অবিশ্বাস্য সুন্দর ৭ প্রাকৃতিক গুহা

পৃথিবীর বুকে লুকিয়ে আছে অজানা রহস্যের ভাণ্ডার—রহস্যময় নানারকম গুহা। প্রকৃতির অপার কারুকার্যে তৈরি এই গুহাগুলো লাখ লাখ বছর ধরে গঠিত হয়েছে লোকচক্ষুর আড়ালে। এই গুহাগুলো কেবল রহস্যেই ভরা নয়, বরং অসাধারণ সৌন্দর্যেরও আধার। বিভিন্ন বর্ণের খনিজ পদার্থ, স্ট্যালাকটাইট, স্ট্যালাগমাইট, ভূগর্ভস্থ নদী, জলপ্রপাত—এই সবকিছু মিলে গুহাগুলোকে করে তুলেছে অপরূপ। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য গুহার মধ্যে কিছু গুহা তাদের অসাধারণ সৌন্দর্য ও রহস্যের জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। এই লেখায় আমরা এরকম ৭টি প্রাকৃতিক মনোরম গুহার কথা জানব।

১ / ৭

১. ম্যামথ কেভ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-মধ্য কেন্টাকি রাজ্যে অবস্থিত ম্যামথ কেভ ন্যাশনাল পার্ক, প্রকৃতির এক অপূর্ব নিদর্শন। এ জাতীয় উদ্যানের কেন্দ্রবিন্দু হলো ম্যামথ কেভ। মাটির নিচে প্রায় ৪২৬ মাইল লম্বা সুড়ঙ্গ নিয়ে বিস্তৃত এটি। এই বিশালতার কারণে গুহাটির নাম দেওয়া হয়েছে ম্যামথ কেভ, যাকে বিশ্বের দীর্ঘতম গুহাপ্রণালী বা সিস্টেম বলা হয়।

এই গুহার বিশেষত্ব হলো, এর মধ্যেই রয়েছে আস্ত একটি জঙ্গল, নদী-উপত্যকা, চুনাপাথরের চেম্বার, জলপ্রপাত, গিরিখাত, ভূগর্ভস্থ ঝর্ণা, বিশালাকার গম্বুজসহ আরও অনেক কিছু। স্ট্যালাকটাইট—ছাদে ঝুলে থাকা ঝাড়বাতির মতো খনিজের সমারোহ ও স্ট্যালাগমাইট—বৃক্ষমূলের মতো মাটি থেকে বেরিয়ে থাকা খনিজ সারিতে সাজানো এই গুহা। ম্যামথ গুহায় যে চুনাপাথরের স্তর রয়েছে, সেগুলো আনুমানিক ৩২ থেকে ৩৬ কোটি বছর আগে গঠিত হয়েছিল বলে ধারণা স্পিলিওলজিস্ট বা গুহাবিজ্ঞানীদের। কিন্তু এ গুহার গঠন শুরু হয় মাত্র এক থেকে দেড় কোটি বছর আগে।

ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক গুরুত্বের কারণে ম্যামথ কেভ সিস্টেমকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই গুহাটিতে অনেক বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীর বাসস্থান। দেশ-বিদেশের বহু পর্যটকের কাছে বিশাল এই গুহাটি রয়েছে আকর্ষণের কেন্দ্রে।

২ / ৭

২. হ্যাং সন ডুং

হ্যাং সন ডুং অর্থ পাহাড়ি নদীর গুহা। এটি মধ্য ভিয়েতনামের কোয়াং বিন প্রদেশের পং না-কে বং ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত। গুহাটির মোট আয়তন প্রায় ৩ কোটি ৮৫ লাখ ঘন মিটার। এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় গুহা। দৈর্ঘ্য প্রায় ৯ কিলোমিটার, প্রস্থে ২০০ মিটারের মতো। উচ্চতা প্রায় ১৫০ মিটার। তবে গুহাবিজ্ঞানীদের মতে, এটা আরও বড় হতে পারে। কারণ এ গুহার ৭০ ভাগই এখনো অজানা।

গুহাটি দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। ১৯৯১ সালে ভিয়েতনামের এক স্থানীয় শিকারি এটি আবিষ্কার করেন। পরে ২০০৯ সালে ব্রিটিশ স্পিলিওলজিস্টদের একটি দল সেখানে অভিযান চালায়। গুহাটির কিছু অংশ সরাসরি সূর্যের আলোয় আলোকিত থাকে। কারণ সেখানে বেশ কয়েকটি বড় গর্ত আছে। সেই গর্ত দিয়ে সূর্যের আলো গুহায় পৌঁছায়। সেখানে আছে প্রাচীন গাছ, ঝুলন্ত লতা, ভূগর্ভস্থ নদী, ঝর্ণা ও নানা রকম প্রাণী। বাইরের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন এই গুহার আছে নিজস্ব আবহাওয়া ব্যবস্থা।

ধারণা করা হয়, ২০ থেকে ৫০ লাখ বছর আগে গুহাটি সৃষ্টি হয়েছে। হ্যাং সন ডুং গুহা প্রতিবছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। তবে একসঙ্গে দশ জনের বেশি পর্যটক সেখানে যেতে পারেন না।

৩ / ৭

৩. ওয়াইটোমো গ্লোওয়ার্ম কেভ

নিউজিল্যান্ডের নর্থ আইল্যান্ডের ওয়াইটোমো অঞ্চলে অবস্থিত এ গুহা। প্রায় ৩ কোটি বছর আগে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে গুহাটির সৃষ্টি বলে ধারণা করা হয়। ওয়াইটোমো গ্লোওয়ার্ম গুহাটির নাম এসেছে গ্লোওয়ার্ম পোকা থেকে। এই পোকাগুলো বায়োলুমিনিসেন্ট প্রজাতির জীব। বায়োলুমিনিসেন্স মানে, জৈব আলো। যেসব জীব দেহ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আলো নিঃসরণ করতে পারে, তাদের বলে বায়োলুমিনিসেন্ট। এ গুহার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বায়োলুমিনিসেন্ট আরাকনোক্যাম্পা লুমিনোসা (Arachnocampa luminosa)। এমনিতে এগুলো নিউজিল্যান্ড গ্লোওয়ার্ম বা শুধু ‘গ্লোওয়ার্ম’ নামেই পরিচিত। গুহার দেয়ালে বসবাস করে। রাতের আকাশে তারার মতো দেখায় এগুলোকে। প্রতিবছর গুহাটিতে ভিড় জমায় পর্যটকেরা। ১৮৮৭ সালে স্থানীয় মাওরি প্রধান টেন টিনোরাউ এবং ব্রিটিশ সার্ভেয়ার ফ্রেড মেস গুহাটি আবিষ্কার করেন। ১৯০৪ সালে এ গুহা নিয়ে শুরু হয় গবেষণা। এ ছাড়াও গুহাটিতে পাওয়া গেছে নানা ধরনের ফাঙ্গাস, আগ্নেয়গিরি থেকে সৃষ্ট চুনাপাথর ও জীবাশ্ম।

৪ / ৭

৪. কেভ অব দ্য ক্রিস্টালস

মেক্সিকোর চিহুয়াহুয়ার নেইকার খনির গভীরে লুকিয়ে আছে প্রকৃতির এক অসাধারণ বিস্ময়—কেভ অব দ্য ক্রিস্টালস। ২০০০ সালের দিকে খনির দুই শ্রমিক গুহাটি আবিষ্কার করেন। দেখতে অনেকটা ঘোড়ার খুরের মতো। চারপাশ চুনাপাথরে ঘেরা। দৈর্ঘ্য ৯০ ফুট, প্রস্থ ৩০ ফুটের মতো। পুরোটা ক্রিস্টাল বা স্ফটিক-সমৃদ্ধ। ভূবিজ্ঞানী গার্সিয়া রুইজ ও তাঁর দল এই গুহা নিয়ে গবেষণা করছে। ক্রিস্টালগুলো আসলে সেলেনাইট বা ক্যালসিয়াম সালফেটের তৈরি। একসময় এই গুহায় গরম লবণাক্ত পানির প্রবাহ ছিল।

ভূতাত্ত্বিকদের ধারণা, গুহাটি প্রায় পাঁচ লাখ বছর আগে তৈরি হয়েছিল। এর অবস্থান ছিল ভূমি থেকে প্রায় ৩ থেকে ৫ কিলোমিটার গভীরে। সেখানে ম্যাগমার প্রবাহ ছিল। আর ভূগর্ভস্থ পানি ওই ম্যাগমার সঙ্গে মিশে তৈরি হয়েছে এসব অসাধারণ ক্রিস্টাল।

৫ / ৭
Budkov Denis

৫. কামচাটকা আইস কেভ

রাশিয়ার কামচাটকা উপদ্বীপে অবস্থিত কামচাটকা আইস কেভ, মানে বরফের গুহা। যেমন বিস্ময়কর, তেমনি মনমুগ্ধকর। প্রায় ১ কিলোমিটার দীর্ঘ। হিমবাহের নীচে বরফের তৈরি প্রাকৃতিক খিলানের মতো গঠন। গুহার ভেতরে বরফের তৈরি অসাধারণ ভাস্কর্য, স্তম্ভ ও ঝুলন্ত বরফের তৈরি ঝর্ণা দেখা যায়। বরফের মধ্যে রয়েছে খনিজ পদার্থ। তাই নীল দেখায়। গুহাটিতে বিভিন্ন আকারের সুড়ঙ্গ রয়েছে। কিছু অত্যন্ত সরু, আর কিছু প্রশস্ত।

এ ছাড়াও, এই উপদ্বীপে আরও অনেক অসাধারণ প্রাকৃতিক নিদর্শন রয়েছে। ২৯টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরিসহ মোট ১৬০টির মতো আগ্নেয়গিরি আছে এ দ্বীপে। এর বেশ কয়টি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকায় রয়েছে।

৬ / ৭

৬. ব্লু গ্রোটো কেভ

ব্লু গ্রোটো কেভ ইতালির কাপ্রি দ্বীপের উপকূলে অবস্থিত। এটি মূলত নীল পানির জন্য বিখ্যাত। সূর্যের আলোর প্রতিফলনের কারণে পানির রং নীল হয়। গুহাটি প্রায় ৫০ মিটার লম্বা ও ৩০ মিটার প্রশস্ত। এটি ছোট প্রবেশদ্বারের মাধ্যমে সমুদ্রে যুক্ত হয়েছে। প্রবেশদ্বারটি এত ছোট যে গুহায় প্রবেশ করার জন্য দর্শনার্থীদের ছোট নৌকায় যেতে হয়।

গুহার ভেতরে পানি এত পরিষ্কার যে ৩০ ফুট গভীরের জিনিস স্পষ্ট দেখা যায়। আকাশের রং ও সূর্যের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে পানির রং নীল থেকে ফিরোজায় বদলে যায়।

গুহাটি প্রায় ২ হাজার বছর আগে তৈরি হয়েছিল। এটি রোমানদের কাছে পবিত্র স্থান হিসাবে পরিচিত ছিল। ১৮২৬ সালে জার্মান কবি আগস্ট কোপিশ গুহাটি ফের আবিষ্কার করেন।

৭ / ৭

৭. আইসরিজেনওয়েল্ট কেভ

অস্ট্রিয়ার সালজবার্গ প্রদেশের ওয়ারফেন শহরের হোচকোগেল পর্বতমালায় অবস্থিত আইসরিজেনওয়েল্ট। এর অর্থ, বরফ দানবদের জগৎ। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় বরফের গুহা। এর পথ প্রায় ৪২ কিলোমিটার বিস্তৃত। গুহাটির বয়স প্রায় ১০ কোটি বছর।

কোটি কোটি বছর আগে নদী প্রবাহের ক্ষয় ও টেকটোনিক প্লেট সরে যাওয়ার কারণে গুহাটি এমন বড় এবং বরফাকৃত। তবে সম্পূর্ণ গুহাটি বরফে ঢাকা নয়। বছরের সব সময়ই এটি ঠান্ডা থাকে। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে শুধু প্রথম কয়েক কিলোমিটার দশনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। ১৮৭৯ সালে সালজবার্গের একজন প্রাকৃতিক বিজ্ঞানী অ্যান্টন পোসেল্ট গুহাটি আবিষ্কার করেন। তিনি প্রথম ২০০ মিটার অনুসন্ধান করেছিলেন। প্রতিবছর ২০ হাজার পর্যটক এ গুহা দেখতে যায়।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা

সূত্র: টপটেনজ ডট নেট, উইকিপিডিয়া, সিএনএন