সব জীব ভিন্ন কেন

পৃথিবীর সব পদার্থকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। জীব ও জড়। জীবকে জড় পদার্থেরই একটা জটিল সমাবেশ বলা যায়। পৃথিবীতে অসংখ্য জীব আছে। এদের সবার বৈশিষ্ট্য এক নয়। তবে অনেক জীবের বৈশিষ্ট্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তাই সব প্রাণীকে বিভিন্ন শ্রেণিবিন্যাসে ভাগ করা হয়েছে। ভাগ করার এ পদ্ধতিকে আমরা বলি শ্রেণিবিন্যাসবিদ্যা। প্রথমে রাজ্য, তারপর পর্ব, শ্রেণি, বর্গ, গোত্র, গণ ও প্রজাতি—এভাবে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়।

একই প্রজাতির দুটি জীবের শারীরিক বৈশিষ্ট্য প্রায় একই রকম। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে,  দুটি প্রাণীর মধ্যে যতই মিল থাকুক না কেন, পৃথিবীর দুটি জীবের বৈশিষ্ট্য হুবহু এক রকম হয় না। যেমন ধরুন, মানুষ বা হোমো স্যাপিয়েন্স একটি প্রজাতি। পৃথিবীতে প্রায় ৮০০ কোটি মানুষ আছে। এই প্রতিটি মানুষের কারো সব বৈশিষ্ট্যই অন্য আরেকজন মানুষের সঙ্গে হুবহু মেলে না। কিছু না কিছু পার্থক্য থাকেই। ৮০০ কোটি মানুষের মধ্যে এমন দুজন মানুষ পাওয়া যাবে না, যাদের সব বৈশিষ্ট্য এক। আবার এমন কোনো বৈশিষ্ট্যও পাওয়া যাবে না, যেটা শুধু একজন মানুষের মধ্যেই আছে।

যেমন ধরুন, একজন মানুষের চুলের রং বাদামী। পৃথিবীতে এরকম বাদামী চুলের অসংখ্য মানুষ আছে। অর্থাৎ একজন মানুষের মধ্যে যতগুলো বৈশিষ্ট্য আছে, তার কোনোটিই অনন্য নয়। কিন্তু তারপরেও সামগ্রিকভাবে প্রতিটি মানুষ একজনের থেকে অন্যজন আলাদা কেন? এটার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় গণিতের শাখা—বিন্যাস-সমাবেশ থেকে।

একজন মানুষের সামগ্রিক বৈশিষ্ট্যকে বলা যায় তাঁর মধ্যে বিদ্যমান সব বৈশিষ্ট্যের একটি বিশাল সমাবেশ। যেমন ধরুন, একটি বীণায় ৬টি তার আছে। এর মধ্যে এক বা একাধিক তার একসঙ্গে বাজালে একটি সুর উৎপন্ন হবে। এবার, ওই বীণায় উৎপন্ন প্রতিটি সুরকে বাজানো সব তারের সুরের সমাবেশ বলা যায়। তাহলে, বীণায় মোট কতটি আলাদা রকমের সুর উৎপন্ন হবে? গাণিতিক সূত্রের সাহায্যে সেটাও বের করা যায়। এজন্য ব্যবহার করতে হবে সমাবেশের সাধারণ সূত্র। সে হিসেবে মোট অনন্য সুর হবে 6C1+6C2+6C3+6C4+6C5+6C6 = 63টি। অর্থাৎ, বীণাটিতে মোট 63টি অনন্য সুর উৎপন্ন হবে।

এই সুরের প্রতিটি একে অন্যটির থেকে আলাদা। কিন্তু ৬৩টি সুরের মধ্যে একটি সুর উৎপন্ন করতে যে তারগুলোর সমাবেশ হয়েছে, আমরা কোনোভাবেই বলতে পারব না, ওই তারগুলোর মধ্যে এমন একটি তার আছে, যেটি শুধু ওই নির্দিষ্ট সুর উৎপন্ন করতে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ, এখানেও প্রতিটি সুর অনন্য, কিন্তু যে তারগুলো ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলো অনন্য নয়।

আসলে তারগুলোর সমাবেশটা অনন্য। গণিত ও বিজ্ঞানে এই সমাবেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ। অক্সিজেনের যেমন একটা ধর্ম আছে, তেমনি হাইড্রোজেনেরও আছে একটা ধর্ম। কিন্তু দুটি হাইড্রোজেন আর একটা অক্সিজেন মিলে যখন পানি গঠন করে, তখন তার ধর্ম হয় সম্পূর্ণ আলাদা। আবার দুটি হাইড্রোজেন আর দুটি অক্সিজেন যুক্ত হয়ে উৎপন্ন হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড যৌগের ধর্ম আরও আলাদা। পর্যায় সারণির মাত্র ৮৩টি টেকসই মৌলের বিভিন্ন প্রকার সমাবেশ করে অসংখ্য ভিন্ন ধর্মের যৌগ গঠন করা সম্ভব। এ মৌলগুলো অনন্য না হলেও সেগুলোর অনন্য সমাবেশের জন্য যৌগটি অন্য সব যৌগ থেকে ভিন্ন হয়। একইভাবে শুধু ৫০টি বর্ণমালাকে বিভিন্ন রকম সমাবেশ করে বাংলায় অসংখ্য শব্দ তৈরি হয়েছে।

এই যে বীণা, যৌগ কিংবা বাংলা শব্দের ক্ষেত্রে কিছু উপাদানকে অসংখ্যভাবে সমাবেশ করে অনন্য উপাদান তৈরি করা সম্ভব, এই ব্যাপারটিই ঘটে প্রতিটি জীবের ক্ষেত্রে। জীবের জন্য যে শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সেগুলোকে বিভিন্নভাবে সমাবেশ করে তৈরি হয় পৃথিবীর অসংখ্য জীব। এদের কারও সঙ্গে কারও বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ হুবহু মেলে না। যেমন আমার কাছে যদি মাত্র ১০টি বর্ণ থাকে, তাহলে আমি এই ১০টি বর্ণ ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রকার সমাবেশ ঘটিয়ে মোট ১ হাজার ২৩টি অনন্য শব্দ তৈরি করতে পারব। গণিতের একটি ছোট্ট হিসাব থেকেই বলে দেওয়া যায়, দুটি সমাবেশ মিলে যাওয়ার মতো ঘটনার সম্ভাবনা খুবই কম, প্রায় শূন্যের কাছাকাছি।  তাই আমরা জোর দিয়ে কখনোই বলতে পারি না, কোনো দুটো জীব হুবহু এক রকম। বাস্তবেও তাই দেখা যায়। সেজন্যই পৃথিবীর প্রতিটি জীব ভিন্ন।

লেখক: শিক্ষার্থী, দশম শ্রেণি, ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়,  শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার