নোবেল ২০২১
শারীরতত্ত্বে নোবেল ২০২১
চলতি বছরের নোবেল পুরস্কার প্রদান শুরু হবে আজ ৩ অক্টোবর, সোমবার চিকিৎসাবিজ্ঞান ও শারীরতত্ত্বে নোবেল ঘোষণার মাধ্যমে। তার আগে চলুন দেখে নিই গত বছর কারা কারা পেয়েছিলেন শারীরতত্ত্বে নোবেল আর কেন…
নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, লিফট বা এলিভেটরের প্রবেশপথে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকলে তার দরজা বন্ধ হয় না। নিরাপত্তার খাতিরে এমন ব্যবস্থা থাকে। লিফট কীভাবে বোঝে যে তার দরজার ফাঁকে কেউ বা কিছু আছে? এ জন্য তার যে ব্যবস্থা সাধারণত কাজ করে, তা অনেকটা এ রকম—লিফটের দরজার এক পাশে অদৃশ্য আলো (যেমন অবলোহিত বিদ্যুৎ–চুম্বকতরঙ্গ) নিঃসরণকারী উৎস, অর্থাৎ সোর্স থাকে আর ঠিক সেই বরাবর অন্য পাশে থাকে সেই আলো শনাক্ত করার যন্ত্র, অর্থাৎ সেন্সর। যতক্ষণ লিফটের দরজার ডান ও বাঁ পাশের মাঝখানে কোনো বাধা না থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত সোর্স থেকে সেন্সর পর্যন্ত আলো পৌঁছাতে পারে। সে ক্ষেত্রে সেন্সর থেকে একটা বৈদ্যুতিক সার্কিটের মাধ্যমে লিফট দরজা বন্ধ করার সংকেত পায়। কিন্তু যদি মাঝপথে বাধা পড়ে, তখন সেন্সরে অদৃশ্য আলো পৌঁছায় না এবং দরজা বন্ধ হতে পারে না। লক্ষ করুন, লিফটের দরজার মধ্যে ফাঁকা আছে কি না, সেটা কিন্তু লিফট সরাসরি বুঝতে পারে না। এ ক্ষেত্রে প্রক্সি হিসেবে কাজ করে সেন্সরে নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো পড়া বা না পড়া। যদি সেন্সরে কোনো যান্ত্রিক সমস্যা হয় কিংবা আলোরোধী কোনো ময়লা আস্তরণ তার ওপরে পড়ে, তাহলে দরজার ফাঁকে কোনো কিছু না থাকলেও লিফটের দরজা বন্ধ হতে চাইবে না।
একইভাবে জীবজগতে টিকে থাকতে গেলে যেকোনো জীবকে প্রতিমুহূর্তে পরিবেশের বিভিন্ন রকম উদ্দীপনা গ্রহণ করতে হয় এবং সেখান থেকে জৈবনিক সার্কিটের মাধ্যমে করণীয় স্থির করতে হয়। এককোষী জীব থেকে জটিলতম বহুকোষী জীব—সবার ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। সে ক্ষেত্রে সেন্সরকে বলে রিসেপ্টর বা গ্রাহক। যেমন আমাদের জানা আদিমতম বহুকোষী স্পঞ্জজাতীয় জীবের কথা বলা যায়। এদের দুটি কাচের শিটের মধ্যে রেখে চাপ দিলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং বিচ্ছিন্ন প্রতিটি কোষ এককোষী অ্যামিবার মতো আচরণ করতে থাকে। অর্থাৎ এদের যে চাপ দেওয়া হয়েছে, এটা যেন তারা ‘বুঝতে’ পারে। কীভাবে বোঝে? আসলে চাপের প্রক্সি হিসেবে কাজ করে এদের কোষের কোষঝিল্লির পরিবর্তন। যেটা শনাক্ত করে এদের কোষঝিল্লিতে থাকা বিশেষ রিসেপ্টর প্রোটিন (অর্থাৎ জৈবনিক সেন্সর)। আবার এককোষী অ্যামিবা–জাতীয় জীব খাদ্যকণার দিকে ধাবিত হয়, আর বিষাক্ত পদার্থ থেকে দূরে সরে যায়। রাসায়নিক বা যান্ত্রিক উদ্দীপনা বোঝার মতো রিসেপ্টর থাকে বলেই এ রকম হয়। এগুলো প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে অর্জিত একপ্রকার সুরক্ষাব্যবস্থা। কিন্তু মনে রাখতে হবে, যেকোনো রিসেপ্টরই আসলে মূল উদ্দীপনা শনাক্তের প্রক্সি হিসেবে কাজ করে। সত্যিকার খাদ্য, বিষ বা চাপ না দিয়ে যদি স্রেফ তার সংশ্লিষ্ট রিসেপ্টরকে কৃত্রিমভাবে সংকেত দেওয়া যায়, তবু সেই জীব বা জীবকোষ একই আচরণ করতে থাকে, যেমনটা সত্যিকারের উদ্দীপনা পেলে করত।
শব্দ শুনতে পায়, এমন সব জীবে শব্দ বা জড়মাধ্যমের কম্পন শনাক্ত করার প্রক্সি হিসেবে কাজ করে কানের একদম ভেতরকার একজাতীয় তরল। সেই তরলে ঢেউ খেলে গেলে সেখানে থাকা বিশেষ কোষের ভাসমান তন্তুগুলো নড়েচড়ে। সেই নড়াচড়ার যান্ত্রিক শক্তিকে কোষ বৈদ্যুতিক শক্তিতে পরিণত করে এবং সংকেতটি স্নায়ুর মাধ্যমে বাহিত হয়ে মস্তিষ্কে গেলে শব্দের অনুভূতি হয়। কোনো বাহ্যিক শব্দ ছাড়া স্রেফ উল্লিখিত তরল বা তাতে ভাসমান কোষীয় তন্তুগুলো নাড়িয়ে দিতে পারলেও কিন্তু মস্তিষ্ক সেটা শব্দ হিসেবে গণ্য করবে! আবার স্বাদের অনুভূতিও আসলে খাদ্যের বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান শনাক্তকরণের উপায় ছাড়া আর কিছু নয়, অন্তত শারীরতাত্ত্বিকভাবে।
চলতি বছর ৪ অক্টোবর, বাংলাদেশ সময় বেলা সাড়ে তিনটার দিকে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও শারীরতত্ত্বে যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে, সেটি কয়েক প্রকার রিসেপ্টর এবং সেগুলোর প্রক্সি আবিষ্কার করার জন্য। সেই রিসেপ্টরগুলো স্পর্শের অনুভূতির সঙ্গে সম্পর্কিত।
৯০ দশকের শেেষ ডেভিড জুলিয়াস ও তাঁর সহকর্মীরা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মরিচ থেকে ঝাল লাগার কারণ খুঁজছিলেন। মরিচের ক্যাপসাইসিন নামে রাসায়নিকটি যে তার ঝাঁজের জন্য দায়ী, এটা তত দিনে প্রতিষ্ঠিত। ডেভিডের উদ্দেশ্য ছিল, কোষ সেই ঝালের অনুভূতি ‘বোঝে’ কী করে, তা বোঝা। ঝালের অনুভূতি শনাক্ত করতে পারে, এমন স্নায়ুকোষগুলো যে একই সঙ্গে ব্যথা, স্পর্শ ও তাপের সংবেদনেও সাড়া দিতে পারে, তা ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা জানতেন। এ রকম স্নায়ুকোষে হাজার হাজার প্রোটিন আছে, যেগুলোর হাজারো রকমের কাজ থাকতে পারে। তার মধ্যে ঠিক কোনটি ঝাল, মানে ক্যাপসাইসিন (বা তার কোনো প্রক্সি) শনাক্ত করে, সেটা বের করা খড়ের গাদায় সুই খোঁজার চেয়েও বেশি ধৈর্যের কাজ।
