মানুষের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হচ্ছে, সে ভাবতে পারে। ভেবে ভেবে কোনো একটা কাজের পেছনে যুক্তি দাঁড় করাতে পারে। আইনস্টাইনের মতো মহান বিজ্ঞানী শুধু মানস পরীক্ষার মাধ্যমে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আবিষ্কার করে ফেলেছেন। আর গত ২০০ বছরের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও সূত্র ব্যবহার করে, গণিতের সাহায্যে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারছি ১৩.৮ বিলিয়ন বছর বয়সী এই মহাবিশ্বের জটিল সব প্রাকৃতিক নিয়মকানুন।
এটার একটা নাম আছে, ‘আনরিজনেবল ইফেক্টিভনেস অব ম্যাথমেটিকস’। বাংলা করলে দাঁড়াবে, ‘গণিতের অবিশ্বাস্য ও অযৌক্তিক রকম কার্যকারিতা’। নামটা দিয়েছিলেন ইউজিন উইগনার, ১৯৬০–এর দশকে।
বিজ্ঞানীরা গণিতকে বলেন মহাবিশ্বের ভাষা বা প্রকৃতির ভাষা। মহাবিশ্বের বিশেষত্বহীন ছোট্ট এক গ্রহের একটি প্রাণী প্রকৃতির ভাষা আবিষ্কার করে ফেলেছে, অল্প কিছু সংখ্যা ও চিহ্ন নাড়াচাড়া করে সঠিকভাবে বলে দিতে পারছে বিলিয়ন বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের দুটি কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষের ফলাফল কী হবে—ব্যাপারটা কী পরিমাণ অবিশ্বাস্য ও অযৌক্তিক, কখনো ভেবে দেখেছেন?
যতই অবিশ্বাস্য হোক, এটাই বাস্তবতা। আর সে জন্যই বিজ্ঞানীরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন নিয়ে উঠে-পড়ে লেগেছেন। ‘প্রকৃতির নিয়মকানুন নিয়ে আমাদের এই যে ভাবনাচিন্তা, চেতনা—এটা আমরা করতে পারছি কেন? এর পেছনে কী দায়ী?’—গণিত দিয়ে কি এই প্রশ্নটার জবাব বের করা যাবে?
সমস্যাটাকে আরেকটু গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করা যাক। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী ‘পদার্থ’ দিয়ে তৈরি, এটা আমরা সবাই জানি। কথা হচ্ছে, জড় পদার্থ মিলে তৈরি একটি প্রাণীর মধ্যে ‘চেতনা’ জিনিসটা আসছে কীভাবে? ঠিক কী এই ‘চেতনা’? একই রকম একটি ব্যাপারে রিচার্ড ফাইনম্যান তাঁর সিক্স ইজি পিসেস বইয়ে লিখেছেন—
‘কোনো প্রাণী যখন কিছু একটা শেখে, আগের চেয়ে ভিন্ন কিছু একটা সে করতে পারে। তার মানে, প্রাণীটির মস্তিষ্কের কোষ যদি পরমাণু দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে এর মধ্যে কিছু না কিছু পরিবর্তন নিশ্চয়ই হয়েছে। কথা হচ্ছে, সেই পরিবর্তনটা আসলে কী রকম? কোনো প্রাণী যখন তার মস্তিষ্কে কিছু একটা টুকে রাখছে, শিখছে; আমরা বুঝতে পারছি না এর মানেটা আসলে কী বা স্নায়ুতন্ত্রের মধ্যে ঠিক কী পরিবর্তন হচ্ছে। এর উত্তরটা আমাদেরকে ঠিক কোথায় খুঁজতে হবে বা এখানে আমাদেরকে ঠিক কিসের খোঁজ করতে হবে—এ ব্যাপারে আমাদের বিন্দুমাত্র ধারণাও নেই।’
কয়েক হাজার বছর ধরেই দার্শনিকেরা ‘চেতনার প্রকৃতি’কে (Nature of consciousness) বোঝার চেষ্টা করছেন। অর্ধশতাব্দী আগে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন জীববিজ্ঞানীরা। মস্তিষ্কের কোষগুলো তাদের বিভিন্ন কাজকর্মের জন্য একে অন্যের ওপরে কীভাবে নির্ভরশীল—এটা তাঁরা আবিষ্কার করেছেন। অভিজ্ঞতা বা এক্সপেরিয়েন্সের প্রতিটি আলাদা অংশের নাম দিয়েছেন কোয়ালিয়া (qualia)। কিন্তু ফাইনম্যান যেমন বলেছেন, এত কিছুর পরও নিউরোসায়েন্স বা স্নায়ুবিজ্ঞান আমাদেরকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির ব্যাপারে কিছুই বলতে পারেনি। নিউরন থেকে আনন্দ, রাগ কিংবা ক্ষোভ কীভাবে জন্ম নেয়—এ ব্যাপারে আজও আমাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই।
এটিই মনোবিজ্ঞান বা স্নায়ুবিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় সমস্যা। বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ডেভিড কামারস এর নাম দিয়েছেন ‘হার্ড প্রবলেম অব কনসাশনেস’। আর প্রিয় পাঠক, নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গেছেন, জীববিজ্ঞান আমাদের এই প্রশ্নের সমাধানের পথে এগিয়ে নিতে পারছে না। সে জন্যই আমাদের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে গণিতের।
