পৃথিবীর যেসব প্রাণীদের মারা প্রায় অসম্ভব

বনের রাজা সিংহছবি: শাটারস্টোক

২০১৭ সাল। হেলিকপ্টার থেকে দেখা যাচ্ছে, এক বিশাল নোনাপানির কুমির আরেকটা মিঠাপানির কুমিরকে মুখে নিয়ে এমনভাবে সাঁতরে যাচ্ছে, যেন ওটা একটা গাজর! মিঠাপানির কুমিরও কিন্তু কম ভয়ঙ্কর শিকারি নয়। কিন্তু নোনাপানির কুমিরের শক্তির কাছে সে কিছুই না।

পৃথিবীতে এমন কিছু প্রাণী আছে, যাদের কোনো প্রাকৃতিক শত্রু নেই। মনের সুখে সেগুলো যেদিকে ইচ্ছে ঘুরে বেড়ায়। এদেরকে বলে এপেক্স প্রিডেটর বা শীর্ষ শিকারি। নোনাপানির কুমিরটি হলো সেই খাদ্য শৃঙ্খলের একেবারে চূড়ায় বসে থাকা এক রাজা।

কিন্তু এই দলে আর কারা আছে? সে প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে খাদ্যশৃঙ্খলের ব্যাপারটা একটু বুঝে নিই। স্কুলের বিজ্ঞান বইয়ের কথা মনে আছে? খাদ্যশৃঙ্খলের সবার নিচে থাকত উৎপাদক বা গাছপালা, যারা নিজেদের খাবার নিজেরাই বানায়। তাদের খেত হরিণ বা অন্য তৃণভোজীরা। হরিণকে খেত আবার বাঘ। এই বাঘই হলো সেই শীর্ষ শিকারি। এই দলের সদস্য সংখ্যা খুব কম। কিন্তু দলে যারা আছে, সবাই প্রচণ্ড শক্তিশালী।

তবে এই দলের সদস্য হওয়া মানেই কিন্তু অমরত্ব পাওয়া নয়। ওপরের শিরোনাম দেখে ভুল বুঝবেন না। সব প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। তাই শিরোনামে ‘প্রায়’ শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে। একটা সিংহ যখন বাচ্চা থাকে, তখন সে খুবই দুর্বল এবং অন্য প্রাণীর সহজ শিকারে পরিণত হয়। কিন্তু সেই বাচ্চাই যখন বড় হয়ে ৩৭৫ কেজির বিশালদেহী প্রাণীতে পরিণত, তখন তাকে হারানো প্রায় অসম্ভব পড়ে।

তবে এখানেও একটা কিন্তু আছে। সেই কিন্তুটা হলো মানুষ। কারণ এসব প্রাণী যতই শক্তিশালী হোক না কেন, মানুষ নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করে ওদের ঠিকই শিকার করে। জঙ্গল কেটে ফেলার কারণেও প্রকৃতির এই রাজাদের অনেকেই আজ বিপন্ন। তবে কিছু সময়ের জন্য আমরা এই চোরাশিকারীদের কথা ভুলে যাই। মানুষ যদি কোনো প্রাণীকে না মারত, তাহল কারা হতো বনের রাজা?

নোনাপানির কুমির

শুরু করি সেই কুমির দিয়েই। নোনাপানির কুমির হলো বর্তমানে পৃথিবীর বুকে হেঁটে বেড়ানো সবচেয়ে বড় সরীসৃপ। ২০১১ সালে ফিলিপাইনে লোলং নামে যে কুমিরটি ধরা পড়েছিল, সেটি ছিল লম্বায় ২০ ফুটেরও বেশি! একজন সাধারণ মানুষের প্রায় ৩-৪ গুণ লম্বা। এই রেকর্ডধারী কুমিরটাই বলে দিচ্ছে, কেন এদের হারানো এত কঠিন।

ভয়ঙ্কর নোনাপানির কুমির
ছবি: শাটারস্টোক

কিন্তু এরা কি সত্যিই অজেয়? ঠিক তা নয়। এই সেদিনের কথা। ২০২৪ সালে পর্যটকদের এক বোটের সামনেই ডমিনেটর নামে পরিচিত এক কুমির আরেকটা ৯ ফুট লম্বা কুমিরকে আক্রমণ করে মেরে ফেলল! পর্যটকরা দেখলেন, ডমিনেটর পানির নিচ থেকে ভেসে উঠল আর তার মুখে সেই অন্য কুমিরটার পা! কী ভয়ঙ্কর!

সিংহ

এবার আসি জঙ্গলের রাজার কথায়। সিংহ শুধু মারামারি করেই রাজা হয়নি। সে হলো কিস্টোন স্পিসিস। মানে পুরো ইকোসিস্টেম বা পরিবেশের ভারসাম্য তার ওপর নির্ভর করে। কীভাবে? সে একদিকে যেমন শেয়াল বা হায়েনার মতো ছোট শিকারিদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে, তেমনি হরিণ বা জেব্রার মতো তৃণভোজী প্রাণীও বেশি বাড়তে দেয় না। বুঝতেই পারছেন, বনে হরিণ বেশি হয়ে গেলে সব ঘাস শেষ হয়ে যাবে! তাছাড়া সিংহ কখনোই শিকারকে পুরোপুরি খেয়ে শেষ করে না। সিংহের ফেলে যাওয়া খাবার খায় শকুনের মতো ছোটখাটো শিকারিরা। এই উচ্ছিষ্ট খাবার মাটিকেও উর্বর করে তোলে।

