হরমোন কীভাবে কাজ করে

খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ সালে চীনে চিকিৎসার প্রয়োজনে মূত্র থেকে হরমোন আলাদা করার প্রমাণ পাওয়া যায়। ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইতালিতে বয়ঃসন্ধিকালের আগেই ‘ক্যাস্ট্রাটোস’ নামে পরিচিত অপেরা গায়কদের অণ্ডকোষ ফেলে দেওয়া হতো। এর ফলে তাঁরা তীক্ষ্ণ স্বরে গান গাইতে পারতেন

হরমোন শব্দটি এখন খুবই পরিচিত। হরমোন ব্যবহার করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ কিংবা গর্ভনিরোধ সম্পর্কে আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। বয়ঃসন্ধিকালে হরমোনের প্রভাবও আমাদের অজানা নয়।

এই বিস্ময়কর রাসায়নিক পদার্থগুলো অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি বা এন্ডোক্রাইন গ্ল্যান্ড নামের বিশেষ অঙ্গ থেকে রক্তে এসে আমাদের শরীরের প্রায় সব কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের বৃদ্ধি ও বিকাশ থেকে শুরু করে মানসিক অবস্থা কিংবা ঘুমের পরিমাণ থেকে শুরু করে হৃৎস্পন্দনের হার—সবই হরমোনের নিয়ন্ত্রণে। এমনকি অনেক হরমোন নিয়ন্ত্রণ করারও হরমোন রয়েছে।

তবু বিংশ শতাব্দীর আগপর্যন্ত হরমোনের কাজ তো দূরের কথা, তাদের অস্তিত্ব নিয়েই কোনো ধারণা ছিল না অধিকাংশ বিজ্ঞানীর। কঙ্কাল, মাংসপেশি কিংবা অন্যান্য বড় অঙ্গ দিয়ে তৈরি দেহের যে তন্ত্রগুলো আমরা সহজে দেখতে পারি, তাদের সম্পর্কে আমরা প্রাচীনকাল থেকেই জানি। অথচ হরমোন ক্ষরণ করা গ্রন্থি আবিষ্কার শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীতে আর সেই গ্রন্থিদের কাজ কী, একটা লম্বা সময় পর্যন্ত তা ছিল সম্পূর্ণ অজানা।

হরমোন নিয়ে কোনো জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে হরমোন নিয়ে কাজ করে আসছে। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ সালে চীনে চিকিৎসার প্রয়োজনে মূত্র থেকে হরমোন আলাদা করার প্রমাণ পাওয়া যায়। ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইতালিতে বয়ঃসন্ধিকালের আগেই ‘ক্যাস্ট্রাটোস’ নামে পরিচিত অপেরা গায়কদের অণ্ডকোষ ফেলে দেওয়া হতো। এর ফলে তাঁরা তীক্ষ্ণ স্বরে গান গাইতে পারতেন। আর হাজার হাজার বছর ধরেই গবাদিপশুর হিংস্রভাব কমাতে অণ্ডকোষ ফেলে দেওয়ার প্রচলন আছে।

১৮৯৫ সালে জর্জ অলিভার ও এডওয়ার্ড এলবার্ট শেফার দেখান, অ্যাড্রেনাল ও পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে সংগ্রহ করা রস প্রাণীর শরীরে ইনজেক্ট করলে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। কোনো গ্রন্থির ক্ষরণ যে শরীরে দূরে কোথাও প্রভাব ফেলতে পারে, তার আরও একটি প্রমাণ এটি।

অদ্ভুত বিজ্ঞান

হরমোন আবিষ্কার বা হরমোন কীভাবে কাজ করে, তা বুঝতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে রানি ভিক্টোরিয়ার আমলের কিছু স্থূল ও বিতর্কিত গবেষণা। এ গবেষণাগুলোর একটা বড় অংশ ছিল অণ্ডকোষ নিয়ে বিচিত্র কাজকারবার।

১০০ বছরের মতো একটা সময়ের মধ্যে হরমোন-সংক্রান্ত গবেষণা বা ‘এন্ডোক্রাইনোলজি’ বিজ্ঞান ও চিকিৎসাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। এন্ডোক্রাইন সিস্টেমের বিভিন্ন সমস্যা সহজেই নির্ণয় ও নিরাময় সম্ভব হয়েছে।

