তিমিদের অনিচ্ছামৃত্যু

তারা কেন এটা করে, কেউ বলতে পারে না। কেবল বহুকাল ধরে ঘটনাটা ঘটতে ঘটতে প্রায় একটা নিয়মের মতো দাঁড়িয়ে যায়। নিয়মটা হলো, তিমিরা কিছুকাল পরপর সমুদ্রের ধারে এসে হাজির হবে। তারা অগভীর পানিতে আটকা পড়বে এবং মারা যাবে। কখনো হাতে গোনা কয়েকটা, কখনো শয়ে শয়ে। পৃথিবীর মানুষেরা আশ্চর্য হয়ে মৃত তিমিদের দিকে তাকিয়ে থাকবে।

গত ২১ সেপ্টেম্বর ভোরবেলায় তাসমানিয়ার পুলিশের কাছে একটা ফোন আসে, ম্যাকুয়ারি হারবারের তীরে আবারও অসংখ্য তিমি এসে মারা যাচ্ছে। খবরটা দ্রুত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে এবং মানুষ আরও একবার বিষাদগ্রস্ত হয়।

সবাই অবশ্য বিষাদে ডুবে কর্তব্য সমাপ্ত করে না। কেউ কেউ ছুটে যান এই ভেবে যে সব তিমিকে না হলেও কোনো কোনো তিমিকে হয়তো বাঁচানো যাবে। সন্ধ্যা নামার আগেই তাঁরা হারবারের ধারে জড়ো হন এবং সারি সারি তিমির দেহের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

ম্যাকুয়ারি হারবারের মৃত্যু

তিমিদের মৃত্যুর জন্য তাসমানিয়ার ম্যাকুয়ারি হারবার কুখ্যাত। গত ২১ সেপ্টেম্বর গভীর রাতের কোনো এক সময় থেকে তিমিরা আবারও এখানে জড়ো হতে শুরু করে। প্রথম দর্শনে অনুমান করা হয়েছিল, প্রায় আড়াই শ তিমি হারবারে আটকা পড়ে আছে। সেগুলোর অনেকগুলোই মারা গেছে, বাকিগুলো মারা যাচ্ছে। আড়াই শ সংখ্যাটা এত বড় যে চাইলেও সব কটা তিমিকে বাঁচানো সম্ভব নয়। তবু মানুষের একটা স্পৃহা থাকে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করার। পরদিন যখন উদ্ধারকাজ শুরু হয়, উদ্ধারকর্মীরা একে একে তিমিগুলোর কাছে যান। সৈকতে প্রথম যে তিমি পড়ে আছে, সেটা মৃত; পরেরটাও মৃত। পরপর আরও সাতটা মৃত। ১০ নম্বর তিমির কাছে গিয়ে দেখেন, সেটার ধড়ে কিছুটা প্রাণ আছে। উদ্ধারকর্মীদের মনে তখন আশা সঞ্চারিত হয়।

সমস্যা হলো, যে তিমিগুলো ম্যাকুয়ারি হারবারে এসে পড়ে ছিল—নিতান্ত হালকা কোনো প্রাণী তারা নয়। এ তিমিগুলো ৩ হাজার কেজি পর্যন্ত ভারী হতে পারে। এমন অতিকায় একটা প্রাণীকে ঠেলে সমুদ্রে নামিয়ে দেওয়া সহজ কাজ নয়। আরেকটা সমস্যা, সৈকত থেকে তিমিগুলোকে সরাসরি সমুদ্রে ঠেলেও দেওয়া যায় না, কেননা সৈকতের কাছে সমুদ্র খুবই অগভীর। জোয়ারের তোড়ে সেই তিমি আবারও তীরে এসে আটকে যাবে।

সুতরাং বালুতে উঠে যে তিমি আটকে গেছে, তার গায়ে সবার আগে ভেজা কাপড় জড়িয়ে দেওয়া হয়, যেন দেহ ঠান্ডা থাকে। এরপর দেহের নিচে মাদুরজাতীয় কিছু একটা বিছানো হয়, যেন তাকে টেনে একটা ট্রেইলারে তোলা যায়। সেই ট্রেইলারে করে তিমিকে নিয়ে নিরাপদ কোথাও ছেড়ে দেওয়া হয়, যেখান থেকে সে নিজেই গভীর সমুদ্রে ফিরে যেতে পারবে।

অবশ্য, এই কাজ করছিলেন খুব অল্প কিছু মানুষ—জনাবিশেকের একটা দল। কেননা সৈকতে আটকে যাওয়া খুব অল্প তিমিই বেঁচে থাকে। উদ্ধারকর্মীদের বেশির ভাগই নেমে পড়েছিলেন হারবারের অগভীর পানিতে। যেখানে শত শত তিমি আটকে আছে এবং বেঁচে আছে। সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে তারা ডুবে মারা যাবে।

