সমুদ্রের সব মাছ ধরে ফেললে কী হতো

পৃথিবীর ৪ ভাগের প্রায় ৩ ভাগ তলিয়ে আছে পানির নিচে। এই বিপুল জলরাশির নাম সমুদ্র। আরও সঠিকভাবে বললে, পৃথিবীর মোট আয়তনের ৭১ ভাগ এই সমুদ্র। আকারে যেমন বিশাল, তেমনি এখানে আছে জীবনের এক মহাসমারোহ। জানা-অজানা কত রকম উদ্ভিদ, জীবাণু, পোকামাকড়, প্রবাল, স্তন্যপায়ী আর মাছে ভরপুর এই সমুদ্ররাজ্য! আসলে, পৃথিবীর সব অঞ্চলের সমুদ্রেই মাছের দেখা মেলে। এগুলোকেই বলা যায় সমুদ্রের প্রধান বাসিন্দা।

জীবদেহ গঠনের অন্যতম মৌলিক উপাদান কার্বন। সমুদ্রে মাছের পরিমাণ এত বেশি যে প্রাণিজগতে কার্বনের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাণ্ডার হিসেবে বিবেচনা করা হয় এগুলোকে।

বেশির ভাগ মানুষ সমুদ্র দেখেন তীর বা জাহাজ থেকে। ফলে সমুদ্রের পেটে কী আছে, তা কল্পনা করা আমাদের পক্ষে কঠিন। আসলে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তলা পর্যন্ত মাছ আর মাছ। হরেকরকম এগুলোর আকার-আকৃতি। ছোট লইট্টা ছুরি বা সার্ডিন যেমন দেখা যায় প্রবাল প্রাচীরের চারপাশে, তেমনি অতিকায় টুনা কিংবা হাঙরের মতো দৈত্যাকার মাছও রয়েছে মুক্ত সমুদ্রে। সমুদ্রের উপকূলীয় অঞ্চল বা অগভীর অংশে থাকে প্রবাল প্রাচীর।

সমুদ্রের প্রবাল
ছবি: সংগৃহীত

সমুদ্রের বাস্তুসংস্থানে মাছের ভূমিকা অনন্য। অন্যান্য প্রাণ নানাভাবে মাছের ওপর নির্ভরশীল। এগুলো যদি কখনো হারিয়ে যায়, সমুদ্রের গোটা চিত্রই বদলে যাবে। কীভাবে বদলে যাবে, তা একটু পর বলছি। আগে মাছের গুরুত্বটা একটু বোঝার চেষ্টা করি।

সমুদ্রের বাস্তুসংস্থানে শিকারি ও শিকার—দুই রূপেই দেখা যায় মাছকে। এরা অন্য প্রাণী শিকার করে খায়। আবার অন্য প্রাণীরাও মাছ শিকার করে। সমুদ্র তো বটেই, আকাশের অনেক প্রজাতিও বেঁচে থাকার জন্য সরাসরি নির্ভর করে মাছের ওপর। মাছ খেয়ে জীবনধারণ করে। এর মধ্যে আছে মানুষও। প্রবাল প্রাচীরের বাস্তুসংস্থানে ছোট ছোট মাছ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বড় মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর খাদ্যে পরিণত হয়। অর্থাৎ এখানকার খাদ্যজালে ছোট মাছগুলো ভিত্তিমূল হিসেবে কাজ করে। বড় মাছসহ অন্যান্য প্রাণীদের শক্তি জোগায়।

নদীর বাঁকের কাছে থাকা অনেক গাছ নিজেদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত পায় মৃত স্যামনের দেহাবশেষ থেকে।

এর বাইরে খোলা সাগরে অনেক পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং সরীসৃপ মাছ খায়। এসব প্রাণীর দেহের প্রয়োজনীয় প্রোটিনের মূল জোগান আসে মাছ থেকে। এমনকি ডাঙার গাছও মাছের উপস্থিতিতে লাভবান হয়। উদাহরণ হিসেবে স্যামন মাছের কথা বলা যায়। ছোট এই মাছগুলো দলবেঁধে চলাফেরা করে। জন্ম মিঠাপানিতে হলেও কিছুদিনের মধ্যেই চলে যায় সমুদ্রে। যৌবনকালটা সমুদ্রে কাটিয়ে কয়েক বছর পর প্রজননের জন্য আবার ফেরে উপকূলের দিকে। অবশ্য নদী থেকে সমুদ্রে যাওয়া-আসা করতেই জীবনের শেষ লগ্নে চলে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে এটি বেশ স্বাভাবিক ঘটনা। এ সময় স্যামন মাছের ঝাঁকের সঙ্গে প্রচুর পুষ্টি উপাদান উঠে আসে সমুদ্র থেকে। এই পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে তীরের গাছ। গবেষণায় দেখা গেছে, নদীর বাঁকের কাছে থাকা অনেক গাছ নিজেদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত পায় মৃত স্যামনের দেহাবশেষ থেকে।