১৮৪৯ সালে জার্মান বিজ্ঞানী আর্নল্ড বার্থল্ড লক্ষ করলেন, বয়স কম থাকা অবস্থায়ই যদি মোরগের অণ্ডকোষ ফেলে দেওয়া হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে সেই মোরগে পুরুষালি বা মোরগসুলভ বৈশিষ্ট্য, যেমন মাথার লাল ঝুঁটি দেখা যায় না।

বার্থল্ড শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন অণ্ডকোষকে কিছু মোরগের শরীরে প্রতিস্থাপন করেন। শিগগিরই মোরগগুলো মাথার ঝুঁটি, হিংস্র আচরণসহ স্বাভাবিক মোরগের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করা শুরু করে। প্রতিস্থাপিত অণ্ডকোষগুলোতে রক্তপ্রবাহের জন্য ধমনিও তৈরি হয়। হরমোন-সংক্রান্ত প্রথম গবেষণা বলা হয় এটিকে। এই গবেষণা থেকে বোঝা যায়, পুরুষালি বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য যে রাসায়নিক পদার্থ দায়ী, তা অণ্ডকোষে তৈরি হয়ে রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়।

বার্থল্ডের গবেষণার ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও তাঁর এই আবিষ্কার অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে যায়। প্রায় অর্ধশতাব্দী পরে বিজ্ঞানীরা তাঁর কাজ আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সচেষ্ট হন। অন্য বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, এই ‘অভ্যন্তরীণ ক্ষরণ’ বিভিন্ন অঙ্গের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলছে। কিন্তু রক্তপ্রবাহে থাকা কোনো রাসায়নিক পদার্থ কীভাবে সারা দেহে এত বিস্তৃত প্রভাব ফেলতে পারে, তখনকার বিজ্ঞানী মহলের কাছে এর কোনো ব্যাখ্যা ছিল না।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এই রহস্যময় গ্রন্থি ও তাদের কাজ নিয়ে গবেষণা একটু ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। চার্লস-এডওয়ার্ড ব্রাউন-সেকার্ড নামের একজন স্বনামধন্য শারীরতত্ত্ববিদ কিছু অভূতপূর্ব গবেষণা শুরু করেন, যার একটা বড় অংশ ছিল বিভিন্ন প্রাণীর অণ্ডকোষ থেকে রস বের করে, তা নিজের শরীরে ইনজেক্ট করা। ১৮৮৯ সালে, ৭২ বছর বয়সে এসে তিনি দাবি করে বসলেন, কুকুর আর গিনিপিগের ‘অণ্ডকোষের রস’ নিজের শরীরে ইনজেক্ট করে তিনি নিজের বার্ধক্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন।

যে প্রভাবের কথা ব্রাউন-সেকার্ড দাবি করেছিলেন, সেটা প্রায় নিশ্চিতভাবে তাঁর মনের ভুল। তাঁর ইনজেকশনে খুব কম পরিমাণেই টেস্টোস্টেরন থাকা সম্ভব ছিল, যেটা খুব দ্রুতই তাঁর শরীরে গিয়ে ভেঙে যাওয়ার কথা। কিন্তু ব্রাউন-সেকার্ড দাবি করতে থাকলেন, প্রায় যেকোনো অসুখই অণ্ডকোষের রস দিয়ে নিরাময় করা সম্ভব। তাঁর কথায় টেস্টোস্টেরন ইনজেকশন ব্যবহারের হিড়িক পড়ে যায়। ১৮৯৯-এর শেষ দিকে হাজার হাজার চিকিৎসক এই ইনজেকশন দেওয়া শুরু করেন। ওষুধের দোকানে ‘অলৌকিক নিরাময়’ হিসেবে বিভিন্ন প্রাণীর দেহ থেকে সংগ্রহ করা রস বিক্রি শুরু হয়।

সৌভাগ্যক্রমে বিভিন্ন গ্রন্থির ক্ষরণ নিয়ে আরও অনেক গবেষণা চলে আর খুব তাড়াতাড়িই এন্ডোক্রাইনোলজি সঠিক পথে ফিরে আসে। ১৮৯১ সালে জর্জ রেডমেইন মারে মিক্সিডিমা রোগটির নিরাময় আবিষ্কার করেন। এখন আমরা জানি, রোগটি হয় থাইরয়েড গ্রন্থি দীর্ঘ সময় ঠিকঠাক কাজ না করার কারণে। এই রোগে রোগীর হাত ও চোখ অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যায়।

মারের নিরাময় ছিল ভেড়ার থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে রস বের করে সেটা রোগীর শরীরে ইনজেক্ট করা। ব্রাউন-সেকার্ডের মতোই তিনি থাইরয়েড গ্রন্থি টুকরা টুকরা করে চেপে রস বের করে, তা মসলিন কাপড় দিয়ে ছেঁকে নিয়ে পাওয়া তরলটি রোগীর শরীরে ইনজেক্ট করেন। মারের ব্যবহার করা এই তরলে প্রচুর পরিমাণে থাইরয়েড হরমোন ছিল।

থাইরয়েড হরমোন বা গ্রন্থির কাজ, দেহের বিপাক ও বৃদ্ধিতে এর প্রভাব বুঝে উঠতে তখনো বহু দিন বাকি। কিন্তু নিরাময়ের কাজ করেছে, তাই এটিই প্রথাগত চিকিৎসাবিদ্যায় এন্ডোক্রাইনোলজির প্রথম ফলপ্রসূ ব্যবহার।

১৮৯৫ সালে জর্জ অলিভার ও এডওয়ার্ড এলবার্ট শেফার দেখান, অ্যাড্রেনাল ও পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে সংগ্রহ করা রস প্রাণীর শরীরে ইনজেক্ট করলে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। কোনো গ্রন্থির ক্ষরণ যে শরীরে দূরে কোথাও প্রভাব ফেলতে পারে, তার আরও একটি প্রমাণ এটি।

১৯২১ সালে ফ্রেডরিক ব্যানটিং আর চার্লস বেস্ট ইনসুলিন আবিষ্কার করেন। এই হরমোন শরীরের কোষগুলোকে রক্তপ্রবাহ থেকে শর্করা শোষণ করায়। এই বিজ্ঞানী জুটির গবেষণার ফলে আবিষ্কৃত নিরাময় লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে।

অন্ধকার পথ

দেহের অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার অস্তিত্বে প্রচুর প্রমাণ জমা হলেও ব্রিটিশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন এ ধারণাকে গ্রহণ করতে রাজি ছিল না। প্রাচীনকাল থেকে ধারণা ছিল যে স্নায়ুতন্ত্র দেহের সব কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। তাই অনেকের কাছেই এর পরিবর্তে অন্য কোনো কিছু মেনে নেওয়া সহজ ছিল না।

এই অসম্পূর্ণ জ্ঞান এন্ডোক্রাইনোলজিকে অন্ধকার পথে ঠেলে দেয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে অস্ট্রিয়ান শারীরতত্ত্ববিদ ইউজিন স্টাইনাক বলেন, অণ্ডকোষ বেঁধে রাখলে বার্ধক্য দেরিতে আসবে। তাঁর কথায়, কবি ইয়েটসসহ হাজারো পুরুষ এই ‘চিকিৎসা’ গ্রহণ করেন।

দুঃখজনকভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুতে অনেক ক্ষেত্রে জোর করেই লাখ লাখ নারীর গর্ভাশয় ফেলে দেওয়া হয়। এ সময় ভুল ধারণা ছিল, গর্ভাশয় ফেলে দিলে পরবর্তী সময়ে হিস্টিরিয়া কিংবা উন্মাদ হওয়া প্রতিরোধ করা যাবে।

এই বর্বর ও আদিম ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে প্রয়োজন ছিল গ্রন্থি টুকরা টুকরা করে রস বের করে দেখার চেয়ে ভালো কোনো পদ্ধতির। ১৯০২ সালে শারীরতত্ত্ববিদ আর্নেস্ট স্টার্লিং আর উইলিয়াম বেইলিস এক যুগান্তকারী গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে রক্তে থাকা রাসায়নিক পদার্থ স্নায়ুতন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই কোনো অঙ্গের কার্যকলাপে পরিবর্তন আনতে পারে।

