ঘুমের মধ্যে হাঁটা!

ছোটবেলায় আমাদের এক খালাতো ভাই ঘুমের মধ্যে হাঁটত। রাতে যে বিছানায় তাকে ঘুম পাড়ানো হতো, সকালে দেখা যেত সেখানে সে নেই, হয়তো শুয়ে আছে অন্য ঘরে, বসার ঘরের সোফায় বা বারান্দার ইজিচেয়ারে। কীভাবে এখানে এল, সেটাও বলতে পারত না সে। বিষয়টা খুবই রহস্যময় ও ভীতিকর ছিল আমাদের কাছে।

মজার বিষয় হলো, আমাদের এই ভাই বড় হয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিষয়ে ডক্টরেট করে এবং মেধাবী বৈজ্ঞানিকে পরিণত হয়। অবাক ব্যাপার হলো, পৃথিবীতে প্রায় ১৫ শতাংশ শিশুই রাতে ঘুমের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করে! সাধারণ বুলিতে একে স্লিপ ওয়াকিং বলা হয়, আর ডাক্তারি পরিভাষায় বলে সমনামবুলিজম। এটা একধরনের স্লিপ ডিজঅর্ডার বা নিদ্রাবিষয়ক জটিলতা। সাধারণত তিন থেকে সাত বছরের শিশুরাই এতে আক্রান্ত হয় বেশি। নানা মাত্রায় ঘটে থাকে এ সমস্যাটি। কেউ ঘুমের মধ্যে কথা বলে, বিড়বিড় করে, কেউ উঠে হাঁটতে শুরু করে, কেউ বিছানা ভিজিয়ে দেয়, এমনকি কেউ নিখুঁত কোনো কাজ সম্পন্ন করে ফেলতে পারে ঘুমের মধ্যে; যেমন জামাকাপড় বদলানো বা গাড়ি চালিয়ে দূরে কোথাও চলে যাওয়া। খুবই আজব ব্যাপার, তাই না? এই পুরোটা সময় সে গভীর ঘুমের স্তরে বা নন রেম স্লিপে থাকে। এ সময় তার ঘুম ভাঙানো কঠিন। চোখ দুটো সাধারণত খোলাই থাকে, কিন্তু দৃষ্টি থাকে শূন্য। আর জেগে ওঠার পর এ বিষয়ে তার কোনো স্মৃতিই অবশিষ্ট থাকে না। এই হলো সমনামবুলিজম। কিন্তু কেন হয় এ সমস্যা? সঠিক উত্তর পাওয়া মুশকিল। তবে ঘুমের সমস্যা, স্লিপ এপনিয়া বা ঘুমের মধ্যে শ্বাস আটকে আসা, খিঁচুনি রোগ, কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বা জ্বরের ঘোরে এমন হতে পারে। কারও কারও পরিবারে এ সমস্যা থাকে। কখনো কখনো বড়দেরও এই সমস্যা হতে পারে, তার বেশির ভাগই অ্যালকোহল, নেশাদ্রব্য বা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য হয়। স্লিপ ওয়াকিং তেমন গুরুতর কোনো সমস্যা নয় বলেই বিজ্ঞানীদের ধারণা, এমনিতেই এ সমস্যা সেরে যায়। তবে কখনো ঘুমের ঘোরে দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। সে জন্য যেসব বাচ্চা ঘুমের মধ্যে হাঁটে, তাদের ঘরে ধারালো বস্তু না রাখা, বাথরুম বা সিঁড়ির দরজা খোলা না রাখা, জানালা বন্ধ রাখা উচিত। পারলে তার ঘরের দরজা লক করে রাখা উচিত, যাতে সে বেরিয়ে গিয়ে হোঁচট বা আঘাত না পায়। অনেকের ধারণা, এ সময় এদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা উচিত নয়। এ ধারণা ভুল; বরং এ পরিস্থিতিতে এদের ধীরে মোলায়েম ভাবে জাগিয়ে দেওয়াই ভালো।

স্লিপ ওয়াকিং নিয়ে বিজ্ঞানীদের যেমন আগ্রহের সীমা নেই, তেমনি এই বিষয়টা জনপ্রিয় কবি-সাহিত্যিকদের কাছেও। শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত নাটক ম্যাকবেথ-এ লেডি ম্যাকবেথের ঘুমের মধ্যে হাঁটা ও বিড়বিড় করে কথা বলার একটি দৃশ্য আছে, যেখানে তাকে কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা করতে দেখা যায়। থ্রিলার ধরনের বেশ কিছু উপন্যাসে সমনামবুলিজমের উল্লেখ আছে। ঘুমের মধ্যে হত্যা বা আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলা নিয়ে এ ধরনের কাহিনি রচিত। এমনকি ছোটদের জন্য লেখা লুই ক্যারলের অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড বইয়ে অ্যালিস ঘুমের মধ্যেই এক আশ্চর্য জগতে প্রবেশ করে এবং নানা মজার আজব ঘটনা ঘটতে দেখে। স্লিপ ওয়াকিং একটি রহস্যময় বিষয় বলেই এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের যেমন, তেমনি ফিকশন রাইটারদের আগ্রহ ব্যাপক।

*লেখাটি ২০১৮ সালে বিজ্ঞানচিন্তার জুন সংখ্যায় প্রকাশিত