মোহনীয় মোহনচূড়া

মাটি থেকে ৭–৮ ফুট ওপর দিয়ে ছন্দে ছন্দে দুলতে দুলতে উড়ে আসছে একটি পাখি। দুষ্টু এক বালকের চোখে পড়ে দৃশ্যটা। বালক কৌতূহলী হয়ে ওঠে। পাখিটি বারবার গোলাকার পাখা দুখানা মেলছে, আবার খুলছে। মেলে থাকা পাখার দুই প্রান্ত ঘাড়ের দুপাশে চমত্কার নকশা আঁকা দুখানা হাতপাখার মতো লাগছে। মাটিতে নামার আগে পাখিটি শূন্যে এক পাক ঘোরে। পাখা ও লেজের ওপরের সাদা-কালো ডোরা দাগ দেখে বালক মুগ্ধ হয়। কী সুন্দর পাখি রে! হাঁটতে হাঁটতে পাখিটা মাথার ওপর যেন অলৌকিক ফুল ফোটায় একটা। একেবারে জাপানি হাতপাখার মতো দেখাচ্ছে ওটাকে।

বালক এবার নিজের অজান্তেই ক্রলিং করতে শুরু করল। যদি ধরা যায়! না, কাছাকাছি যেতেই উড়াল দেয় পাখিটি। অনেকটাই ‘হিপ হিপ হুররে, চলে যাই দূররে’ ধরনের ডাক ছাড়তে ছাড়তে হারিয়ে যায় দূরে। গলাটা বেশ মোলায়েম ও সুরেলা। ঠিক এ রকম দৃশ্যের অবতারণা রাজধানী ঢাকা মহানগরের পার্ক-উদ্যান-প্রাঙ্গণ-খোলা জায়গাসহ দালানকোঠার ছাদেও হতে পারে। কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকা মতিঝিল-দিলকুশার ভোরবেলার নির্জন-নিরিবিলি রাজপথ, ফুটপাতসহ মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান-চিড়িয়াখানায়ও পাখিটিকে পিলপিল পায়ে হাঁটতে দেখা যায়। বৃষ্টিভেজা রাজপথেও ঘুরতে পারে খাবারের তল্লাশে।

২০১৮-এর জুলাইয়ের এক ভোররাতে মুগদাপাড়া থেকে ঢাকা মেডিকেলে যাওয়ার পথে হাঁটছি। শিশু একাডেমী পার হতেই একজোড়া পাখি কার্জন হলের দিক থেকে উড়ে এসে বসে দোয়েল চত্বরের দোয়েল পাখির পিঠে। এই রাজধানীতে ওদের দেখা মেলে। শরৎ থেকে মাঘ পর্যন্ত বেশি দেখা যায়। রাজধানীবাসী অন্য পাখিরা এদের কিছুই বলে না। তাই বলে পাখিটিকে ভয় পায় বা সমীহ করে, এমনটা ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় না আমার। এর পেছনে গোপন-গূঢ় কোনো রহস্য থাকতে পারে! তবে শরৎ-শীতের পরিযায়ী খঞ্জন পাখিরা মাটিতে বা ছাদে নেমে এই পাখিটিকে দেখলে তেড়েফুঁড়ে এগিয়ে যায়। কিন্তু পাখিটি যে–ই না মাথার ফুল ফুটিয়ে দেয়, অথবা মেলে ধরে দুপাখার ছাতা দুখানা, খঞ্জনরা তখন ঘাবড়ে যায়। খঞ্জন আর এই পাখিদের খাদ্যতালিকা মোটামুটি এক। এই দুই জাতের পাখিই মাটিতে বা ছাদে হেঁটে হেঁটে খাদ্যের সন্ধান করে। খঞ্জনরা নান্দনিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করে তাদের লম্বা লেজটা অনবরত শিল্পিত ছন্দে নাচিয়ে মাথার ওপরে ফুল ফোটানো পাখিটির নাম মোহনচূড়া। আরও অনেকগুলো নাম আছে, হুপো, হুদহুদ, পাংখা পাখি, সোনায়মান পাখি, মাটিঠোকরা ও বালুঠোকরা। আকার-গড়ন ও চালচলনে কাঠঠোকরার সঙ্গে মেলে, তাই ঠোকরাটা এসে গেছে। ইংরেজি নাম কমন হুপো। বৈজ্ঞানিক নাম upupa epops। এদের একটি উপপ্রজাতি (উপুপা সেইলোনেনসিস) আমাদের একান্তই আবাসিক পাখি। epops আমাদের দেশের পরিযায়ী পাখি। আবাসিকটার অর্থ হচ্ছে আমাদের দেশে বাসা করে ডিম-ছানা তোলে।

