উজ্জ্বল আলো কি শীতকালীন মন খারাপ দূর করতে পারে
শীতকাল সবার একরকম কাটে না। শীতকাল মানেই যে লেপ মুড়ি দিয়ে আরাম করা, গরম কফি আর পিঠাপুলি খাওয়া—ব্যাপারটা সবার জন্য তেমন নয়। কারণ সবার শীতকাল সুখকর হয় না। জানালার বাইরে যখন কুয়াশা জমে, বিকেল হতে না হতেই চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে যায়, তখন অনেকের মনের ভেতরেও এক অদ্ভুত অন্ধকার নেমে আসে। কোনো কারণ ছাড়াই মন খারাপ লাগে, কাজে উৎসাহ পাওয়া যায় না, সারাক্ষণ ঘুম ঘুম ভাব থাকে।
আপনি যদি এমনটা অনুভব করেন, তবে এই দলে আপনি একা নন। পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ এই সমস্যায় ভোগেন। বিজ্ঞানের ভাষায় এর একটা গালভরা নাম আছে—‘সিজনাল এফেক্টিভ ডিসঅর্ডার’ বা সংক্ষেপে স্যাড। নামটাই বলে দিচ্ছে, এটা মানুষকে কতটা দুঃখী করে তোলে।
কিন্তু কেন হয় এমন? এর সমাধানই বা কী? বিজ্ঞানীরা বলছেন, ওষুধের বোতলের চেয়ে আপনার টেবিলের ওপর রাখা একটা উজ্জ্বল বাতিই হতে পারে এর সবচেয়ে বড় সমাধান! চলুন, এই আলোর জাদুকরি ক্ষমতার বিজ্ঞানটা একটু ঘেঁটে দেখা যাক।
আমাদের শরীরের ভেতরে একটা অদৃশ্য ঘড়ি আছে, যাকে বলে সার্কাডিয়ান ক্লক। আমরা এটাকেই বলব দেহঘড়ি। এই দেহঘড়িটা চলে সূর্যের আলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে। শীতকালে যেহেতু দিন ছোট আর রাত বড়, তাই এই ঘড়ির কাঁটা এলোমেলো হয়ে যায়।
ফলে শরীরে ঘটে তিনটে বড় দুর্ঘটনা। এক, অন্ধকারে ঘুমের হরমোন মেলাটোনিন বেশি তৈরি হয়। শীতকালে দিন ছোট হওয়ায় শরীর ভাবে এখনই বুঝি ঘুমানোর সময়। ফলে সারাদিন ঝিমুনি ভাব থাকে। দুই, আমাদের মন ভালো রাখার রাসায়নিক হলো সেরোটোনিন। সূর্যের আলো কম পেলে এর উৎপাদন কমে যায়, ফলে মন খারাপ হয়। তিন, শরীরের ভেতরের দেহঘড়ি আর বাইরের সময়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
এই সমস্যা কাটাতে অনেকেই অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট বা বিষণ্নতা কমানোর ওষুধ খান। কিন্তু সব ওষুধেরই কিছু না কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। তাই ডাক্তাররা এখন পরামর্শ দিচ্ছেন, যেহেতু আলোর অভাবেই এই রোগ, তাই চিকিৎসা হোক আলো দিয়েই!
