চরম প্রতিকূলতায় স্বচ্ছন্দ প্রাণ

পানি পান না করে একজন মানুষ সর্বোচ্চ কত সময় বেঁচে থাকতে পারে? সর্বোচ্চ ১০০ ঘণ্টা। কিন্তু একটি প্রাণী দশকের পর দশক পানির সংস্পর্শ ছাড়াই বাঁচতে পারে। এমনকি প্রাণীটি যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকতে পারে বছরের পর বছর। তীব্র তেজস্ক্রিয়তা কিংবা ভয়ংকর শীত—কোনো কিছুই কাবু করতে পারে না একে। এর নাম টার্ডিগ্রেড। আর বৈজ্ঞানিক নাম Milnesium tardigradum।

টার্ডিগ্রেড কিন্তু দশাসই চেহারার নয় একদমই। দৈর্ঘ্যে এক মিলিমিটারের মতো। আটটি পা, প্রতিটিতে রয়েছে নখওয়ালা থাবা। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে এদের গোলগাল ভালুকের আণুবীক্ষণিক সংস্করণ বলে মনে হয়। ১৭৭৩ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ইয়োহান অগাস্ট গুজ প্রথম এদের পর্যবেক্ষণ করেন। চলাফেরায় এরা অত্যন্ত ধীর। বিখ্যাত ইতালীয় বিজ্ঞানী স্পালাঞ্জানি টার্ডিগ্রেডদের অসম্ভব প্রাণশক্তির বিষয়টা প্রথম লক্ষ করেন।

টার্ডিগ্রেড পানি ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে দিনের পর দিন। কোষে কোষে যে বিভিন্ন বিপাকীয় প্রক্রিয়া চলে, সেসব প্রক্রিয়া পানি ছাড়া চলতে পারে না। কিন্তু পানি একান্ত না পেলে এদের ভেতরে এনহাইড্রোবায়োসিস নামের একটি প্রক্রিয়া সচল হয়। এই প্রক্রিয়ার সাহায্যে বিপাকক্রিয়াকে বলতে গেলে এক রকম বন্ধই করে দিয়ে বেঁচে থাকতে পারে টার্ডিগ্রেডরা। যখন পানির অভাব হয়, টার্ডিগ্রেডরা মাথা গুঁজে হাঁটু মুড়ে বলের মতো করে ফেলে নিজেদের শরীর। টার্ডিগ্রেডদের জীবনের এই দশাকে বলা হয় টান (Tun) দশা। এই দশায় টার্ডিগ্রেডের কোষে থাকা একটি বিশেষ ধরনের ম্যাট্রিক্স অণু চটচটে একটা পদার্থ তৈরি করতে পারে। এতে কোষের পানির অভাব দূর হয়। পানির অভাবে কোষের বিভিন্ন উপাদান নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। যেমন ডিএনএ, প্রোটিন কিংবা অন্যান্য প্রাণরাসায়নিক কাঠামোগুলো পানি না থাকলে ভেঙেচুরে যায়। অথচ টার্ডিগ্রেডের শরীরে চটচটে পদার্থের কারণে অদ্ভুতভাবে এই সব কোষীয় উপাদান রক্ষা পায়!

আবার যখন পানি ফিরে আসে, টার্ডিগ্রেড পায় অনুকূল পরিবেশ, তখন এই ম্যাট্রিক্স নষ্ট হয়ে যায়। তখন কোষীয় কিংবা প্রাণরাসায়নিক কাঠামোগুলো আগের মতো কাজ করা শুরু করে।

এরা কোথায় বাস করে, এ প্রশ্ন করার চেয়ে এরা কোথায় বাস করে না, এ প্রশ্ন করা বেশি যৌক্তিক। তাই পাহাড়-পর্বত, খেত–খামার, বনজঙ্গল, সমুদ্র—কোথায় নেই এরা? এমনকি বরফে ছাওয়া অ্যান্টার্কটিকাতে কিংবা মহাশূন্যেও এরা বেঁচে থাকতে পারে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণে টিকে থাকার অনন্য ক্ষমতার কারণে টার্ডিগ্রেডকে মহাশূন্যে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। ২০০৭ সালে কয়েক প্রজাতির টার্ডিগ্রেডকে পানিশূন্য অবস্থায় একটি কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে পাঠানো হয়। মহাজাগতিক বিকিরণের ভেতর থেকে ঘুরিয়ে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয় পৃথিবীতে। আবার পানির সংস্পর্শে রাখা হয়। ৩০ দিন পর এরা আবার স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। ২০১১ সালে আবার নাসার STS-134 মিশনে টার্ডিগ্রেড পাঠানো হয় মহাশূন্যে। এবারও সুস্থভাবে মহাশূন্য থেকে ঘুরে আসে। এরপর থেকেই টার্ডিগ্রেডের এই আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আরও গভীরভাবে আকর্ষণ করে। কীভাবে এরা তেজস্ক্রিয় বিকিরণ মোকাবিলা করে টিকে থাকে, বিষয়টা জানতে চান বিজ্ঞানীরা। সেটা ঠিকঠাকমতো জানতে পারলে হয়তো তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মধ্যে প্রাণীদের টিকে থাকার কোনো উপায় বের করতে পারবেন বিজ্ঞানীরা।

বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে কিছু সফলতাও পেয়েছেন। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ইনট্রিনসিক্যালি ডিস–অর্ডার প্রোটিনস বা আইডিপি নামের কিছু প্রোটিন–নির্দেশক জিন টার্ডিগ্রেডের এনহাইড্রোবায়োসিস প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই প্রোটিনগুলোর একটা মজার বৈশিষ্ট্য আছে। প্রায় সব প্রোটিনের একটি নির্দিষ্ট কাঠামো রয়েছে। এই কাঠামোর একটু এদিক-ওদিক হলেই প্রোটিনগুলো আর কাজ করে না। কিন্তু এরা তেমন নয়। এদের নির্দিষ্ট কোনো ত্রিমাত্রিক কাঠামো নেই। আইডিপি নির্দেশক জিনগুলো ব্যাকটেরিয়ার ক্রোমোসোমে ঢুকিয়ে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। তারা ব্যাকটেরিয়াতে সংশ্লেষিত আইডিপিগুলো ও ব্যাকটেরিয়াকে পানিশূন্য অবস্থায় টিকে থাকতে সাহায্য করে।

প্রাণীটির অক্সিজেন ছাড়া মহাশূন্যেও টিকে থাকতে পারার কারণে অনেকেই মনে করতেন, এরা হয়তো বহির্বিশ্বের কোনো গ্রহ থেকে এসেছে। তবে বেশির ভাগ বিজ্ঞানীর ধারণা, ব্যাপারটা এ রকম নয়। আর দশটা প্রাণীর মতোই টার্ডিগ্রেডও এই পৃথিবীতেই অভিযোজিত হয়েছে। বহু বছরের অভিযোজনের ফলে ১ হাজার ১০০টির বেশি টার্ডিগ্রেড প্রজাতির জন্ম হয়েছে।

মজার ব্যাপার হলো, টার্ডিগ্রেডের জিনগত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এদের জিনের সাড়ে সতেরো শতাংশই এসেছে অন্য প্রজাতি থেকে। সেই প্রজাতিগুলো মধ্যে রয়েছে উদ্ভিদ, ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস। সব মিলিয়ে স্বতন্ত্র অভিব্যক্তির মাধ্যমে টার্ডিগ্রেড হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য।

জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক টার্ডিগ্রেডের একটি প্রজাতির পুরো জিনোম সিকোয়েন্স বের করেন। এই গবেষণাতে দেখা যায়, এই প্রজাতির ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রজাতি থেকে পাওয়া ডিএনএ রয়েছে শতকরা এক দশমিক দুই ভাগ। যদিও জীববিজ্ঞানীদের কাছে এই সংখ্যা বিশেষ কিছু নয়। তারপরও মজার ব্যাপারটা হলো, এদের দেহের অধিকাংশ জিনই প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে সাহায্য করে। এ ছাড়া টার্ডিগ্রেডের কোষে ডিএসইউপি (Damage suppressor Protein) নামের আরেকটা প্রোটিন রয়েছে। প্রোটিনটি উচ্চ তেজস্ক্রিয় বিকিরণ থেকে টার্ডিগ্রেডের ডিএনএকে রক্ষা করে। এই প্রোটিন মানুষের দেহে স্থানান্তর করা যায় কি না, সে বিষয়টিও খতিয়ে দেখছেন বিজ্ঞানীরা। সেটা সম্ভব হলে মানুষও হয়তো ক্ষতিকর তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মধ্যেও টিকে থাকতে পারবে। ইতিমধ্যে পরীক্ষাগারে মানুষের কোষে এই প্রোটিন যুক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা। তাতে দেখা গেছে, কোষের বিকিরণ সহ্য করার ক্ষমতা প্রায় চল্লিশ শতাংশ বেড়ে গেছে!

বিজ্ঞানীরা আশাবাদী প্রাণীটিকে নিয়ে। হয়তো টার্ডিগ্রেডের প্রতিকূলতা সহ্য করার আরও কৌশল আবিষ্কার হবে। সেই কৌশলই কাজে লাগবে দুঃসময়ে। পৃথিবীর পরিবেশ আরও অবাসযোগ্য হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করছেন বিজ্ঞানীরা। তখন হয়তো টার্ডিগ্রেডের প্রতিকূলতা সহ্য করার কৌশল ব্যবহার করে মানুষ সেই দুঃসময়েও টিকে থাকতে পারবে। এমনটাই আশা বিজ্ঞানীদের।

লেখক: শিক্ষার্থী ও গবেষক, সিস্টেমস প্ল্যান্ট মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবরেটরি, পুসান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, দক্ষিণ কোরিয়া

সূত্র: উইকিপিডিয়া

*লেখাটি বিজ্ঞানচিন্তার ২০১৯ সালের মার্চ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়