কথাটা শুনতে খুবই আশ্চর্যের মনে হয়—তিমি পানিতে ডুবে যাবে। কিন্তু আসলেই তা–ই ঘটে। যেহেতু তিমিদের মাছের মতো ফুলকা থাকে না, তারা নিশ্বাস নেয় আমাদের মতো নাক দিয়ে। কিছুক্ষণ পরপর পানির ওপরে উঠে শোঁ করে বিশাল একটা নিশ্বাস নেয়, এরপর আবার গভীরে চলে যায়।

কিন্তু অগভীর পানিতে যদি কোনো তিমি এসে পড়ে—বিশাল দেহ নিয়ে সে আর সাঁতরাতে পারে না। তার নাকের ফুটো পানির নিচেই থাকে, আর যেহেতু সাঁতরে ওপরে উঠতে পারছে না, তাই নিশ্বাস নেওয়াও তার পক্ষে সম্ভব হয় না। বাতাসের অভাবে সে একসময় মারা যায়।

ফলে ম্যাকুয়ারি হারবারের অগভীর পানিতে যে তিমিগুলো ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছিল—উদ্ধারকর্মীরা তাদের ডোবার হাত থেকে বাঁচাতে বেশি সময় দেন।

উদ্ধারকাজের দ্বিতীয় দিনে, যখন এই আড়াই শ তিমি নিয়ে সবাইকে গলদঘর্ম হতে হচ্ছিল, সেই সময় খবর আসে, হারবারের দক্ষিণ তীরে আরও শ দুয়েক তিমি আটকে আছে। ততক্ষণে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে গেছে যে পরবর্তী কয়েক দিনে যত তিমির মৃত্যু আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হবে, সেটা অতীতে খুব বেশি মানুষকে করতে হয়নি।

২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১০৮টি তিমিকে বাঁচানো যায়। গোটা পাঁচেক তিমিকে গুলি করে মারা হয়। তাদের অবস্থা এত দুর্বল ছিল যে উদ্ধারকর্মীরা মনে করেছেন, তাদের বাঁচানোর চেষ্টা না করাটাই বরং মানবিক হবে। বাকি তিন শতাধিক তিমি তত দিনে এমনিতেই মারা গেছে। ম্যাকুয়ারি হারবারে ইতস্তত সেগুলোর মৃতদেহ ভেসে বেড়াচ্ছে।

পাইলট তিমিদের মোটামুটি পৃথিবীজুড়ে দেখা যায়, তবে গভীর সমুদ্রে। গভীরে যা ঘোরে, এদের নিয়ে গবেষণা কখনোই সহজ নয়। তাই এই তিমি সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। কেবল একটা ব্যাপারেই আমরা খুব ভালোমতো জানি, এরা কিছুকাল পরপর সমুদ্রের তীরে এসে ঝাঁপ দেয়। দলবল নিয়ে। নামে তিমি হলেও পাইলট তিমি আসলে একধরনের ডলফিন। যদিও ডলফিন শুনলে যে ছবি আমাদের মাথায় আসে, তার চেয়ে এরা ১০ গুণ; ক্ষেত্রবিশেষে ৩০ গুণ বড় হতে পারে! পাইলট তিমি সমুদ্রে দল বেঁধে ঘোরে। দল সাধারণত ছোটই হয়—২০ থেকে ৩০টির। তবে একেক সময় কয়েকটা দল মিলে সংখ্যাটা ১ হাজারেও গিয়ে দাঁড়াতে পারে। ধারণা করা হয়, অন্তঃপ্রজনন এড়ানোর জন্য তারা এই কাজ করে। দলের নেতৃত্বে থাকে একটি বয়স্ক স্ত্রী তিমি। বয়স্ক মানে অবশ্য শত বছর নয়—পাইলট তিমি বাঁচেই ৪০ বছরের মতো। পুরুষ তিমির আয়ু আরেকটু কম, ৩০ বছর। পৃথিবীতে এ মুহূর্তে কত পাইলট তিমি আছে, আমরা জানি না। তাই গণহারে তিমি মারা যাওয়ার প্রভাব আসলে তাদের ওপর কতখানি পড়বে, এ সম্পর্কে বলা এখন অসম্ভব।

যেগুলো বেঁচে থাকে

এত তিমির মৃত্যুর ঘটনা প্রায় পরাবাস্তব, কিন্তু সেটা কেবল সংখ্যার কারণে নয়। তিমি অসম্ভব সংঘবদ্ধ একটা প্রাণী। সমুদ্রে তারা দল বেঁধে ঘোরে, একজনের সাহায্যে আরেকজন এগিয়ে আসে। তিমিদের নিজস্ব ভাষা আছে, মাইলের পর মাইল দূর থেকে সেই ভাষায় তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে। মৃত বাচ্চাকে মুখে নিয়ে মা তিমি টানা ১৭ দিন ঘুরেছে—এমন দৃশ্যও দেখা গেছে। কাজেই একটা তিমি যখন তার দলের তিন–চতুর্থাংশকে ম্যাকুয়ারি হারবারে ধীরে ধীরে মারা যেতে দেখে—তার জন্য বিষয়টা অসহ্য যন্ত্রণার হয়। ঘটনাটা আরও ভয়াবহ হয় শিশু তিমিদের জন্য—যেগুলো আকারে ছোট হওয়ায় অগভীর পানিতে আটকা পড়েনি, কিন্তু সেগুলোর মায়েরা আটকে গেছে।