গত বছর চীনের জিংঝৌ মেন্টাল হেলথ সেন্টারের গবেষক তু ঝে-মিং ২১টি ভিন্ন ভিন্ন গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘হ্যাঁ, লাইট থেরাপি আসলেই কাজ করে’।
বাজারে এখন নানা ধরনের লাইট থেরাপি গ্যাজেট পাওয়া যায়। দেখতে সাধারণ টেবিল ল্যাম্পের মতো হতে পারে, আবার ট্যাবলেটের মতো চ্যাপ্টা স্ক্রিনও হতে পারে। এদের কাজ একটাই, সূর্যের আলোর মতো উজ্জ্বল আলো ছড়ানো।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই কৃত্রিম আলো কি আসলেই কাজ করে? নাকি পুরোটাই ব্যবসা? গবেষণা করাটা একটু কঠিন। কারণ ওষুধের ট্রায়ালে কাউকে আসল ওষুধ আর কাউকে নকল ওষুধ দেওয়া যায়। যাকে বলা হয় প্লাসিবো বা ছল-চিকিৎসা। কিন্তু লাইট থেরাপির ক্ষেত্রে তো আপনি কাউকে অন্ধকারে আটকে রেখে বলতে পারেন না যে তাকে আলো দেওয়া হচ্ছে! তবুও বিজ্ঞানীরা বসে নেই।
গত বছর চীনের জিংঝৌ মেন্টাল হেলথ সেন্টারের গবেষক তু ঝে-মিং ২১টি ভিন্ন ভিন্ন গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘হ্যাঁ, লাইট থেরাপি আসলেই কাজ করে’।
অন্যদিকে রোমানিয়ার লুসিয়ান ব্লাগা ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী মিহায়েলা বুকুতাতো গত মার্চে আরও বড় সুসংবাদ দিয়েছেন। তার মতে, যারা প্রতিদিন নিয়ম করে এই উজ্জ্বল আলোর সামনে বসেন, তাদের মধ্যে ৬০ থেকে ৯০ শতাংশ রোগীই সুস্থ বোধ করেন বা তাদের উপসর্গ কমে যায়।
এখন প্রশ্ন হলো, বাজার থেকে যেকোনো বাতি কিনলেই কি হবে? বিজ্ঞাপনগুলোতে দেখবেন ১০ হাজার লাক্স পাওয়ারের কথা ফলাও করে প্রচার করা হয়। সাধারণ ঘরের বাতির চেয়ে এটি অনেক গুণ বেশি উজ্জ্বল, অনেকটা রৌদ্রোজ্জ্বল দিনের মতো। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, এত বেশি পাওয়ার না হলেও চলে। কম তীব্রতার আলোতেও কাজ হয়, তবে সেক্ষেত্রে বাতিটা বেশিক্ষণ জ্বালিয়ে রাখতে হবে।
আর রঙের ক্ষেত্রে? যেকোনো রঙের আলোই মস্তিষ্কে পজিটিভ সিগন্যাল পাঠাতে পারে।
তবে শুধু শীতকালীন বিষণ্নতা নয়, আরও বেশি কিছু করা সম্ভব এই লাইট থেরাপির সাহায্যে। বুকুতাতোর গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণ ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতার ক্ষেত্রেও এটি দারুণ কার্যকর।
আরেকটা প্রশ্ন থেকে যায়। এতে কোনো ক্ষতি আছে কি? সবচেয়ে স্বস্তির খবর হলো, এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। খুব অল্প সংখ্যক মানুষ অভিযোগ করেছেন যে তাদের সামান্য মাথাব্যথা হয়েছে বা চোখ জ্বালাপোড়া করেছে। তবে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার তুলনায় এটা নগণ্য।
তবে শুধু শীতকালীন বিষণ্নতা নয়, আরও বেশি কিছু করা সম্ভব এই লাইট থেরাপির সাহায্যে। বুকুতাতোর গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণ ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতার ক্ষেত্রেও এটি দারুণ কার্যকর। শুধু লাইট থেরাপি নিলে ৪৪ শতাংশ ক্ষেত্রে উন্নতি দেখা যায়। কিন্তু যদি ওষুধের পাশাপাশি লাইট থেরাপি নেওয়া হয়, তবে সাফল্যের হার বেড়ে দাঁড়ায় ৭৬ শতাংশে! অর্থাৎ, আলো এবং ওষুধ দুটিই বেশি ভালো কাজ করে।
ফলে শীতের সন্ধ্যায় মন খারাপ হলে গোমড়া মুখে বসে থাকবেন না। হয়তো এক চিলতে উজ্জ্বল আলোই আপনার মস্তিষ্কের রসায়নকে বদলে দিতে পারে। বিজ্ঞানীরা আমাদের সেই আশাই দেখাচ্ছেন!