এ জন্য ডেভিড ও তাঁর সহকর্মীরা সেই কোষগুলো থেকে মেসেঞ্জার আরএনএ (সংক্ষেপে এমআরএনএ) পৃথক করে নিলেন। এত কিছু থাকতে এটা কেন? কোনো জীবের সব দেহকোষে একই রকম ডিএনএ থাকে। ত্বকের কোষে ডিএনএর যে সংকেতগুলো আছে, যকৃতের কোষেও সেই একই সংকেতগুলো আছে। একই কথা স্নায়ুকোষের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু সব কোষ সেই বিশাল সংকেতের সবটুকু পাঠোদ্ধার করে না। যে কোষ শুধু ত্বকের কোষের গঠন ও কাজের জন্য নির্দিষ্ট সংকেত কাজে লাগায় এবং ডিএনএর অন্য অংশের কথা বেমালুম ভুলে যায়, সেগুলোকেই আমরা ত্বকের কোষ বলি। একইভাবে যকৃৎ বা স্নায়ুকোষ কিংবা অন্য যেকোনো বিশেষায়িত দেহকোষ তার নির্ধারিত সংকেতটুকু ব্যবহার করে প্রোটিন বানায়। সেটাই তাকে তার পরিচয় দেয়। ডিএনএর যেটুকু অংশ কোনো কোষ পাঠোদ্ধার করে, তার ভেতরকার এমআরএনএ হলো সেই অংশটুকুর প্রক্সি। তাই এমআরএনএ বিশ্লেষণ করলে জানা যায়, কোনো একটা কোষ ডিএনএর ঠিক কোন অংশটুকু বাস্তবে কাজে লাগায়। ডিএনএর সংকেতে থাকা বাকি জিনগুলো তার কাছে থাকাও যা, না থাকাও তা। এভাবে ক্যাপসাইসিনের প্রতি সংবেদনশীল স্নায়ুকোষের এমআরএনএ বিশ্লেষণ করে সেগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডিএনএ সংকেতগুলোর একটা লম্বা তালিকা করলেন ডেভিড ও তাঁর দল। সেখান থেকে বাদ দিলেন এমন সব জিন, যেগুলো শুধু সেই বিশেষ ধরনের স্নায়ুকোষে নয়, কমবেশি সব কোষেই থাকে। এবার তালিকায় যেসব জিন বাকি রইল, সেগুলোর মধ্যেই নিশ্চয় ক্যাপসাইসিন শনাক্তকারী জিনটিও (বা জিনগুলো) আছে। ডেভিড ও তাঁর সহকর্মীরা এ পর্যায়ে যা তৈরি করলেন, তাকে বলে ডিএনএ লাইব্রেরি। অর্থাৎ কাগজে-কলমে নয়, একেবারে সত্যিকারের ডিএনএ অণুর সংগ্রহ। একেকটা টিউবে অনেকগুলো করে ডিএনএ অণু আছে। সেই ডিএনএর প্রতিটি টুকরা কোনো না কোনো এমআরএনএর সংশ্লিষ্ট সংকেত বহন করছে।
ডেভিড ও তাঁর সহকর্মীরা এমন একজাতীয় কোষ নিলেন, যেটা স্বাভাবিক অবস্থায় ক্যাপসাইসিনের প্রতি সাড়া দেয় না। অর্থাৎ এই কোষগুলোর ‘ঝাল লাগে না’। কালচার মিডিয়াতে চাষ করে সেগুলোর সংখ্যা বাড়িয়ে নিলেন। তারপর তাঁদের লাইব্রেরি থেকে একটা একটা করে ডিএনএর টুকরা সেই কোষগুলোতে প্রবেশ করিয়ে দেখতে লাগলেন, সেই ডিএনএতে থাকা সংকেত চালু হলে পরে কোষে কোনো পরিবর্তন হয় কি না। কেমন পরিবর্তন? কোনো কোষের ঝিল্লিতে থাকা