বনের রাজা সিংহ
ছবি: শাটারস্টোক

বাঘ

বড় বিড়ালদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলো বাঘ। বাঘেরও কোনো প্রাকৃতিক শিকারি নেই (অবশ্যই বাচ্চা অবস্থায় বাদে)। হয়তো ভাবতে পারেন, সিংহ আর বাঘের মধ্যে লড়াই হলে কে জিতবে? দুর্ভাগ্যবশত, এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই! কারণ, প্রকৃতিতে এই দুই রাজার এলাকা কখনোই এক জায়গায় পড়ে না। তাই ওদের মুখোমুখি হওয়ারও সুযোগও নেই। তবে বাঘেরা মোটেই ভালো নেই। ১৯০০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত বাঘের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৯৬ শতাংশ! জঙ্গল কমে যাওয়ায় তারা নিজেদের মধ্যেই প্রজনন করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে তাদের জিনেও দেখা দিচ্ছে সমস্যা। ভারতের সিমলিপাল টাইগার রিজার্ভে এমন বাঘও দেখা গেছে, যাদের গায়ের রং কমলার বদলে কালো, শুধু ডোরাগুলো কমলা! আবার গোল্ডেন টাইগার নামে বিরল বাঘও দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের সুন্দরবনেও বাঘের সংখ্যা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে।

রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাংলার বাঘ
ছবি: সংগৃহীত

বল্ড ঈগল

আকাশের রাজাদের কথায় আসলে বলতে হয় বল্ড ঈগলের কথা। মানুষ ছাড়া এদেরও কোনো শিকারি নেই। সে মাছ, পাখি, সরীসৃপসহ সামনে যা পায়, তাই শিকার করে। এমনকি মরা প্রাণীও খায়। একসময় খামারিরা ঈগল পছন্দ করত না, কিন্তু এখন তারা খুশি। কারণ, ঈগল খামারের ইঁদুরের মতো ক্ষতিকর প্রাণী খায়। তবে এত ক্ষমতা থাকার পরও একটা ঈগলের মৃত্যুর খবর বেশ লজ্জাজনক। একটা ঈগল মারা গিয়েছিল একটা সাধারণ ছোট্ট ‘লুন’ পাখির ঠোঁটের আঘাতে! সে গল্পটা অন্যদিনের জন্য তোলা থাক!

মাছ, পাখি, সরীসৃপসহ যা সামনে পায়, তাই শিকার করে ঈগল
ছবি: শাটারস্টোক

মেরু ভালুক

স্থলের সবচেয়ে বড় শিকারি হলো মেরু ভালুক। এরা শুধু শক্তিশালীই নয়, অবিশ্বাস্য ধৈর্যশীল। এদের প্রিয় খাবার সিল মাছ। সিলেরা বরফের নিচের পানিতে সাঁতরায়, কিন্তু নিঃশ্বাস নিতে বরফের গর্তে আসতেই হয়। আর মেরু ভালুকেরা সেই গর্তের পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মূর্তির মতো অপেক্ষা করে! এরা অনেক বুদ্ধিমান। সে প্রমাণ আছে। ১৭০০ সাল থেকেই রিপোর্ট আছে, মেরু ভালুকেরা ওয়ালরাস শিকার করার জন্য পাথর বা বরফের চাঁইকে হাতুড়ির মতো ব্যবহার করে তাদের মাথায় আঘাত করে! তবে এদের কপালও পুড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে বরফ গলে যাওয়ায় ২১০০ সাল নাগাদ এরাও হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে!

মাছের অপেক্ষায় ঘাপটি মেরে থাকে মেরু ভালুক
ছবি: শাটারস্টোক

অর্কা

ভয়ংকর হাঙরের কথা উঠলেই আমাদের চোখের সামনে সাধারণত গ্রেট হোয়াইট শার্কের ছবি ভেসে ওঠে। কিন্তু এই তালিকায় ওটা নেই। কারণ তালিকায় আছে অর্কা বা কিলার হোয়েল!

অর্কারা হলো সমুদ্রের আসল ত্রাস। এরা সাদা হাঙর শিকার করে এবং তার কলিজাটা বের করে খেয়ে ফেলে! এমনকি ওরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হাঙর হোয়েল শার্ককে আক্রমণ করে একই কাজ করেছে। অর্কাদের বলা হয় ‘সমুদ্রের ভেলোসির‍্যাপ্টর’। এরা দল বেঁধে শিকার করে; বরফের চাঁইয়ে বসে থাকা সিলকে ঢেউ দিয়ে পানিতে ফেলে দেয়! এরা এতই অদ্ভুত যে, মাঝেমধ্যে মরা স্যামন মাছকে টুপির মতো মাথায় পরেও ঘুরে বেড়ায়! সম্প্রতি এরা মানুষের বড় বড় বোটকেও আক্রমণ করা শুরু করেছে। বোঝাই যাচ্ছে, এই শীর্ষ শিকারির সঙ্গে পানিতে কেউ লাগতে চাইবে না।

তিমি শিকারী অর্কা
ছবি: গেটি ইমেজ

এই হলো পৃথিবীর শীর্ষ শিকারিদের একটি ছোট তালিকা। তালিকাটি সত্যিই ভয়ঙ্কর! তবে এই রাজাদের রাজত্ব আজও ঠিকে আছে গাছপালা আর সালোকসংশ্লেষণের জন্য। গাছপালা না থাকলে এই রাজাদের কারোরই অস্তিত্ব থাকত না!

সূত্র: আইএফএল সায়েন্স