যেসব উদ্ধারকর্মী পানিতে নেমেছিলেন, তাঁরা বলেছেন, পানির নিচে সেটা একটা দুঃসহ পরিস্থিতি। শিশু তিমিগুলো হারবারজুড়ে একজন আরেকজনকে ডাকছে, বিপদের সংকেত পাঠাচ্ছে। যেগুলো ছাড়া পেয়ে সমুদ্রে চলে গেছে, সেগুলোর কয়েকটা সেই বিপদের ডাক শুনে আবার হারবারে ফিরে এসেছে।

কেন তিমিগুলো এভাবে মারা যায়

ম্যাকুয়ারি হারবারই যে একসঙ্গে সবচেয়ে বেশি তিমির মৃত্যু দেখেছে, ব্যাপারটা এমন নয়। ১৯১৮ সালে নিউজিল্যান্ডের চ্যাথাম দ্বীপে প্রায় ১ হাজার তিমি একসঙ্গে আটকা পড়েছিল। কিন্তু তিমিগুলো কেন এভাবে দল বেঁধে মৃত্যুর হাতে নিজেদের ছেড়ে দেয়? ঠিক এ প্রশ্নটাই সবার মাথায় ঘুরছে এবং এই প্রশ্নের উত্তর কেউ জানে না।

এর একটা বড় কারণ, এ ধরনের তিমি সম্পর্কে আমরা খুব কম জানি। তিমিগুলোর যেই প্রজাতিটা কিছুকাল পরপর এভাবে মারা যায়, তাদের নাম পাইলট তিমি। এরা আসলে ঠিক তিমিও নয়। প্রধানত ডলফিনের গোত্রভুক্ত সদস্য এরা। এই পাইলট তিমিদের স্বভাব-চরিত্র-বৈশিষ্ট্য নিয়ে খুব সামান্য কিছু গবেষণা হয়েছে। সেসব গবেষণা থেকে মৃত্যুসংক্রান্ত প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর পাওয়া কঠিন। তবু বিজ্ঞানীদের বেশ কয়েকটি অনুমান আছে।

নিউজিল্যান্ডের ম্যাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিটেশান ইকোলজি রিসার্চ গ্রুপের সদস্য ড. এমা বেটির মতে, ম্যাকুয়ারিতে তিমির মৃত্যুর দায় হয়তো হারবারটারই। গভীর সমুদ্রে তিমি যেভাবে শব্দের প্রতিধ্বনি শুনে পথ চলতে পারে, হারবারের ভেতরে সেটা কঠিন। সৈকতের কাছাকাছি চলে এলেও তারা ঠিক দূরত্বটা ধরতে পারে না। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হুড়মুড় করে সমুদ্রের পাড়ে উঠে পড়ে। উপরন্তু যারা ভেতরে ঢুকেছিল, তারা চারদিকে বিপৎসংকেত পাঠায়, ফলে তাদের সাহায্য করতে আরও বেশি তিমি হারবারে ঢুকে পড়ে। পুরো ব্যাপারটা তিমির জন্য একধরনের প্রাকৃতিক ফাঁদ।

তাসমানিয়া সরকারের মেরিন কনজারভেশন প্রোগ্রামের জীববিজ্ঞানী ক্রিস কারলিওন বলেন, তিমির দলটা খাবারের সন্ধানে তীরের কাছাকাছি এসেছিল—এমন একটা অনুমান করা যায়। কিন্তু প্রকৃত কারণ হয়তো কখনোই জানা যাবে না।

মানবসৃষ্ট সোনার প্রযুক্তি বা সাইসমিক গবেষণার শব্দে হয়তো তিমিরা বিভ্রান্ত হয়ে এই কাজ করে—এমন সম্ভাবনা মেনে নিতে অবশ্য বেটি নারাজ। ১০০ বছর আগে নিউজিল্যান্ডে যখন ১ হাজার তিমি আটকা পড়েছিল, তখন এসব প্রযুক্তি ছিল না। অতীতের উদাহরণ থেকে তিনি মনে করেন, পুরো ব্যাপারটার কোনো প্রাকৃতিক কারণ আছে, যেটা আমাদের এখনো জানা নেই।

যে তিমিগুলো বেঁচে গেছে, সেগুলোর ব্যাপারে কারলিওন বলেন, এমন ঘটনার পর তিমিগুলো সাধারণত ছোট্ট আরেকটা দল তৈরি করে নেয়। ম্যাকুয়ারি হারবারের ঘটনা দলের প্রতিটি তিমির জন্যই দুর্বিষহ—সন্দেহ নেই। তবু আশা করা যায়, এরা ধীরে ধীরে ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, কম্পিউটারবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস