মানবদেহ বলতে একটি মানুষের পূর্ণাঙ্গ দেহ কাঠামোকে বোঝায়। অর্থাৎ, মাথা ও ঘাড় থেকে শুরু করে হাত এবং পায়ের পাতা পর্যন্ত। মানবদেহের প্রতিটি অঙ্গই বিভিন্ন ধরনের কোষ দিয়ে গঠিত। এ কোষের সংখ্যা গড়ে প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন।
মানবেদের অঙ্গ বলতে অনেকগুলো টিস্যুর সমষ্টিকে বোঝায়। কোনো নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদনের জন্য টিস্যুগুলো একত্রে কাজ করে। যদিও মানবদেহের অঙ্গের ব্যাপারে নানান বিজ্ঞানীর নানা মত আছে। তবে সবচেয়ে প্রচলিত মতানুসারে, মানুষের শরীরে মোট অঙ্গ আছে ৭৮টি। এর মধ্যে মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ডের পাশাপাশি জিহ্বার মতো অনেক ছোট ছোট অংশও রয়েছে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে ভারী কোনটি? চলুন, মানবদেহের সবচেয়ে ভারী ১০টি অঙ্গের ব্যাপারে জানা যাক।
মানবদেহের সবচেয়ে ভারী অঙ্গটির নাম শুনলে হয়ত আপনি অবাক হবেন। এই অঙ্গের নাম ত্বক। মানে মানুষের চামড়ার ওজনই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এটা ঠিক কতটা ভারী, তা নিয়ে আছে বিতর্ক। কিছু উৎস অনুসারে ত্বকের ওজন গড়ে ৩ কেজি ৬০০ গ্রাম। আবার অন্য একটি সূত্রানুসারে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরের মোট ভরের ১৬ শতাংশ ত্বকের ওজন। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের গড় ওজন ৭৭ কেজির। সে হিসেবে ত্বকের গড় ওজন দাঁড়ায় ১২ কেজি ৩ গ্রাম।
কিন্তু একই অঙ্গের কেন দুই রকম ওজন হবে? আসলে ১৯৪৯ সালে জার্নাল অব ইনভেস্টিগেটিভ ডার্মাটোলজি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে প্যানিকুলাস অ্যাডিপোসাসকেও ত্বকের অংশ হিসেবে ধরা হয়। অর্থাৎ, ওই স্তরটিও ত্বক। এ স্তরটি ত্বকের ওপরের স্তর এবং পেশির স্তরের মাঝে অবস্থিত। এই প্যানিকুলাস অ্যাডিকুলাসকে ত্বকের অংশ হিসেবে ধরলে, আমাদের ত্বকের ওজন হয় গড়ে ১২ কেজির বেশি। কিন্তু এই স্তরটিকে ত্বক হিসেবে বিবেচনা না করলে ওজন কমে হয় ৩ কেজি ৬০০ গ্রাম। তবে আধুনিককালে প্যানিকুলাস অ্যাডিপোসাসকে ত্বকের অংশ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। মজার ব্যাপার হলো, প্যানিকুলাস অ্যাডিপোসাসকে ত্বকের অংশ হিসেবে বিবেচনা করুন আর না-ই করুন, ত্বকই মানবদেহের সবচেয়ে ভারী অঙ্গ। কারণ মানবদেহের আর কোনো অঙ্গের ওজন ৩ কেজি নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের লিভার ফাউন্ডেশনের মতে মানবদেহের দ্বিতীয় ভারী অঙ্গ লিভার। এর ওজন প্রায় ১ কেজি ৪০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ৬০০ গ্রাম। লিভার একটি কোন বা শঙ্কু আকৃতির অঙ্গ যা পেটের ওপরে এবং ডায়াফ্রামের ভেতরে ফুসফুসের নিচে অবস্থিত। লিভার বিষকে অণু পরমাণুতে ভেঙ্গে ফেলে এবং খাদ্য হজমে সহয়তা করে। জন হপকিন্স মেডিসিন-এর মতে লিভার প্রায় ৫০০ গ্রাম রক্ত ধারণ করে।