পৃথিবীজুড়ে প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী।

অর্থাৎ স্যামন যে শুধু শিকারী প্রাণীর খাবারে পরিণত হয়ে পুষ্টি সরবহার করে, এমন নয়। পরোক্ষভাবে এদের কারণে গাছেরাও প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায়। সুন্দরবনের গাছেরা পুষ্টি পায় সামুদ্রিক মাছের কল্যাণে।

মানুষ তো সরাসরিই মাছ খায়। পৃথিবীজুড়ে প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী। ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়, হাজার বছর ধরে মানুষ মাছ খেয়ে আসছে। অর্থাৎ আমাদের খাদ্য তালিকায় মাছের অবস্থান বেশ শক্ত।

তবে মাছ শুধু খাবার নয়। মাছ নিজেও খাদ্য খায়। অন্যান্য প্রাণীর বাসস্থান তৈরি এবং ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। প্রবাল প্রাচীরের বাস্তুসংস্থানে তৃণভোজী মাছেরা জীবনধারণ করে শৈবাল খেয়ে। ফলে অতিরিক্ত শৈবাল জমে না। এসব মাছ ছাড়া শৈবালের বৃদ্ধি অনেক বেশি হতো। প্রবাল মসৃণ হয়ে মারা পড়ত একসময়।

সামুদ্রিক মাছ
ছবি: সংগৃহীত
সমুদ্র সৈকতে আমরা যে চমৎকার সাদা বালি দেখি, সেটার পেছনেও প্যারোট ফিশের বিষ্ঠার অবদান রয়েছে।

আবার আরেক ধরনের তৃণভোজী মাছ আছে। নাম প্যারোট ফিশ। এরা সরাসরি প্রবালকেই খাবার হিসেবে গ্রহণ করে। শুনতে কিছুটা খারাপ শোনালেও, এটা আসলে প্রবালের জন্য উপকারী। এতে প্রবালের বৃদ্ধি বাড়ে। প্যারোট ফিশের বিষ্ঠা প্রবালের জন্য পুষ্টিকর বলে প্রমাণিত হয়েছে বিভিন্ন গবেষণায়। সমুদ্র সৈকতে আমরা যে চমৎকার সাদা বালি দেখি, সেটার পেছনেও প্যারোট ফিশের বিষ্ঠার অবদান রয়েছে।

প্যারোট ফিশের মতো অন্যান্য মাছও তার চারপাশের প্রাণীদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরির কাজ করে। বালি থেকে খাবার খুঁজে খাওয়ার সময় এলোমেলো করে বালি। ফলে বালির নিচ থেকে বেরিয়ে আসে অনেক অণুজীব। এগুলো আবার অন্য প্রাণীর খাবারে পরিণত হয়। কিছু মাছ খাবারের সন্ধানে বালির মধ্য দিয়ে রীতিমতো সাঁতার কাটে। বালির আন্দোলনের ফলে প্রচুর খনিজ উপাদান ও খাবার মুক্ত হয় পানিত।

অনেক মাছ সমুদ্রে বাস করলেও এদের গুরুত্ব কেবল সমুদ্রে সীমাবদ্ধ নয়। এ কথা অবশ্য আগেই বলেছি। বিভিন্ন বাস্তুসংস্থান প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মাছের সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে সমুদ্রের সব মাছ ধরে ফেললে তার প্রভাব পুরো জীবজগতের ওপরেই কম-বেশি পড়ত। মাছহীন পৃথিবী প্রাণ ও পরিবেশের জন্য মোটেই সুবিধার কিছু হতো না। হয়তো পুরো সমুদ্রের বাস্তুসংস্থানই ভেঙে পড়ত। মাছ ছাড়া পৃথিবীর সমুদ্র-সৈকতগুলো সুন্দর সাদা বালিতে আবৃত থাকত না। প্রবাল প্রাচীরের অপরূপ সৌন্দর্য ঢাকা পড়ত শেওলার পুরু আস্তরণে। প্রচুর মানুষ বঞ্চিত হতো প্রয়োজনীয় প্রাণিজ আমিষ থেকে। কর্মহারা হতো মৎস্যজীবী ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলো। পৃথিবী হয়তো টিকে থাকত। কিন্তু তা এখনকার মতো সুন্দর হতো না কোনোভাবেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, অ্যাপ্লাইড ফিজিকস অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: দ্য কনভারসেশন