সম্প্রতি ডায়ার উলফ নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পত্রিকায় একটা খবর ছড়িয়ে পড়েছে—প্রায় সাড়ে ১২ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত ডায়ার উলফ নাকি আবার ফিরে এসেছে! কেউ কেউ একধাপ আগে বেড়ে বলেছেন, জনপ্রিয় টিভি সিরিজ গেম অব থ্রোনস-এর সেই ডায়ার উলফ ফিরে এসেছে। মার্কিন কোম্পানি কলোসাল বায়োসায়েন্সেস তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে, ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর প্রথমবারের মতো কোনো বিলুপ্ত প্রাণীকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ ডায়ার উলফ আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু বিষয়টা কি সত্যিই তাই? এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন নিউ সায়েন্টিস্ট-এর পরিবেশবিষয়ক প্রতিবেদক মাইকেল লে পেজ। ম্যাগাজিনটির ২০২৫ সালের ১৯ এপ্রিল সংখ্যায় তিনি এ বিষয়ের ওপরে একটা প্রবন্ধ লিখেছেন। বিজ্ঞানচিন্তার পাঠকদের জন্য সেই প্রবন্ধটা তুলে ধরা হলো।
ডায়ার উলফ নিয়ে আসলে কি ঘটেছে
কলোসাল কোম্পানি বলছে, তারা তিনটি ধূসর নেকড়ে শাবককে জেনেটিকভাবে বদলে ডায়ার উলফে পরিণত করেছে। এদের দুটি ছেলে, একটি মেয়ে। ছেলে উলফ বা নেকড়ে দুটির নাম রেমাস ও রোমুলাস। ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে এদের জন্ম। আর মেয়েটির নাম খালিসি। এটি জন্মেছে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে। এই কোম্পানিই কিছুদিন আগে লোমশ ইঁদুর এবং তাসমানিয়ান টাইগারের জিনোম তৈরির কথাও ঘোষণা করেছে।
ডায়ার উলফ কী
এককালে ডায়ার উলফ নামে একপ্রজাতির বিশালদেহী নেকড়ে ছিল পৃথিবীতে। আজ থেকে প্রায় ১০ হাজার বছর আগে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় বাস করত। দেখতে অনেকটা বড় সাইজের নেকড়ের মতো ছিল। পুরো শরীর ঢাকা ছিল সাদা লোমে। গেম অব থ্রোনস নামে জনপ্রিয় টিভি সিরিজে এদের দেখানো হয়েছিল। এ জন্য একটা নেকড়ের নাম রাখা হয়েছে খালিসি। এই সিরিজের একটা চরিত্রের নাম এটা।
তাহলে ধূসর নেকড়ে আর ডায়ার উলফ কি এক জিনিস
না। অনেক দিন ধরে মনে করা হতো, এরা কাছাকাছি গোত্রের আত্মীয়। কিন্তু ২০২১ সালের এক ডিএনএ গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়ার উলফ আর ধূসর নেকড়ে শেষবার একসঙ্গে ছিল প্রায় ৬০ লাখ বছর আগে! আসলে শেয়াল, আফ্রিকান বন্য কুকুর বা ধোল প্রজাতির কুকুরেরা ধূসর নেকড়ের অনেক বেশি কাছের আত্মীয়, অন্তত ডায়ার উলফের চেয়ে বেশি।
তাহলে কলোসাল কীভাবে ডায়ার উলফ জন্ম দিল
কলোসাল বলছে, তারা ধূসর নেকড়ের জিনে মোট ২০ জায়গায় পরিবর্তন করেছে। এর ৫টি করা হয়েছে শুধু লোমের রং হালকা করার জন্য, মানে ডায়ার উলফের এখন যে রং দেখা যাচ্ছে, তার জন্য। বাকি ১৫টি পরিবর্তন করা হয়েছে ডায়ার উলফের জিন দেখে, যাতে ছানাগুলোর আকার, পেশি আর কান একটু আলাদা হয়।
অর্থাৎ, ধূসর নেকড়ে আর ডায়ার উলফের মধ্যে অনেক জিনগত পার্থক্য আছে।
কলোসাল কোম্পানির বেথ শাপিরো বলেছেন, তাঁদের দল ডায়ার উলফের পুরো জিনোম বের করেছেন এবং খুব তাড়াতাড়ি সেটা সবাইকে জানাবেন। এই দুটি প্রাণীর মধ্যে ঠিক কতটুকু বা কতগুলো পার্থক্য আছে, তা বলতে পারেননি শাপিরো। তবে তিনি জানিয়েছেন, দুটি প্রাণীর ডিএনএ ৯৯.৫ শতাংশ একই রকম। কিন্তু ধূসর নেকড়ের জিনোম প্রায় ২৪০ কোটি বেস পেয়ার লম্বা। এর মানে হলো, মাত্র ০.৫ শতাংশ পার্থক্য থাকা মানেও এদের জিনোমের লাখ লাখ বেস পেয়ারে অমিল রয়েছে।
তাহলে এই বাচ্চাগুলো কি আসল ডায়ার উলফ নয়
এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে প্রজাতি বলতে আমরা কী বুঝি, তার ওপর। শাপিরো বলছেন, প্রজাতি বোঝার নানা উপায় আছে। কেউ বিবর্তনের ইতিহাস দেখে বলেন, আবার কেউ দেখেন প্রাণীটা দেখতে কেমন। কলোসাল বলছে, ‘দেখতে যেহেতু ডায়ার উলফের মতো লাগে, তাই সেটাকেই আমরা ডায়ার উলফ বলছি।’ কিন্তু বিজ্ঞানী মহলে এই নিয়ে মতভেদ আছে।
এই নেকড়ে ছানাগুলোর ভবিষ্যৎ কী
এদের রাখা হয়েছে ৮০০ হেক্টর জায়গার একটা সংরক্ষিত এলাকায়। সেখানে বিজ্ঞানীরা এদের খেয়াল রাখছেন। তবে এদের প্রজননের মাধ্যমে নতুন ছানা পাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। মানে এদের দিয়ে আর বংশবৃদ্ধি করানো হবে না।
শেষ কথা হলো, ডায়ার উলফ এখনো ফিরে আসেনি। আসলে কখনোই হয়তো ফিরে আসবেও না। কলোসাল কোম্পানি কিছু ধূসর নেকড়ে ছানার জিন পাল্টে তাদের দেখতে ডায়ার উলফের মতো বানানোর চেষ্টা করেছে। এটা নিঃসন্দেহে একটা সাহসী বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা, কিন্তু একে বিলুপ্ত প্রাণীকে ফিরিয়ে আনা বলা যাবে না। এটা ঠিক যে বিজ্ঞান আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে জিন বদলে প্রাণীর গঠন পাল্টানো সম্ভব। কিন্তু ডায়ার উলফের মতো একটা সম্পূর্ণ আলাদা প্রজাতিকে ফিরিয়ে আনার জন্য হয়তো আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