মানুষের চিন্তাভাবনা থেকে শুরু করে চলাফেরা—সবই নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। পাশাপাশি শরীরের আরও নানা কাজে আছে মস্তিষ্কের হস্তক্ষেপ। মস্তিষ্কের গড় ওজন একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরের প্রায় ২ শতাংশ। অবশ্য মানুষের বয়স ও লিঙ্গের ওপর নির্ভর করে মস্তিষ্কের ভর কম বেশি হতে পারে। ২০ বছর বয়সের একজন পুরুষের মস্তিকের ওজন ১ কেজি ৪০০ গ্রাম। কিন্তু ৬৫ বছর বয়সে এ ওজন কমে ১ কেজি ৩০০ গ্রামে নেমে আসে। এনসাইক্লোপিডিয়া অব হিউম্যান ব্রেইন-এর তথ্যানুসারে মহিলাদের মস্তিষ্কের ওজন পুরুষদের তুলনায় ১০ শতাংশ কম থাকে। তবে ১৯৯২ সালে প্রকাশিত ইন্টিলিজেন্স জার্নালের মতে, পুরুষদের মস্তিষ্কের ওজন মহিলাদের তুলনায় মাত্র ১০০ গ্রাম ভারী।
মানবদেহের আরও একটি ভারী অঙ্গ ফেমার। ২০১৯ সালে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব বায়োলজিকাল সায়েন্স-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরের মোট ওজনের প্রায় ১৫ শতাংশ ওজন কঙ্কালের। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের কঙ্কালে ২০৬টি হাড় থাকে। যদিও কিছু মানুষের অতিরিক্ত পাঁজর থাকতে পারে। মানবদেহের এই হাড়গুলোর মধ্যে ফেমারই সবচেয়ে বড়। এটি মানুষের হাটু ও নিতম্বের মাঝামাঝি অবস্থিত। ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত অ্যাক্টা অ্যানাটমিকা জার্নালের মতে, ফিমারের গড় ওজন ৩৮০ গ্রাম থেকে ৪০০ গ্রাম। তবে ব্যক্তিভেদে বয়স, লিঙ্গ এবং স্বাস্থের অবস্থার ওপর নির্ভর করে ফেমারের ওজন পরিবর্তন হয়।
ফুসফুস মানবদেহের সবচেয়ে ভারী অঙ্গগুলোর মধ্যে একটি। মানুষের শরীরে দুটি ফুসফুস থাকে। ডান ফুসফুসের ওজন বাঁয়েরটির তুলনায় ভারী হয়। ডান ফুসসুসের ওজন প্রায় ৬০০ গ্রাম। আর বাঁ ফুসফুসের ওজন ৫০০ গ্রামের কিছুটা বেশি। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের ফুসসুস মহিলাদের তুলনায় কিছুটা ভারী হয়। মজার ব্যাপার হলো, জন্মের সময় ফুসফুসের ওজন থাকে মাত্র ৪০ গ্রাম।
মানবদেহের আরও কিছু ভারী অঙ্গের মধ্যে আছে হৃৎপিণ্ড, কিডনি, প্লীহা ও অগ্ন্যাশয়। একজন প্রাপ্তবয়ষ্ক পুরুষের হৃৎপিণ্ডের ওজন ২৮০ থেকে ৩৪০ গ্রাম। অন্যদিকে ২৩০ থেকে ২৮০ গ্রাম মহিলাদের হৃৎপিণ্ডের ওজন। পুরুষদের গড় কিডনির ওজন ১২৫ থেকে ১৭০ গ্রাম এবং মহিলাদের ১১৫ থেকে ১৫৫ গ্রাম।
প্লীহার অবস্থান অগ্ন্যাশয়ের কাছেই। প্রাপ্তবয়স্কদের প্লীহার গড় ওজন ১৫০ গ্রাম। তবে ব্যক্তিভেদে এই ওজন পরিবর্তন হতে পারে। আর অগ্ন্যাশয়ের গড় ওজন ৬০ থেকে ১০০ গ্রাম। তবে ব্যক্তিভেদে অগ্ন্যাশয়ের ওজন ১৮০ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। অগ্ন্যাশয় মূলত রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
লেখক: সম্পাদনা দলের সদস্য, বিজ্ঞানচিন্তা
সূত্র: লাইভ সায়েন্স ডট কম