ইয়ুথ ফর সায়েন্স
খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তায় প্রযুক্তি ৩
গত ১৫ অক্টোবর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রশাসনিক ভবনে অনুষ্ঠিত হয় মাসব্যাপী চলা ‘ইয়ুথ ফর সায়েন্স ২০২২’-এর চূড়ান্ত পর্ব ও পুরস্কার বিতরণী। রচনা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয়েছেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মো. তাওহীদুল ইসলাম সুমন। তাঁর লেখাটি কিছুটা সম্পাদিত ও পরিমার্জিত রূপে প্রকাশ করা হলো।
গত ১৫ অক্টোবর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রশাসনিক ভবনে অনুষ্ঠিত হয় মাসব্যাপী চলা ‘ইয়ুথ ফর সায়েন্স ২০২২’-এর চূড়ান্ত পর্ব ও পুরস্কার বিতরণী। সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ প্রতিযোগিতায় তিনটি বিভাগে (রচনা, ফটোগ্রাফি ও কুইজ) অংশগ্রহণ করেন। এতে রচনা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয়েছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মো. তাওহীদুল ইসলাম সুমন। তাঁর লেখাটি কিছুটা সম্পাদিত ও পরিমার্জিত রূপে প্রকাশ করা হলো।
ভূমিকা
আমরা বেঁচে থাকার জন্য যা খাই, তা–ই খাদ্য। জীবনধারণের জন্য খাদ্য অপরিহার্য। খাবার দেহের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে। তবে খাদ্য নিরাপদ হওয়া জরুরি। আর এই অপরিহার্য উপাদান—খাবার নিরাপদ রাখতে প্রয়োজন আধুনিক প্রযুক্তি ও সচেতনতা বৃদ্ধি।
খাদ্যে পুষ্টি উপাদান
দেহের জন্য অত্যাবশ্যক পুষ্টি উপাদান শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট। সেই সঙ্গে প্রয়োজন আমিষ বা প্রোটিন; স্নেহ পদার্থ বা ফ্যাট, যাকে লিপিডও বলা হয়। আর দরকার ভিটামিন, মিনারেল বা খনিজ ও পানি। অত্যাবশ্যকীয় এসব পুষ্টি উপাদনগুলো আমরা বিভিন্ন ধরনের খাবারের মাধ্যমে পাই।
শাকসবজি
দৈনন্দিন জীবনে আমরা নিয়মিতই বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি খাই। যেমন আলু, পটল, করলা, লাউ, ঢ্যাঁড়স, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লালশাক, পুঁইশাক, কলমিশাক, কচুশাক ইত্যাদি। কিন্তু দ্রুত এবং অধিক ফলনের জন্য কৃষকেরা চাষের সময় বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক ও সার ব্যবহার করেন। অনেক সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহার করে ফেলেন। এ ছাড়া উইথড্রয়াল পিরিয়ড, অর্থাৎ এসব কীটনাশক ও সারের ক্ষতিকর প্রভাব কেটে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সময় সম্পর্কে সচেতন না হওয়ায়, উইথড্রয়াল পিরিয়ডের আগেই তাঁরা এসব বাজারজাত করে ফেলেন অনেক সময়। এটা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। তবে জৈব সার ব্যবহারে উৎসাহিত করার মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপদ রাখা সম্ভব।
মাংস, দুধ ও ডিম
মাংস, দুধ ও ডিম আমাদের প্রোটিন বা আমিষের চাহিদা পূরণ করে। ডিম ও দুধকে আদর্শ খাবার বলা হয়। কারণ, প্রোটিন ছাড়াও আমাদের দেহের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপাদান ডিম ও দুধে রয়েছে। এ খাদ্যগুলো দেহের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এসব খাবার তাই নিরাপদ হওয়া দেহের জন্য জরুরি। এগুলোর মাধ্যমে জুনোটিক রোগ হতে পারে। জুনোটিক রোগ মানে যে সব রোগ প্রাণী থেকে মানুষ এবং মানুষ থেকে প্রাণীতে ছড়ায়।
এ খাদ্যগুলো উৎপাদিত হয় খামারে। বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তির মাধ্যমে এসব খাবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এসব খাবার নিরাপদ রাখতে জৈবনিরাপত্তা এবং ভালো ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে দ্রুত বৃদ্ধির জন্য স্টেরয়েড হরমোন, বিভিন্ন ধরনের গ্রোথ প্রোমোটার (বৃদ্ধি-সহায়ক) এবং নিবন্ধিত পশুচিকিৎসকের অনুমতি ছাড়া যখন তখন অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার রোধ করতে হবে। এভাবে এই খাদ্যগুলো নিরাপদ রাখা সম্ভব।
মাছ
মাছ আমাদের প্রোটিন বা আমিষের চাহিদা পূরণ করে। কিন্তু কলকারখানার ভারী ধাতু নদী ও পুকুরের পানিতে মিশে মাছের মাধ্যমে আমাদের দেহে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া জমিতে অতিরিক্ত কীটনাশক ও সারের ব্যবহার মাছ অনিরাপদ করে তোলে। তাই মাছ চাষের জন্য নিরাপদ জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহার, পানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
ফলমূল
ফলমূলে ফরমালিনের ব্যবহার মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এ ছাড়া দ্রুত ফল পাকাতে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার ফলমূল অনিরাপদ করে তোলে এবং ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে দেহে। খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তার জন্য এসব প্রতিরোধ করতে হবে।
খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহৃত প্রিজারভেটিভের সঠিক মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ, এগুলো ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ
স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করতে হবে। খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করার সময় খাবার যাতে দূষিত না হয়, সেটা খেয়াল রাখতে হবে। খাবারে যেন ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক জন্মাতে না পারে, সে জন্য খাবার জমা ও সংরক্ষণ করার সময় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সঠিকভাবে বাজারজাত করতে হবে। বাজারজাত করার সময় যেন কোনোভাবে খাদ্য দূষিত না হয়, লক্ষ রাখতে হবে সেদিকেও। খাদ্যদ্রব্য বেশি দিন সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয়। এগুলোর সঠিক মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কারণ, এগুলো ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
কলকারখানার বর্জ্য নিষ্কাশন
কলকারখানার বর্জ্য মাটি এবং পানি দূষিত করার মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্য অনিরাপদ করে ও দেহে বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগ সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কলকারখানার বর্জ্য নিষ্কাশন করতে হবে এবং পরিবেশদূষণ রোধ করার মাধ্যমে নিরাপদ রাখতে হবে খাদ্য।
গবেষণাগার
খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা বজায় রাখতে খাবার পরীক্ষার জন্য প্রয়োজন আধুনিক গবেষণাগার বা ল্যাবরেটরি। খাদ্যে কোনো ক্ষতিকর উপাদান আছে কি না, পরীক্ষার মাধ্যমে সেটি নিশ্চিত হতে হবে। খাবারে ক্ষতিকর ভারী ধাতু বা ভেজাল পাওয়া গেলে, সেগুলো সরিয়ে ফেলার জন্য নিতে হবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।
খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ
কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেশি লাভের আশায় খাবারে বিভিন্ন ধরনের ভেজাল মেশান। এসব ভেজাল শরীরের জন্য ক্ষতিকর। ক্যানসারও হতে পারে এজন্য। বাজার পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে খাবারে এসব ভেজাল মেশানো প্রতিরোধ করতে হবে।
আশার কথা হলো, আধুনিক প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব।
সচেতনতা বৃদ্ধি
খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। কৃষক, খামারি, ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। খাদ্য ও পুষ্টির অনিরাপত্তার কুফল এবং এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জানাতে হবে সবাইকে।
আইন প্রয়োগ
খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা বজায় রাখতে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট আইনের যথাযথ প্রয়োগ। যাঁরা খাদ্যে ভেজালের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের জরিমানা এবং কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। নিয়মিত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকলে এ ধরনের আইন সফলভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব।
গবেষণা এবং নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন
খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্নভাবে গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও অনেক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে কাজ করছে। তাদের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতন হতে হবে, রাখতে হবে কার্যকর ভূমিকা। আগামী প্রজন্মের জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও আধুনিক প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমেই সম্ভব খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
উপসংহার
নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি জীবনধারণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুস্থ ও মেধাবী জাতি গঠনে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি অত্যন্ত জরুরি। এ আলোচনা থেকে তা স্পষ্ট। অনিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি আমাদের ভয়াবহ সমস্যায় ফেলে দিতে পারে। একদিকে নিরাপদ খাবারের অভাব যেমন দেখা দিতে পারে, তেমনি অনিরাপদ খাবারের ফলে তৈরি হতে পারে ভয়ংকর অনেক রোগ। তবে আশার কথা হলো, আধুনিক প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। তাই বলা যায়, খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তায় প্রযুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম।
লেখক: ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন (ডিভিএম), হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর
