নিপাহ ভাইরাসের টিকা পরীক্ষা করছে অক্সফোর্ড

টিকাপ্রতীকী ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে প্রাণঘাতী নিপাহ ভাইরাসের টিকার হিউম্যান ট্রায়াল, অর্থাৎ মানবদেহে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ। গত ১১ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়টি এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে। চ্যাডক্স১ নিপাহ বি (ChAdOx1 Nipah B) নামের এ টিকা উদ্ভাবন করেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যানডেমিক সায়েন্সেস ইনস্টিটিউট। আর মানবদেহে পরীক্ষায় নেতৃত্ব দিচ্ছে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন গ্রুপ। অর্থায়নে সহায়তা করছে এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস (সেপি)।

করোনাকালে মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে এ ধরনের ভাইরাস প্রতিরোধের গুরুত্ব। প্রথম আলো সূত্রে জানা যাচ্ছে, বর্তমানে ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে জলাতঙ্কের পর সবচেয়ে ভয়ানক এই নিপাহ ভাইরাস। আক্রান্তদের প্রায় ৭৫ শতাংশ মারা যান। বাংলাদেশে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব উদ্বেগজনক। ভারতের কেরালায় গত বছরের (২০২৩) সেপ্টেম্বর এ ভাইরাসের আউটব্রেক, অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণাতীত প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এ ভাইরাসের ক্ষয়ক্ষতির ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে এটিকে।

রয়টার্সের সূত্রে জানা যাচ্ছে, ৫১ জন রোগী প্রাথমিক এ পরীক্ষামূলক প্রয়োগে অংশ নিচ্ছেন। তাঁদের বয়স ১৮ থেকে ৫৫-এর মধ্যে। গত সপ্তাহজুড়ে তাঁরা এই টিকার প্রথম ডোজ গ্রহণ করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে তাঁদের আরও এক ডোজ টিকা দেওয়া হবে। ১৮ মাস ধরে চলবে এই পরীক্ষামূলক প্রকল্প। পরের ধাপে পরীক্ষা চালানো হবে নিপাহ আক্রান্ত কোনো দেশে।

বাংলাদেশে এ রোগের মূল কারণ খেজুরের কাঁচা রস। শীতকালে খেজুরগাছে রস সংগ্রহের যে হাঁড়ি ঝুলিয়ে রাখা হয়, রাতে তাতে বাদুড় মুখ দেয়

চ্যাডক্স১ নিপাহ বি টিকাটি একটি ভেক্টর ভ্যাকসিন বা ভেক্টরনির্ভর টিকা। এ কথা অবশ্য সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। রয়টার্সের বিবৃতি অনুসারে, এটি অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের করোনার টিকার মতো একই প্রযুক্তিনির্ভর। আর করোনার এই টিকাগুলো ছিল ভেক্টরনির্ভর টিকা। এ পদ্ধতিতে দায়ী ভাইরাসটিকে অন্য কোনো ভাইরাসের বাহক বা ভেক্টরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। বিশেষ এই পরিমার্জিত ভেক্টরটি পরে নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে প্রবেশ করানো হয় দেহে। ফলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এর বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি তৈরি করে। তাই পরে কখনো এ ভাইরাস দেহে আক্রমণ করলে শরীর এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যানডেমিক সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটে নিপাহ ভাইরাস নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করছেন বাংলাদেশের গবেষক মো. জাকিউল হাসান। তিনি বলেন, পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ৫১ জনের ৬ জনকে নিপাহ ভাইরাসের টিকা চ্যাডক্স১ নিপাহ বি-এর দুই ডোজ করে দেওয়া হবে। বাকি ৪৫ জনের কেউ কেউ এক ডোজ টিকা ও এক ডোজ প্লাসিবো পাবেন। কোনো দল দুই ডোজ টিকা পাবে বা দুই ডোজ প্লাসিবো পাবে।

প্লাসিবোর বিষয়টি কী? সহজ করে বললে, অনেকে যখন শোনেন চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, তখন মানসিক শক্তির জোরে সুস্থ হয়ে উঠতে থাকেন। এর নাম প্লাসিবো ইফেক্ট। সে জন্য টিকা পরীক্ষার সময় কাউকে কাউকে টিকা দেওয়া হয়, কাউকে কাউকে এর বদলে অন্য কিছু দেওয়া হয়। একে হয়তো ছদ্ম-ওষুধ বলা যেতে পারে। এভাবে টিকার কার্যকারিতা, কতটা নিরাপদ, প্রয়োজনীয় ডোজ ইত্যাদি বিষয়ে নিশ্চিত হন গবেষকেরা।