রিসেপ্টর যখন তার জন্য নির্দিষ্ট উদ্দীপকের সংস্পর্শে আসে, তখন সাধারণত কোনো বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত কণা, মানে আয়ন কোষঝিল্লির এক পাশ থেকে অন্য পাশে স্থানান্তরিত হয়। ফলে কোষঝিল্লির ভেতরে ও বাইরের মধ্যকার বিদ্যুৎপ্রবাহ ও ভোল্টেজের পরিবর্তন হয়। এটা মেপে জানা যায়, কোষটি উদ্দীপনায় (এ ক্ষেত্রে ক্যাপসাইসিন) সাড়া দিচ্ছে কি না। এভাবে একটা একটা করে ডিএনএ সংকেত পরীক্ষা করতে করতে হঠাৎ ইউরেকা! একটা জিন পাওয়া গেল, যেটা ঝাল বোঝে না, এমন কোষকে ঝালের সমঝদার বানিয়ে দিতে পারে। সেই জিন যে প্রোটিনের সংকেত দেয়, তার নাম TRPV1। এটাই সেই মোস্ট ওয়ান্টেড ক্যাপসাইসিন রিসেপ্টর।
মজার ব্যাপার হলো, TRPV1 যে শুধু জিহ্বায় থাকে, তা নয়। এই রিসেপ্টর পাওয়া যায় মুখগহ্বর থেকে শুরু করে পৌষ্টিকনালির নানা জায়গায়। ঝাল খেলে শুধু যে মুখ জ্বলে তা নয়, পেটও জ্বলে। এটা থাকে ত্বকেও। তাই ঝালের সংস্পর্শে এলে চামড়া জ্বলে। শব্দের ব্যবহার লক্ষ করুন, আমরা বলছি ‘জ্বলে’; অর্থাৎ আমাদের ভাষায় ঝালের অনুভূতি বলতে স্বাদ নয়, বরং তাপ ও ব্যথার অনুভূতি প্রাধান্য পেয়ে আসছে। এটা নেহাত কাকতালীয় নয়। দেখা গেল, ক্যাপসাইসিন না দিয়ে স্রেফ তাপ দিলেও কোষগুলো একই রকম সাড়া দেয়। বেদনাদায়ক উদ্দীপক প্রয়োগ করলেও কোষে একই ধরনের বৈদ্যুতিক পরিবর্তন ঘটে। তার মানে TRPV1 একই সঙ্গে ঝাল, ব্যথা ও তাপ শনাক্ত করতে পারে।
ডিএনএ লাইব্রেরি থেকে একটা একটা করে জিন নিয়ে পরীক্ষা করতে করতে এমন একটা জিন পাওয়া গেল, যেটার সংকেত অনুযায়ী গঠিত প্রোটিন TRPM8-যুক্ত কোষ মিথানল প্রয়োগে উদ্দীপ্ত হয়। মিথানলকে স্বাভাবিক চাপে কক্ষ তাপমাত্রায় রেখে দিলে আপনাআপনি বাষ্পে পরিণত হতে পারে, যাকে বলে স্বতঃবাষ্পীভবন। এ সময় তা অনেকটা তাপ শুষে নিতে পারে। এ কারণে কোনো কিছুকে দ্রুত শীতল করার জন্য মিথানল ব্যবহার করা হয়। তাই গবেষকেরা ভাবলেন, TRPM8–যুক্ত কোষ যে মিথানল প্রয়োগে বৈদ্যুতিক পরিবর্তন নির্দেশ করছে, সেটা স্রেফ ঠান্ডার জন্য নয়তো? দেখা গেল, ঠিক তা–ই। মিথানল ছাড়াও যদি তাপমাত্রা দ্রুত কমিয়ে দেওয়া হয়, তবু সেই কোষগুলোতে একই রকম উদ্দীপনার চিহ্ন মেলে। এই আবিষ্কারের দাবিদার ডেভিড জুলিয়াস ও আরডেম পাটাপুটিয়ান দুজনই। কেননা, ২০০২ সালে প্রায় একই সময়ে দুজনেই এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন, একে অপরের গবেষণা সম্পর্কে না জেনে। তারপর দেখা যায়, দুজন আসলে একই জিনিস আবিষ্কার করে বসে আছেন!
