মানুষ কেন ঘাস খায় না

মানুষের ঘাস খাওয়ার প্রশ্নটা ব্যক্তিগত কিছু না। মানুষ ঘাস খায় না, আমরা সবাই জানি। ঘাস খাওয়ার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু কাউকে বোকা বোঝাতে আমরা ঘাস খাওয়ার কথা বলি। রেগে গেলে কেউ কেউ বলে বসে, ‘বুঝতে পারছ না, তুমি কি ঘাস খাও?’

বোকা প্রাণী ঘাস খায়। যেমন গরু-ছাগল। মানুষের ক্ষেত্রে ঘাস খাওয়ার কথা কেউ মাথায় আনে না। তবু আমরা জানতে চাই, মানুষ ঘাস খায় না, কিন্তু কেন? আমরা এর পেছনের বিজ্ঞানটুকু জানতে চাই।

আমরা কত রকম শাক-সবজি খাই। কিন্তু ঘাস কোনো শাকের মধ্যে পড়ে না। ঘাস একদম অখাদ্য, এমন নয়। গরমের দিনে সদ্য কাটা ঘাসের একটা মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যায়। এমন গন্ধ মন ভালো করে দেয়। কখনো মনে হতে পারে, সালাদে এই তাজা ঘাস যদি ব্যবহার করা হয়, তবে মন্দ হবে না। বৃষ্টিতে ভেজা সবুজ ঘাস দেখতে তো লেটুস, ব্রকলি বা পালং শাকের মতো। আর অনেক প্রাণী যেহেতু ঘাস খায়, তাহলে এটা নিশ্চয়ই স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ না।

অন্যদিকে গরু, ছাগল বা হরিণের মতো চড়ে বেড়ানো প্রাণীদের বিশেষ পরিপাকতন্ত্র আছে। এসব প্রাণীর পাকস্থলিতে আছে চারটি প্রকোষ্ঠ। চারটির প্রথমটিতে আছে রুমেন নামের একধরনের ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়া ঘাসের সেলুলোজ ভেঙে হজম করতে পারে।

আসলে ব্যাপারটা এত সহজ নয়। গরু বা ছাগলের মতো তৃণভোজী প্রাণীরা ঘাস খেয়েই দিব্যি বেঁচে থাকে। কিন্তু মানুষ যদি কেবল ঘাসের ওপর নির্ভর করে থাকতে চায়, তাহলে খুব দ্রুত সে অসুস্থ হয়ে পড়বে। কারণ মানুষের পক্ষে ঘাস খাওয়া অসম্ভব না হলেও খাদ্য উৎস হিসেবে এর অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

ঘাসে আছে শর্করা, প্রোটিন, ফাইবার, খনিজ পদার্থ, ফলিক অ্যাসিড ও ভিটামিন। আমাদের শরীর গঠন ও শক্তি পেতে এগুলোর প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে ঘাস থেকে এগুলো আমরা গ্রহণ করতে পারি না। গরু-ছাগল পারে। তাই গরু-ছাগল ঘাস খেলেও মানুষ ঘাস খেতে পারে না।

হজম ও পুষ্টির সমস্যা

মানুষ ঘাস হজম করতে পারে না। ঘাস না খাওয়ার এটাই মূল কারণ। ঘাসের গঠনের বেশির ভাগ অংশ পানি। এ ছাড়া থাকে লিগনিন নামে একটি প্রোটিন। লিগনিন কাঠ বা গাছকে দৃঢ় এবং স্থিতিশীল করে। মানুষের পরিপাকতন্ত্র এই লিগনিন ভাঙতে পারে না। শুধু তা-ই নয়, ঘাসে থাকা লিগনিন অন্য ধরনের ফাইবারের পুষ্টিগুণ শোষণেও বাধা দেয়।

অন্যদিকে গরু, ছাগল বা হরিণের মতো চড়ে বেড়ানো প্রাণীদের বিশেষ পরিপাকতন্ত্র আছে। এসব প্রাণীর পাকস্থলিতে আছে চারটি প্রকোষ্ঠ। চারটির প্রথমটিতে আছে রুমেন নামের একধরনের ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়া ঘাসের সেলুলোজ ভেঙে হজম করতে পারে। এই প্রাণীদের পাকস্থলী বা হজম প্রক্রিয়া ঘাসের ভেতরের শ্বেতসার এবং পুষ্টি উপাদানগুলোকে ভেঙে হজম করে ফেলতে পারে। এই চার প্রকোষ্ঠের পাকস্থলী আমাদের নেই। তাই প্রাণীদের মতো বিশেষ ব্যবস্থা না থাকায় আমরা ঘাস খেয়ে হজম করতে পারি না। মানুষ যদি ঘাস খায়, তবে তা হজম না হয়েই শরীর থেকে বের হয়ে যাবে। তাই ঘাস থেকে আমরা কোনো পুষ্টি পাব না। অতিরিক্ত পরিমাণে ঘাস খেলে বমি বা ডায়েরিয়ার মতো সমস্যাও হতে পারে।

দাঁতের সমস্যা

আমাদের ঘাস না খাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো দাঁতের সুরক্ষা। ঘাসে থাকে প্রচুর পরিমাণে সিলিকা। আমাদের দাঁতের সঙ্গে এই উপাদানের ঘষা লাগলে আমাদের দাঁত ক্ষয়ে যাবে। কোয়ার্টজ এবং বেলেপাথরের মতো পাথরে পাওয়া যায় সিলিকা। এটি দ্রুতই আমাদের দাঁতের এনামেল ক্ষয় করে ফেলতে পারে।

তৃণভোজী প্রাণীদের এই সমস্যা নেই। এদের দাঁতগুলো ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ফলে ক্ষয় হয়ে যাওয়া অংশ দ্রুত প্রতিস্থাপিত হয়ে যায়। এ ছাড়া এরা যখন ঘাস খায়, তখন দাঁতের পাটির দুপাশ থেকে চিবানোর এক বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে। এভাবে ঘাস ছোট ছোট টুকরায় পরিণত হয়। ফলে প্রাণীরা সহজে ঘাস হজম করে ফেলতে পারে।

একসময় মানুষ ঘাস হজম করতে পারত। অবিশ্বাস্য হলেও এটা সত্যি। প্রায় ৩৫ লাখ বছর আগে মানুষের দাঁত ঘাস খাওয়ার উপযুক্ত ছিল। তবে ধীরে ধীরে আমরা খাদ্যতালিকা থেকে ঘাস বাদ দিয়েছি। আমাদের পরিপাকতন্ত্র অন্য খাবারের উপযোগী হয়ে উঠেছে। তাই এখন মানুষ আর ঘাস খায় না।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, কিশোর আলো

সূত্র: লাইভ সায়েন্স