শ্বাস-প্রশ্বাসে চোখের মণির আকার পরিবর্তন হয়, ভেঙে গেল ১০০ বছরের ধারণা

চোখ মনের কথা বলে। চোখ দেখেই নাকি ব্যক্তির অভিব্যক্তি, মনের অনেক কথা বলে দেওয়া যায়। চোখের সঙ্গে মনের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। সম্প্রতি জানা গেছে, আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গেও চোখের সংযোগ রয়েছে।  এ বিষয়ক গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে দ্য জার্নাল অব ফিজিওলজিতে।

চোখের মণি ক্যামেরার অ্যাপারচারের মতো চোখে আলো প্রবেশের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে। ঠিক কতটুকু আলো আমাদের দৃষ্টিশক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তা মণিই ঠিক করে। মণির আকার প্রভাবিত করতে পারে, শতবর্ষ বা আরও আগে এমন তিনটি কারণ নির্ণয় করেছেন বিজ্ঞানীরা। সেগুলো হলো আলোর পরিমাণ, ফোকাস দূরত্ব এবং আবেগ বা মানসিক চাপের মতো সংবেদনশীলতা।

বিজ্ঞানীরা অনেক চেষ্টার পর চতুর্থ কারণ হিসেবে আবিষ্কার করেছেন শ্বাস-প্রশ্বাস। গবেষণায় দেখা গেছে, শ্বাস নেওয়ার সময় মণি ছোট হয় এবং শ্বাস ছাড়ার সময় বাড়ে। মস্তিষ্কের ব্রেনস্টেম এই প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। এটি দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে পারে ও স্নায়বিক রোগ নির্ণয়ের সম্ভাব্য ক্লিনিক্যাল প্রয়োগের সুযোগ করে দিতে পারে।

চোখের মণির আকার নানা কারণে পরিবর্তন হয়। আমরা নিজেরাই এই বিষয়টা অনেক সময় অনুভব করি। চোখে হঠাৎ আলো এসে পড়লে চোখের মণি ছোট হয়ে যায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিষয়টা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। মণি বড় হলে দূরের অস্পষ্ট বস্তু শনাক্ত করা সহজ হয়। অন্যদিকে, ছোট মণি দৃষ্টিশক্তি তীক্ষ্ম করে। পড়ার সময় এই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বেশি উপকারী।

আরও পড়ুন
সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট এবং নেদারল্যান্ডসের ইউনিভার্সিটি অব গ্রোনিঙ্গেনের গবেষকেরা নতুন এই প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি প্রথম প্রমাণ করতে সফল হন। শতবর্ষ পরে উন্মোচন করা চতুর্থ এই প্রভাবের নাম দেওয়া হয়েছে ‘পিউপিলারি রেসপিরেটরি ফেস রেসপন্স’।

চোখের মণির আকার নির্ধারণ করে ফোকাস দূরত্ব। যেমন কাছের কোনো বস্তুর ওপর অল্প আলোয় ফোকাস করতে কষ্ট হয়। তখন মণির আকার ছোট বা সংকুচিত হয়। এতে কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি সহজে দেখা যায়। এ ছাড়াও মানসিক চাপ বা আবেগেও চোখের মণি প্রসারিত হয়। জার্মান গবেষক আইরিন লোভেনফিল্ড চোখের মণি গবেষণার পথিকৃৎ। তিনি বলেছিলেন, ‘একজন মানুষ আবেগে লজ্জায় লাল বা শুকিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেলেও চোখের মণি সব সময় বড়ই হবে।’

সুইডেনের ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউট এবং নেদারল্যান্ডসের ইউনিভার্সিটি অব গ্রোনিঙ্গেনের গবেষকেরা নতুন এই প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি প্রথম প্রমাণ করতে সফল হন। শতবর্ষ পরে উন্মোচন করা চতুর্থ এই প্রভাবের নাম দেওয়া হয়েছে ‘পিউপিলারি রেসপিরেটরি ফেস রেসপন্স’। ক্যারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের ক্লিনিক্যাল নিউরোসায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আরটিন আরশামিয়ান এই গবেষণাদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনিই এই প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

আরটিন বলেন, ‘প্রতিক্রিয়াটি চলে চক্রাকারে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ কাজটা চলে শরীরের ভেতরে। বাইরের কোনো উদ্দীপনা এতে প্রয়োজন হয় না। এর অনন্য এক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সংকোচন ও প্রসারণ উভয়ই একসঙ্গে নিয়ন্ত্রিত হয়। শ্বাস নেওয়ার সময় চোখের মণি সবচেয়ে ছোট এবং ছাড়ার সময় সবচেয়ে বড় হয়।’ 