কোনো একটা বৈশিষ্ট্য যদি জৈব অভিব্যক্তির ধারায় টিকে থাকার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়, তাহলে লক্ষকোটি বছর ধরে প্রজাতি থেকে প্রজাতিতে সেই বৈশিষ্ট্য প্রায় অপরিবর্তিতভাবে সঞ্চারিত হতে থাকে। তখন বিভিন্ন জীবে বা একই জীবদেহের নানা অংশে সেই বৈশিষ্ট্যের সংকেতবাহী জিন কিংবা বৈশিষ্ট্য প্রকাশক প্রোটিনের গঠন খুব কাছাকাছি হয়। এই সূত্র কাজে লাগিয়ে TRPM2, TRPM3, TRPA1 ইত্যাদি জিন ও প্রোটিন আবিষ্কার করা সম্ভব হলো, যেগুলো তাপ ও ব্যথার উদ্দীপনাকে বৈদ্যুতিক সংকেতে পরিণত করতে পারে। এগুলো ক্যাপসাইসিন বা মিথানলের প্রতিও বিভিন্ন মাত্রায় সংবেদনশীল।
এ পর্যন্ত সব পরীক্ষা–নিরীক্ষা হয়েছে দেহ থেকে আলাদা করে নেওয়া কোষে। জীবদেহে এসব রিসেপ্টর একইভাবে কাজ করে কি না, তা না দেখলে গবেষণা সম্পূর্ণ হয় না। তাই ইঁদুরে পরীক্ষামূলকভাবে এসব জিন অকেজো করে দিয়ে দেখা গেল, সেগুলো একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে গরম বা ঠান্ডার অনুভূতি কিংবা ব্যথা অনুভব করতে পারছে না। উদাহরণস্বরূপ, TRPV1 উদ্দীপ্ত হয় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। এটা কাজ না করলে মস্তিষ্ক বুঝতেই পারবে না যে গরম লাগছে। যেসব ইঁদুরে এই জিন অনুপস্থিত ছিল, সেগুলো গরম ছ্যাঁকা খেয়েও এমন ভাব করছিল, যেন কিছুই হয়নি! দেহ অতিরিক্ত গরম হয়ে গেলে তাকে ঠান্ডা হতে হয় এবং বেশি ঠান্ডা হয়ে গেলে তাপ সঞ্চয় করা লাগে। কিন্তু দেহ বেশি গরম বা ঠান্ডা হয়ে গেছে কি না, সেটা শরীর বোঝে কী করে? ঠিক ধরেছেন, এর আগে উল্লিখিত রিসেপ্টরগুলোর মাধ্যমে। তাই ইঁদুরে এসব রিসেপ্টর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে বন্ধ করে দেওয়ার পর দেখা গেল সেগুলোর দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় থাকছে না। বুঝতেই পারছেন, কেন এই জিন ও প্রোটিনগুলো জীবের টিকে থাকার ইতিহাসে এতটা গুরুত্বপূর্ণ।
স্পর্শের সঙ্গে সম্পর্কিত আরেকটি অনুভূতি হলো চাপ। আদি এককোষী জীব কিংবা সরল বহুকোষী জীব যে যান্ত্রিক চাপে সাড়া দেয়, তা আমরা এর আগে দেখেছি। প্রশ্ন হলো, জটিলতর জীবের বেলায় এটা কীভাবে কাজ করে? আগের গবেষণার সূত্র অনুযায়ী আরডেম ও তাঁর সহকর্মীরা ধরে নিলেন, অন্য অনেক অনুভূতির রিসেপ্টরের মতো চাপ শনাক্তকারী রিসেপ্টরও সম্ভবত কোনো আয়ন চ্যানেল হবে। অর্থাৎ উদ্দীপ্ত হলে এর মধ্য দিয়ে কোনো চার্জিত কণা চলাচল করবে (বা চলাচল কমে যাবে) এবং সে কারণে ঝিল্লির উভয় পাশের মধ্যকার ভোল্টেজ ও বিদ্যুৎপ্রবাহের পরিবর্তন হবে। সেটা মেপে বোঝা যাবে, কোষটি আসলেই উদ্দীপনায় সাড়া দিয়েছে। এসবই কিন্তু তখনো স্রেফ ধরে নেওয়া ব্যাপার। এ রকমটা না-ও হতে পারত। সে ক্ষেত্রে বৈদ্যুতিক সংকেত মেপে কিছুই বোঝা যেত না। তবু ‘যা আছে কপালে’ বলে কাজে লেগে পড়লেন আরডেম ও তাঁর সহকর্মীরা। আরডেম তখন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় স্ক্রিপস রিসার্চ নামের একটি অলাভজনক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
অনেক চেষ্টাচরিত্র করে আরডেম ও তাঁর সহকর্মীরা জটিল বহুকোষী জীব থেকে এমন একপ্রকার কোষ আলাদা করে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন, যেটাতে চাপ দিলে তার বৈদ্যুতিক সংকেতের পরিবর্তন ঘটে। সেই চাপ দেওয়াও চাট্টিখানি কথা নয়! পুঁচকে একটা কোষের আকারই–বা কত। সেটাকে মাইক্রোপিপেট-টিপ নামে এক অতি সরু নল দিয়ে খুব সাবধানে চাপ দিতে হয়। এ জন্য দরকার আণুবীক্ষণিক সূক্ষ্মতা। চাপ একটু বেশি হলে কোষ ছিদ্র হয়ে তার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটবে। চাপ কম হলে ভোল্টেজ বা বিদ্যুৎপ্রবাহে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটবে না। এখন প্রশ্ন হলো, চাপের রিসেপ্টর কোনটা? এটা জানার জন্য চাষ করে কোষের সংখ্যা বাড়িয়ে নেওয়া হলো। তারপর সেখানে কোন কোন জিন প্রকাশিত হয়, সেটা এমআরএনএ বিশ্লেষণের মাধ্যমে বের করা হলো। সেই বিশেষ কোষের জন্য এক সেট অনন্য জিন পাওয়া গেল। এই ধাপ TRPV1 আবিষ্কারের মতো। তবে সে ক্ষেত্রে যেমন একটা একটা করে জিন লাইব্রেরি থেকে কোষে ঢুকিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছিলেন ডেভিড ও তাঁর সহকর্মীরা, চাপের রিসেপ্টর খোঁজার বেলায় আরডেম ও তাঁর দল ধরলেন উল্টো পথ। তাঁরা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে একটা একটা করে জিনের সুইচ অফ করতে লাগলেন আর দেখতে লাগলেন, কোন জিনটা অকেজো থাকলে কোষটি চাপে উদ্দীপনা দেখায় না।
নতুন কোনো ঘরে গিয়ে কোন সুইচে একটা বিশেষ বাতি জ্বলে, সেটা দেখার দুটি উপায় আছে। সব কটি সুইচ অফ থাকা অবস্থায় একটা একটা করে সুইচ অন করতে থাকা এবং খেয়াল রাখা যে কখন সেই বাতি জ্বলে। এটা ছিল ডেভিডের পদ্ধতি। আরেকটা হলো, সব সুইচ অন থাকা অবস্থায় একটা একটা করে সুইচ অফ করতে থাকা এবং খেয়াল রাখা যে কখন সেই বাতি বন্ধ হয়। এটা আরডেমের পদ্ধতি। এভাবে অসীম ধৈর্যের সঙ্গে একে একে ৭১টি জিন অকার্যকর করেও মিলল না সোনার হরিণ। কিন্তু ৭২ নম্বর জিনটি বন্ধ করতেই দেখা গেল, কোষটি আর চাপে সাড়া দিচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত চাপ শনাক্তকারী রিসেপ্টর খুঁজে পেলেন আরডেম ও তাঁর সহকর্মীরা। সেটার নাম রাখা হলো Piezo1, যেটা কিনা চাপ-এর গ্রিক প্রতিশব্দ থেকে এসেছে। জৈব অভিব্যক্তির সূত্র ধরে খুঁজতে গিয়ে শিগগির চাপের দ্বিতীয় রিসেপ্টর আবিষ্কৃত হলো। সেটার নাম দেওয়া হলো Piezo2। দেখা গেল, রিসেপ্টর দুটি সরাসরি চাপ শনাক্ত করে না, বরং চাপের ফলে কোষঝিল্লিতে যে বিকৃতি ঘটে, সেটা শনাক্ত করে। ওটাই তাদের প্রক্সি। শুধু যে ত্বকে চাপ অনুভব করার মধ্যে এর গুরুত্ব সীমাবদ্ধ, তা নয়। কোনো প্রাণীতে পরীক্ষামূলকভাবে Piezo1 ও Piezo2 অকেজো করে দিলে তার ফল হয় মারাত্মক।
ত্বকের পাশাপাশি রক্তনালির ভেতরও থাকে এই চাপ শনাক্তকারী রিসেপ্টর। কোনো কারণে রক্তচাপ কমে গেলে তা শনাক্ত করার মাধ্যমে দ্রুত তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে সহায়তা করে এটি। ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রক্তচাপ আবার স্বাভাবিক হয়। এই রিসেপ্টর না থাকলে রক্তচাপ কমে গিয়ে হঠাৎ জীব মারা যেতে পারে। শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বুক কতটা প্রসারিত হয়েছে, তার মাপটাও আসে চাপ শনাক্ত করার মাধ্যমে। বুকে বাতাস ভর্তি হয়ে গেলে চাপের রিসেপ্টর তা শনাক্ত করে এবং তার বৈদ্যুতিক সংকেত অনুযায়ী বাতাস বের করে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। রিসেপ্টরগুলো অকেজো হয়ে গেলে শ্বাসপ্রশ্বাসের স্বাভাবিক ছন্দপতন ঘটে। খেতে খেতে কখন পেট ভরে গেল কিংবা প্রস্রাবের বেগ বুঝতে পারা—সবই আসলে চাপের অনুভূতি। এগুলো বুঝতে না পারলে কী হবে, তা বলা বাহুল্য। এমনকি আমাদের হাত-পা ও বিভিন্ন অস্থিসন্ধি বা জয়েন্ট, যেমন হাঁটু-কবজি-কনুই ইত্যাদি কখন কী অবস্থায় কত ডিগ্রি কোণে আছে, সেগুলো আমরা চোখ বুজে বলে দিতে পারি। কীভাবে? এই চাপের রিসেপ্টরের জন্য। কতটা বাঁকিয়ে ধরলে কোনো জয়েন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা জানান দেয় সেই রিসেপ্টরগুলো। এটা একধরনের ব্যথার অনুভূতি দেয় বলেই আমরা ওর বেশি বাঁকিয়ে ধরি না। এসব জায়গায় চাপ শনাক্তকারী যেসব রিসেপ্টর থাকে, সেগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহার করে মস্তিষ্ক দাঁড়ানো বা হাঁটাচলার সময় ভারসাম্য বজায় রাখার জটিল কাজটি করে। জৈব অভিব্যক্তির ধারায় জীবের টিকে থাকার ক্ষেত্রে এই Piezo1 ও Piezo2 যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার প্রমাণ হলো প্রজাতিভেদে এর প্রায় অপরিবর্তনীয় গঠন।
ডেভিড ও আরডেমের আবিষ্কার কাজে লাগিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ব্যথাসহ নানা অসুখের সমাধান বা চিকিৎসা খুঁজছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। ব্যাপক হারে এর প্রয়োগ হওয়া এখনো বাকি, তবে সম্ভাবনা অপরিসীম।
দেখা, শোনা, গন্ধ ইত্যাদি অনুভূতির রিসেপ্টর ও তার কর্মপদ্ধতি উদ্ঘাটন করার জন্য এর আগে একাধিকবার নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এবার স্পর্শ-তাপ-চাপ-ব্যথার অনুভূতির জন্য নোবেল পুরস্কার ঘোষিত হলো। কোনো অনুভূতির রিসেপ্টর কীভাবে সংকেত দেয়, সেটা জানা অবশ্য সেই অনুভূতির আদ্যোপান্ত বোঝার জন্য সব সময় যথেষ্ট নয়। আপনার ঘরের বৈদ্যুতিক বাতি বা পাখার কথা ভাবুন। একদিকে আছে সুইচ, অন্যদিকে সেই ডিভাইস। মাঝখানে আছে সংযোগকারী তার। সুইচ চাপলে বাতি জ্বলবে, নাকি পাখা ঘুরবে, সেটা সেই সুইচের ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে, কোন সুইচের সঙ্গে কোন ডিভাইসের সংযোগ দেওয়া আছে, তার ওপর। একইভাবে রিসেপ্টর কোনো উদ্দীপনা গ্রহণ করে সেটাকে বৈদ্যুতিক সংকেতে পরিণত করে ঠিকই, তবে আমরা ঠিক কী রকম অনুভব করব, সেটা নির্ভর করে তার স্নায়ুটা মস্তিষ্কের কোথায় কীভাবে সংযুক্ত, তার ওপর। একধরনের অসুখ আছে, যেখানে কেউ শব্দের স্বাদ পায়। কারণ, তার শব্দের রিসেপ্টরের (তথা সুইচ) সঙ্গে সংযুক্ত স্নায়ু (তথা তার) গিয়ে যুক্ত হয়েছে মস্তিষ্কের স্বাদগ্রাহী অঞ্চলে (তথা ডিভাইস)। কেউ আবার আলোর শব্দ শোনে। কেননা, তার আলোর রিসেপ্টরের সংযোগ ভুলক্রমে ঘটেছে মস্তিষ্কের শব্দসংকেত বিশ্লেষক অংশে। জীবের সংবেদন বিষয়ে এসব গবেষণার এখনো অনেক বাকি। ভবিষ্যতে তাই অনুভূতি বা সংবেদনসংক্রান্ত গবেষণায় হয়তো আরও নোবেল পুরস্কার আমরা আশা করতে পারি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
সূত্র: নোবেল ডট অর্গ