তাঁর এই কাজের জন্য স্টার্লিং ১৯০৫ সালে রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ানসে লেকচার দিতে আমন্ত্রিত হন। এখানে তাঁর গবেষণার মূল বিষয়বস্তু যে রাসায়নিক পদার্থ, তার একটি নাম দেন তিনি। হরমোন, প্রাচীন গ্রিক এই শব্দের অর্থ ‘আমি উত্তেজিত করি’। শব্দটি আমরা এখনো ব্যবহার করি।

এরপর এন্ডোক্রাইনোলজির অগ্রগতি আরও বেগবান হয়। ১৯২১ সালে ফ্রেডরিক ব্যানটিং আর চার্লস বেস্ট ইনসুলিন আবিষ্কার করেন। এই হরমোন শরীরের কোষগুলোকে রক্তপ্রবাহ থেকে শর্করা শোষণ করায়। এই বিজ্ঞানী জুটির গবেষণার ফলে আবিষ্কৃত নিরাময় লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে।

ব্যানটিং আর বেস্টের আবিষ্কারের আগে ডায়াবেটিসের রোগীরা অল্প বয়সেই খুব ধীর ও যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর সম্মুখীন হতেন। টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী যথেষ্ট ইনসুলিন তৈরি করতে পারেন না, তাই তাঁদের খাবার থেকে পাওয়া শর্করা রক্তে রয়ে যায়। তাদের দেহের টিস্যু তা শোষণ করে শক্তি উৎপন্ন করতে পারে না।

ব্যানটিং আর বেস্ট প্রথমে একটি কুকুরের অগ্ন্যাশয় শরীর থেকে বের করে আনেন। এতে কুকুরটিতে ডায়াবেটিসের লক্ষণ দেখা যায়, যা থেকে বোঝা যায় এই রোগে অগ্ন্যাশয়ের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।

অগ্ন্যাশয়ের অধিকাংশ কোষই খাবার পরিপাকে কাজ করে। কিন্তু তাঁরা ভাবলেন, এই অঙ্গের আরও একটি কাজ রয়েছে। তাঁরা আরেকটি কুকুরের অগ্ন্যাশয়ের নালি সুতা দিয়ে বেঁধে দিলেন। এতে পাচক রস তৈরিকারী কোষগুলো মারা যায়। তাতে লাভটা হলো, যে কোষগুলো বেঁচে থাকে, তারা পরিপাকের কাজ করে না। এই কোষগুলোর ওপরই তাঁরা গবেষণা করেন। এগুলোকে আমরা এখন বলি প্যানক্রিয়াটিক আইলেট।

শুধু এই কোষগুলোর ক্ষরণ আলাদা করে সেটা তাঁরা ওই ডায়াবেটিক কুকুরগুলোতে ইনজেক্ট করলেন। তাতে কুকুরগুলোর রক্তে শর্করার পরিমাণ খুব দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে এল।

ওষুধ আবিষ্কার

এক বছর পর, তাদের মিশ্রণ বিশুদ্ধ করার উপায় বের করে তাঁরা প্রথম কোনো মানুষকে তা ইনজেক্ট করলেন। শিগগিরই তাঁরা ওয়ার্ড ভরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত শিশুদের ইনজেকশন দেওয়া শুরু করলেন। শিশুরা যখন তাদের মুমূর্ষু অবস্থা থেকে সুস্থ হয়ে উঠত, তাদের পরিবারের আনন্দ ছিল দেখার মতো। ব্যানটিং আর বেস্টের আবিষ্কারের দুই বছরের মধ্যেই এলি লিলি নামের একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি বিভিন্ন প্রাণী থেকে ইনসুলিন তৈরি করা শুরু করে। তাদের তৈরি করা ইনসুলিনের পরিমাণ উত্তর আমেরিকার ডায়াবেটিসের রোগীদের জন্য যথেষ্ট ছিল। ষাটের দশকের মধ্যেই কোনো প্রাণীর প্রয়োজন ছাড়া কৃত্রিমভাবে হরমোনটি তৈরি করা হচ্ছিল।