আমার স্নেহভাজন প্রাণিবিজ্ঞানী মনিরুল খান। তিনি টেলিফোনে জানিয়েছেন, সংখ্যায় আবাসিকটাই বেশি। অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ২০০৪ সালের ১৪ নভেম্বর ‘উদ্বাস্তু আবাবিল’ নামে আমার একটি দীর্ঘ লেখা ছাপা হয়েছিল। সেই লেখাতে ঢাকা শহরে আমার দেখা দুটি মোহনচূড়ার বাসার কথা উল্লেখ ছিল। আমার লেখা বাংলাদেশের পাখি, দ্বিতীয় খণ্ড (প্রকাশক: বাংলাদেশ শিশু একাডেমী, ঢাকা। প্রকাশকাল ২০০০ সাল) বইয়েও আমার কৈশোরে দেখা মোহনচূড়ার বাসা ও পাঁচটি ডিমের বর্ণনা আছে। আমি বেশ কবার এদের মাথার চূড়া বা ফুলসহ ঠোঁটের মাপ নিয়েছি। গড় মাপ সোয়া ৫ সেমি। দূরে দাঁড়িয়ে হাতের আঙুলে তুবড়ি বাজালে ওরা মাথার ফুলটি প্রস্ফুটিত করে। সামনে সাপ-বেজি-গুইসাপ-গিরগিটি পড়লেও এরা ফুল ফোটায় ও ঠোঁটটি উঁচু করে, ঠোঁটে ঠোঁটে ‘ঠোঁটতালি’ বাজিয়ে সাবধানবাণী ঘোষণা করে। খোঁড়লের ভেতর সম্মিলিত কণ্ঠে ফোঁসফোঁস আওয়াজ তোলে, যাতে শত্রুরা গোখরা সাপের ফোঁসফোঁসানি ভেবে ঘাবড়ে যায়। এটা আত্মরক্ষার একটা মোক্ষম অস্ত্র ওদের। মোহনচূড়া বা হুপোর দৈর্ঘ্য ৩১ সেমি। ওজন ৬৫ গ্রাম।

মাথার ওপরে ফুল ফোটানো ও পাখা তৈরি করতে পারা পাখি বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই। ঠোঁটের গোড়া থেকে শুরু করে কপাল ও মাথার তালু হয়ে ১৫ থেকে ১৬টি লম্বা–চওড়া পালক সুবিন্যস্তভাবে সাজানো। প্রতিটি পালকের ডগায় চওড়া-কালো রং মাখানো, মনে হয় ধ্রুপদি কোনো শিল্পীর অলৌকিক তুলির পরশ! পালকগুলোর নিচের দিকটা লালচে-কমলা, ঘাড়-মাথা-বুক-পেটের প্রায় পুরোটাসহ ঘাড়ের উপরিভাগের রংও ওই লালচে-কমলা। পেটের নিচের অংশ সাদাটে। লম্বা-সুচালো কালচে রঙের ঠোঁটটির অগ্রভাগ নিম্নমুখী বক্র। খাটো দুই পাখার রং কালচে-ধূসর। এদের দুই পাখার উপরিভাগে পর্যায়ক্রমে আড়াআড়ি চওড়া টানের শিল্পিত-সৌন্দর্য এমনভাবে সুবিন্যস্ত যে দেখে মনে হয় রাজপথে পথচারী পারাপারের জেব্রা ক্রসিং।

পাখার প্রান্তের ঠিক আগে অবশ্য চওড়া-কালো রং থাকে। লেজের উপরিভাগ কালো, তবে লেজের প্রান্তের ঠিক আগে চওড়া ও লেজের প্রান্তে আড়াআড়ি সাদা রেখা টানা। লেজের সুবিন্যস্ত পালকসংখ্যা ১০। মাথার ফুল ও পাখা এরা বন্ধ করে রাখে, ভয়ে-উত্তেজনায় ফুল ও পাখা মেলে দেয়। খাবার এরা মূলত সংগ্রহ করে মাটি-চরভূমি-মাঠ–ঘাট-নদীচর-মোহনায় হেঁটে হেঁটে। প্রয়োজনে পিলপিল পায়ে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় হাঁটতে পারে। তেমনি পারে দৌড়াতে। মূল খাদ্য নানা ধরনের পোকামাকড়, যেমন সুতোপোকা, বিভিন্ন ধরনের বিটল, শুঁয়াপোকা, ঝিঁঝি, ঘাসফড়িং ইত্যাদি। কেঁচো ও পুঁইয়ে সাপ খায় নুডলসের মতো।

চমত্কার দৃশ্য আমি গ্রামবাংলায় দু-চারবার দেখেছি। শীত বা বসন্তের বাতাসে মাটিতে পড়ে থাকা ঝরাপাতার স্তূপ বাতাসে গড়াতে গড়াতে জড়াতে জড়াতে এগিয়ে যাচ্ছে দ্রুতবেগে। আর ওই শুকনো পাতার ঢেউয়ের পেছনে পেছনে ছুটছে মোহনচূড়া পাখিরা, লম্ফঝম্ফ দিয়ে খাচ্ছে পোকামাকড়। যারা ঝরাপাতার পাকে পড়ে উড়ে পালাতে চাইছে। বাসা করে গ্রীষ্ম থেকে বর্ষাকালের শুরু পর্যন্ত। গাছের খোঁড়ল-কোটর-দালানকোঠার ফাঁকফোকরে ঘাস-পাতা-লতা-শিকড়-পালক ইত্যাদি দিয়ে বাসা সাজিয়ে ছয়-সাতটি ডিম পাড়ে। স্ত্রী পাখিটা একাই ১৮ থেকে ২২ দিন তা দিয়ে ছানা ফোটায়। তা দেওয়ার সময় পুরুষটি বাসায় এনে খাওয়ায় স্ত্রী পাখিটিকে পরম সোহাগে। সদ্য বাসা ছেড়েছে এবং উড়তে শিখেছে, এমন পাঁচ–ছয়টি ছানা নিয়ে মা-বাবা মাটির ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে—সেই দৃশ্য অলৌকিকই বলা যায়, এত সুন্দর দৃশ্যের দর্শন কি সহজে মেলে অন্য কোথাও!

লেখক: পাখিবিশারদ