শীতের সকালে খেজুরের রস খাওয়ার মজাই আলাদা। তবে এই কাঁচা রসে থাকতে পারে নিপাহ ভাইরাসের জীবাণু, তাই সতর্ক থাকতে হবে
ছবি: হাসান মাহমুদ

কীভাবে  এ ভাইরাসে আক্রান্ত হন মানুষ? বাংলাদেশে এ রোগের মূল কারণ খেজুরের কাঁচা রস। শীতকালে খেজুরগাছে রস সংগ্রহের যে হাঁড়ি ঝুলিয়ে রাখা হয়, রাতে তাতে বাদুড় মুখ দেয়। এতে বাদুড়ের লালা রসে মিশে যায়। অনেক সময় বাদুড়ের মলমূত্রও রসকে দূষিত করে। এই মলমূত্র বা লালা থেকেই ছড়ায় নিপাহ ভাইরাস। তবে সব ধরনের বাদুড় নয়, বিশেষ একধরনের বাদুড় এ জন্য দায়ী। এটি কায়রোপেট্রা (Chiroptera) বর্গের পেট্রোপোডিই (Pteropodidae) পরিবারের সদস্য। এদেরকে মেগাব্যাট বলে, ফ্রুট ব্যাটও বলা হয়।

এ ছাড়া বিভিন্ন ফলেও কামড় দেয় বাদুড়। এসব ফল খেলেও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন মানুষ।

সেপির সদস্য ডাক্তার ইন-ক্যু ইয়ুনের মতে, এই ভাইরাস মহামারি হয়েও উঠতে পারে। কারণ, এসব ফ্রুট ব্যাট যে অঞ্চলগুলোতে থাকে, তাতে প্রায় দুই বিলিয়ন বা দুইশ কোটি মানুষের বাস। তাই এই প্রাণঘাতী ভাইরাস থেকে মানুষকে বাঁচানোর লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের ফলে মস্তিষ্কে প্রদাহ (জ্বালাপোড়া) বা এনকেফালাইটিস দেখা দেয়। ফলে মৃত্যুর আশঙ্কা প্রবল।

ফ্রুট ব্যাট
ছবি: উইকিমিডিয়া
কেউ নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হলে তাকে যত্নকারী, চিকিৎসক ও নার্স—সবাইকে যথাযথ প্রতিরোধব্যবস্থা, যেমন মাস্ক ও পিপিই পরতে হবে, নাহলে তাঁরাও আক্রান্ত হতে পারেন এবং তাঁদের মাধ্যমে অন্যদের মধ্যে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে

বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর,বি) নিপাহ ভাইরাসের বিস্তার নিয়ে সার্বক্ষণিক নজরদারি করে। এ সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে ২০০১ সালে মেহেরপুর জেলায় নিপাহ ভাইরাসের প্রথম প্রাদুর্ভাব চিহ্নিত হয়। এরপর দুই দশকের বেশি সময় ধরে যতজন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৭১ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে। গত (২০২৩) বছর (মার্চ মাস পর্যন্ত) দেশে ১৪ জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১০ জনই মারা গেছেন। ২০০১ সাল থেকে দেশে এ পর্যন্ত ৩৩৯ জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২৪০ জন মারা গেছেন।

তাই প্রতিরোধই সবচেয়ে ভালো উপায়। কেউ নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হলে তাকে যত্নকারী, চিকিৎসক ও নার্স—সবাইকে যথাযথ প্রতিরোধব্যবস্থা, যেমন মাস্ক ও পিপিই পরতে হবে, নাহলে তাঁরাও আক্রান্ত হতে পারেন এবং তাঁদের মাধ্যমে অন্যদের মধ্যে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে।

পাশাপাশি শীতে খেজুরের কাঁচা রস পান করা যাবে না। তবে রস জ্বাল দিলে এর মধ্যে থাকা জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়। তাই জ্বাল দিয়ে, গুড় বা চিনি তৈরি করে খাওয়া যাবে। মনে রাখতে হবে, স্ফুটনাঙ্কের ওপর তাপমাত্রায় জ্বাল দিতে হবে বেশ কিছুক্ষণ। তারপর ঠান্ডা করে খেতে হবে। খেজুরের কাঁচা রসে ভেজানো পিঠাপুলি খাওয়া যাবে না। কাঁচা ফল খাওয়ার ক্ষেত্রেও সতর্কতা জরুরি। এই সতর্কতা অনেক প্রাণ বাঁচাতে পারে।

সূত্র: রয়টার্স, মায়োক্লিনিক, প্রথম আলো