বিংশ শতাব্দীর বাকি অংশে আধুনিক এন্ডোক্রাইনোলজির আরও অনেক যুগান্তকারী ব্যাপার আবিষ্কৃত হয়। এদের অধিকাংশের জন্য ধন্যবাদ দিতে হয় রক্তপ্রবাহে থাকা হরমোন মাপার সূক্ষ্ম পদ্ধতিকে। ‘রেডিওইমিউনোঅ্যাসে’ নামের একটি পদ্ধতি ছাড়া এ ধরনের সূক্ষ্ম পরিমাপ সম্ভব হতো না। এটি আবিষ্কার করেন রোজালিন ইয়ালো নামের এক মার্কিন বিজ্ঞানী।

ইয়ালো এবং আরও দুজন এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট রজার গিম্যা ও অ্যান্ড্রু শ্যালি ১৯৭৭ সালে নোবেল পুরস্কার পান। ইয়ালোর আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে যে অণুর ওপর কাজ করতে চায়, সে অণুর সঙ্গে যুক্ত হবে এমন অ্যান্টিবডি তৈরি করতে হয়। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে গিম্যা ও শ্যালি রক্তে পিটুইটারি হরমোনের সূক্ষ্ম পরিমাণ নির্ণয় করতে সক্ষম হন।

তাঁদের এই কাজ অন্যান্য গ্রন্থির নিয়ন্ত্রক হিসেবে পিটুইটারি গ্রন্থির ভূমিকা বোঝতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মাস্টার গ্ল্যান্ড বলে পরিচিত পিটুইটারি গ্রন্থি মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামস অংশের সঙ্গে এন্ডোক্রাইন সিস্টেমের বাকি অংশকে যুক্ত করে। এটা বাইরের পৃথিবী আর আমাদের ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে দেহের রাসায়নিক প্রতিক্রিয়াতন্ত্রের সংযোগ সাধন করে।

এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট ও লেখক ড. স্যাফরন হোয়াইটহেডের মতে, ইয়ালোর রেডিওইমিউনোঅ্যাসে আর হাই রেজল্যুশন ইমেজিংয়ের উদ্ভাবন গত ৫০ বছরে এন্ডোক্রাইনোলজির প্রায় সব অগ্রগতির পথ সুগম করেছে।

তাঁর মতে, ইমিউনোঅ্যাসে করতে পারা এন্ডোক্রাইন গবেষণা ও রোগনির্ণয়ে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। প্রথমবারের মতো প্রবহমান হরমোনের পরিমাণ সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে।

আজ হরমোন সম্পর্কে অনেক কিছুই আমরা জানতে পেরেছি। বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত মানবদেহে প্রায় ৮০টি হরমোনের খোঁজ পেয়েছেন। এখন আমরা জানি, এন্ডোক্রাইন গ্রন্থি ছাড়াও অন্যান্য টিস্যুও হরমোন তৈরি করতে পারে। বর্তমানে হরমোনের সঙ্গে স্থূলতা, হৃদ্‌রোগ, বিষণ্নতা, বার্ধক্যের মতো সমস্যাগুলোর সম্পর্ক বের করার কাজ চলছে।

আমাদের জিনের সঙ্গে হরমোনের সম্পর্ক বুঝে ওঠার কাজ এন্ডোক্রাইনোলজিস্টদের আরও বহু বছর ব্যস্ত রাখবে।

হোয়াইটহেড বিশ্বাস করেন, এখনো বহু হরমোন আবিষ্কার করা বাকি। তিনি মনে করেন, রক্তপ্রবাহে ক্ষরিত হওয়ার পাশাপাশি কিছু হরমোন পাশাপাশি অবস্থিত কোষগুলোর মধ্যেও কাজ করে।

আধুনিক ল্যাব টেকনিক কিংবা কম্পিউটার মডেলিং ব্যবহার করে আমাদের দেহের আশ্চর্য ও জটিল জীব রাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলো বুঝতে চেষ্টা করে আজকের এন্ডোক্রাইনোলজি। কিন্তু এই আধুনিক বিজ্ঞান ঋণী ভিক্টোরিয়ান যুগের চিকিৎসকদের প্রতি, যাঁরা প্রথম বিচিত্র সেই গবেষণাগুলো করেছিলেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, ঢাকা

সূত্র: বিবিসি ফোকাস