পাতিঘুঘুর কথা

মাঠের ভেতর সারি সারি জিকলগাছ। সেগুলোর একটাতে তিলাঘুঘুর বাসা। সে বাসায় উড়ু-উড়ু দুটি ছানা। ওই বাসাটা সরু লতা, ঘাস, শিকড় ইত্যাদি দিয়ে বানিয়েছিল ঘুঘু দম্পতি—টানা ৫ দিনের কষ্টে। তিনজন বালকের নজরে পড়ে গিয়েছিল বাসাটি। খুব খুশি তারা। ওই বাসায় একজোড়া সাদা ডিম পাড়বে। তারপর দুজন মিলে তা দিয়ে ১২-১৭ দিনে ছানা ফোটাবে। সেই ছানারা থাকবে একেবারে নেংটুপুটু, অর্থাৎ শরীর থাকবে পালকবিহীন। চোখ থাকবে বন্ধ। ৪–৫ দিন পর চোখ ফুটবে। মা-বাবা ঘুঘু প্রথম ৩–৪ দিন পেট-গলা থেকে উগরে ঘুঘুর দুধ পান করাবে। একে বলা হয় Pigeon Milk। এই দুধ উত্পন্ন হয় ঘুঘু কিংবা কবুতরের গলার থলিতে। ক্ষীরের মতো অর্ধতরল এই দুধ। এই খবর বালক তিনজন ভালোভাবে জানে।

প্রতিবছর এই মাঠের নানান রকম গাছ ও ঝোপঝাড়ে অনেক ঘুঘুর বাসা হয় ফাল্গুন থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত। বহু তাজা ডিম দুষ্টু ছেলের দল গাছের গায়ে টুকুস করে আঘাত করে ভেঙে ভেতরের কাঁচা কুসুম টুপুস করে গিলে খায়। অনেকে ছানা নিয়ে বাড়িতে খাঁচায় পোষে। আবার পেশাদার-নেশাদার বা শৌখিন ঘুঘুশিকারিরাও পুরুষ ছানা নিয়ে খাঁচায় পোষে। তারপর নানান রকম ট্রেনিং দিয়ে পাকা শিকারি বানিয়ে ফেলে। ঘুঘুর প্রজনন মৌসুমে অথবা অন্য মৌসুমে বাঁশের ৪–৫টি নল পরস্পর গেঁথে খাঁচাটা তুলে দেয় গাছের উঁচু ডালে। দূরে বসে শিকারি শিস দেয় বা অন্য কোনো শব্দ করলেই খাঁচাবন্দী ঘুঘুটি গলা ফুলিয়ে মাথা দুলিয়ে ডাকতে শুরু করে। বুনো পুরুষ ঘুঘু তার এলাকায় অন্য কোনো পুরুষ ঘুঘুকে মোটেই সহ্য করতে পারে না। তেড়েমেড়ে ধেয়ে আসে। খাঁচার সামনে থাকে চমত্কার আরেকটি ছোট খাঁচা। বুনো ঘুঘু খাঁচাবন্দী ঘুঘুকে আক্রমণ করার জন্য পাগল হয়ে ওঠে। ওই অবস্থাতেই সে মরণখাঁচায় পা ফেলেই বন্দী হয়ে যায়। ওই ছোট খাঁচাটি নিয়েই প্রবাদ আছে ‘ঘুঘু দেখেছ, ঘুঘুর ফাঁদ দেখোনি’। শিকারি ঘুঘু ২–৫ হাজার টাকায় বিক্রিও হয়। দুষ্টু ছেলের দল চেষ্টা করে পুরুষটিকে শিকারি বানাতে। সে কত রকম হাস্যকর কসরত! দিনরাত ঘুঘুর ছানা নিয়ে বন-বাগান ও মাঠে ঘোরা! শিকারি করতে পারলেই ২-৫ হাজার টাকা ইনকাম! ঘুঘুশিকারিরা কিনে নেবে।

এই তিন বালকও যখন বুঝল ২–৩ দিনের ভেতর জিকলগাছের ছানারা উড়ে যাবে, তখন এক সন্ধ্যায় তিনজনে জিকল তলায় আসে ছানা চুরি করতে। দিনেও নেওয়া যেত ছানা, কিন্তু তাদের লোভ ছানা বুকে নিয়ে বসা মাকেও ধরবে (ওরা জানত না ছানাদের শরীরে পালক গজালে মা বা বাবা আর রাতে ছানাদের বুকে নিয়ে বসে না)। একটি ছেলে চুপি চুপি গাছে চড়ে, অতি সাবধানে হাত বাড়িয়ে হাতে কিছু ঠেকতেই ধরল জোরসে চেপে, অমনি সে বুঝতে পারল সাপের গলা ধরেছে; সঙ্গে সঙ্গে মরণচিত্কার দিয়ে গাছতলায় ধপাস। উঠে দৌড়। চিত্কার-চেঁচামেচিতে বহু মানুষ ছুটে আসে। লাঠিসোঁটা ও টেঁটা দিয়ে কেউটে সাপটিকে গাছ থেকে নামিয়ে মেরেও ফেলা হলো। ভাগ্য ভালো যে একটি ছানা ও আগে গিলেছিল। আরেকটিও কেবল গিলতে শুরু করেছিল। না হলে বালককে ছোবল দিতই। ছোবল দিলে সেদিনের সেই বালক আজ আর বেঁচে থেকে এই লেখাটি লিখতে পারত না।

ঘটনাটি ১৯৬৫ সালের। ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন।

এই ঘুঘুটির নাম পাতিঘুঘু। তিলাঘুঘু, ছিটঘুঘু নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Spotted Dove. বৈজ্ঞানিক নাম Streptopelia chinensis. দৈর্ঘ্য ৩০ সেন্টিমিটার। ওজন ১২০ গ্রাম। ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশেই দেখা মেলে এদের। এরা নির্জন এলাকায় থাকতে ও চরতে পছন্দ করে। তাই আরও একটি প্রবাদ আছে ‘ভিটেয় ঘুঘু চরানো’। এদের ডাক খুব সুন্দর ও বেশ জোরালো। কুর কুর করুর শব্দে অনেকক্ষণ ধরে ডাকে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষটার ডাকাডাকি বহুগুণে বেড়ে যায়। এ সময় পুরুষটি পতপত ডানায় ওপরের দিকে খাড়া উঠে যায় আনন্দে, আবারও নামে। পোষা পুরুষ ঘুঘুর সামনে আয়না ধরলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে প্রবল বিক্রমে খাঁচা ভেঙেই আক্রমণ করতে চায়। গলা ফুলিয়ে সে কী ডাকাডাকি, হাঁকাহাঁকি! দেখলে হাসি পায়।

এদের মূল খাদ্য নানান রকম শস্যদানা। মাটিতে হেঁটে হেঁটেই এরা খাবার খায়। লবণের চাহিদা পূরণের জন্য এরা মাটিও খায়। ঝাঁকে চলে, একাও চলে, আবার দুটিতে মিলেও চরে। এরা আমাদের অতিপরিচিত পাখি। মাথাটি এদের হালকা বাদামি। ঘাড়জোড়া অসংখ্য সাদা ছিট। বুক-পেট সাদাটে বাদামি। পিঠ বাদামি, তার ওপর অসংখ্য সাদা ছোপ। ঠোঁট শ্লেটরঙা কালো, পা গোলাপি।

লেখক: পাখিবিশারদ