গত ৫০ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা চোখের মণির সঙ্গে শ্বাস-প্রশ্বাসের সম্পর্ক অনুমান করার চেষ্টা করছেন। তবে সেই গবেষণাগুলোতে নিশ্চিতভাবে কিছু প্রমাণ করতে পারেনি। তবে বিজ্ঞানীরা দমেও যাননি। তাঁরা গবেষণা চালিয়ে গেছেন।

আরও পড়ুন
অংশগ্রহণকারীদের বলা হয় তিনটি ধাপ অনুসরণ করতে—শুধু নাক দিয়ে শ্বাস নেওয়া, শুধু মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়া এবং শ্বাসের গতি কমিয়ে ও বাড়িয়ে শ্বাস নেওয়া। প্রত্যেক ধাপে একই ফল পাওয়া গেছে। শ্বাস নেওয়ার শুরুতে চোখের মণি থাকে ছোট, শ্বাস ছাড়ার সময় মণি বড় হয়।

একটা গবেষণায় ২০০ জনের বেশি মানুষের ওপর পাঁচটি পরীক্ষা চালানো হয়। এতে দেখা যায়, শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মণির পরিবর্তন ঘটে এবং এই প্রভাব বেশ শক্তিশালী ও ধারাবাহিক। গবেষণায় অংশ নেওয়া সবাইকে ল্যাবে এনে তাঁদের চোখের মণির আকার এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দ পরীক্ষা করা হয়। তখন তাঁদের কেউ ছিলেন বিশ্রামে, কেউ আবার কম্পিউটারের পর্দার সামনে বসে কাজ করছিলেন।

শুরুতেই গবেষকেরা নিশ্চিত হতে চাইলেন, এই পরিবর্তন অন্য কোনো কারণে হচ্ছে কি না। তাই আলোর পরিমাণে পরিবর্তন, ফোকাস দূরত্বের তারতম্য ও মনযোগের মাত্রা পরিবর্তন করে আবার পরীক্ষা করেন। কিন্তু তিন পরিস্থিতিতেই শ্বাসের প্রভাব ছিল একই।

এরপর নাক ও মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়ার পার্থক্য তুলনা করা হয়। অংশগ্রহণকারীদের বলা হয় তিনটি ধাপ অনুসরণ করতে—শুধু নাক দিয়ে শ্বাস নেওয়া, শুধু মুখ দিয়ে শ্বাস নেওয়া এবং শ্বাসের গতি কমিয়ে ও বাড়িয়ে শ্বাস নেওয়া। প্রত্যেক ধাপে একই ফল পাওয়া গেছে। শ্বাস নেওয়ার শুরুতে চোখের মণি থাকে ছোট, শ্বাস ছাড়ার সময় মণি বড় হয়। যদিও এই পরিবর্তনের মান খুব সামান্য, মিলিমিটারের ভগ্নাংশ মাত্র। প্রশ্ন হলো, এই সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলো কি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকেও প্রভাবিত করে?

তাত্ত্বিকভাবে হয়তো এই পরিবর্তনের মান যথেষ্ট বড় হবে, যা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও উপলব্ধিকে প্রভাবিত করতে পারে। ফলে আমাদের দৃষ্টি এক নিশ্বাসেই বদলে যেতে পারে সূক্ষ্মভাবে। ক্ষীণ বস্তু শনাক্ত করতে মণির আকার বড় হয় এবং সূক্ষ্ম পার্থক্য ধরতে মণির আকার ছোট হয়। এ ছাড়াও আলোতে চোখের মণির পরিবর্তন দেখে যেমন অনেক রোগ নির্ণয় করা যায়, তেমনি শ্বাস-প্রশ্বাস ও চোখের মণির আকারের পরিবর্তনের মধ্যে থাকা সম্পর্কের পরিবর্তনও কোনো স্নায়বিক রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে।

ফলে আপনার শ্বাস-প্রশ্বাসের ছন্দও আপনার স্বাস্থ্যের হালহকিকত বলে দিতে পারে। আপনার উপলব্ধি ও দৃষ্টিভঙ্গি চোখের মণির সঙ্গে শ্বাস-প্রশ্বাসের সংযোগের মাধ্যমে গড়ে উঠতে পারে। তবে দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্ন ধরন ও আচরণ তৈরিতেও এটা ভূমিকা রাখে কি না—তা এখনই নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। এ জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।

লেখক: শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ, ঢাকা কলেজ

সূত্র: সাইটেকডেইলি ডটকম, দ্য কনভারসেশন ডটকম