাখছে, ডেটা পাঠাচ্ছে নিয়মিত। প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশ থেকে ৯৮০ মিটার উচ্চতায় পানির ভেতর ভেসে আছে মনটেরে এক্সিলারেটেড রিসার্চ সিস্টেম বা মার্স। এটি প্রশান্ত মহাসাগরের ভূমিকম্প রেখার পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করছে। তবু এখনো মহাসাগরের অনেক কিছুই অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে আগামী দিনের বিজ্ঞানীদের জন্য।

লেখক: শিক্ষক ও গবেষক, আরএমআইটি, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া

সূত্র: ১. উল্‌ফ এইচ বার্জার, ওশেন রিফ্লেকশন অব আ সেঞ্চুরি অব এক্সপ্লোরেশন, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস, বার্কলি, ২০০৯

২. ডিপসিচ্যালেঞ্জ ডটকম

৩. হেলমেনস্টাইন, অ্যান মেরি, পিএইচডি, ‘ডিপ সি এক্সপ্লোরেশন হিস্ট্রি অ্যান্ড টেকনোলজি’, থটকো, অগাস্ট ২৭, ২০২০: thoughtco.com/deep-sea-exploration-4161315

৪. অলোক ঝা, দ্য ওয়াটার বুক, হেডলাইন পাবলিশিং, লন্ডন, ২০১৬

৫. দ্য লোনলি প্ল্যানেট গাইড টু দ্য মিডল অব নোহয়্যার, অস্ট্রেলিয়া, ২০০৬