যেসব সমস্যাকে মানুষের ভাষায় (মানে বাংলা, ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষায়) ব্যাখ্যা করা যায় না, দেখা গেছে, গণিত দিয়ে সে রকম অনেক কিছু সহজেই প্রকাশ করা যায়। বিজ্ঞানীরা তাই এখন চেতনার গাণিতিক মডেল দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। জার্মানির মিউনিখ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল ফিলোসফিতে কর্মরত জোহাননেস ক্লেইনারের মতে, ‘এর মাধ্যমে আমরা হয়তো অভিজ্ঞতার পরিমাপ করতে পারব। যেমন কফির গন্ধ—এ রকম কিছুকে ইংরেজি ব্যবহার করে কিন্তু পরিমাপ করা সম্ভব নয়। গাণিতিক মডেল দিয়ে সেটা হয়তো করা যাবে।’
সে জন্যই ক্লেইনার এবং ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের শন টাল মিলে থিওরি অব কনশাসনেসের পেছনের প্রথম এবং সম্ভবত একমাত্র গাণিতিক কাঠামো তৈরি করার চেষ্টা করছেন।
এর ধারণা দিয়েছিলেন স্নায়ুবিজ্ঞানী গুইলিও টনোনি, প্রায় এক যুগ আগে। নাম, ইন্টিগ্রেটেড ইনফরমেশন থিওরি (Integrated Information Theory), সংক্ষেপে আইআইটি। তাঁর আইডিয়াটি ছিল, একটা সিস্টেমের মধ্যে যে সাবসিস্টেমগুলো থাকে, তাদের মধ্যে তথ্যের আদান-প্রদানের ফলে তৈরি হয় কনশাসনেস বা চেতনা। ক্লেইনার ও টালি এই ধারণার ওপর ভিত্তি করেই তাঁদের গাণিতিক মডেলটি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন।
বোঝার সুবিধার্থে এই সাবসিস্টেমগুলোকে দ্বীপের সঙ্গে তুলনা করা যায়। এদের প্রতিটির আলাদা নিউরন (ধরে নিন, জনসংখ্যা) আছে। দ্বীপগুলো তথ্যের প্রবাহের মাধ্যমে যুক্ত। টনোনির মতে, চেতনা তৈরি হওয়ার জন্য তথ্যের এই প্রবাহ যথেষ্ট জটিল ধরনের হতে হবে, ফলে দ্বীপগুলো হবে একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। তার মানে, একটি দ্বীপ থেকে হওয়া তথ্যের প্রবাহে কোনো পরিবর্তন এলে তা অন্যান্য দ্বীপের তথ্যপ্রবাহের অবস্থা (state) এবং ফলাফলের (output) ওপর প্রভাব ফেলবে। তাত্ত্বিকভাবে এর ফলে চেতনার মাত্রাকে সংখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব হবে। একটি দ্বীপের তথ্যপ্রবাহের ফলাফল অন্য দ্বীপগুলোর তথ্যপ্রবাহের ওপর কতটা নির্ভরশীল, তা এই মাত্রা দিয়ে মাপা যাবে। এ থেকে বোঝা যাবে, একটা সিস্টেম তার সাবসিস্টেম থেকে পাওয়া তথ্যগুলোকে কতটা ভালোভাবে একীভূত করতে পারছে। এই যে সংখ্যাটি, যেটা দিয়ে একটা একটা সিস্টেম তার সাবসিস্টেম থেকে পাওয়া তথ্যগুলোকে কতটা ভালোভাবে একীভূত করতে পারছে, তা মাপা হচ্ছে—এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘ফাই’।
যদি দ্বীপগুলো একে অন্যের তথ্যপ্রবাহের ওপরে নির্ভরশীল না হয়, তাহলে ফাইয়ের মান হবে শূন্য। অর্থাৎ এখানে কোনো চেতনা তৈরি হচ্ছে না। কিন্তু একটি দ্বীপের তথ্যপ্রবাহের ফলাফল যদি অন্য দ্বীপগুলোর ওপরে নির্ভরশীল হয়ে থাকে, তার মানে কোনো একটি দ্বীপের তথ্যের প্রবাহ বন্ধ করে দিলে তা পুরো সিস্টেমের ওপরে কিছু না কিছু প্রভাব ফেলবে। সে ক্ষেত্রে ফাইয়ের মান হবে শূন্যের চেয়ে বড়। আর ফাইয়ের মান যত বড় হবে, সেই সিস্টেমের চেতনা হবে ততটা প্রখর।
আইআইটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য এর ‘বর্জন স্বীকার্য’ (exclusion postulate)। সহজ করে বললে, এই স্বীকার্য বলে, আলাদাভাবে সাবসিস্টেমগুলোর প্রতিটির চেতনার মাত্রা থেকে পুরো গুচ্ছ-সিস্টেমটির চেতনার মাত্রা, মানে ফাইয়ের মান বড় হতে হবে। আর যে গুচ্ছ-সিস্টেমটির ফাইয়ের মান সবচেয়ে বড় হবে, সেটাই সে মুহূর্তে চেতনার ‘অভিজ্ঞতা’ হিসেবে কাজ করবে।
উদাহরণ হিসেবে মানুষের মস্তিষ্কের কথা ভাবা যাক। ধরে নিই, অনেকগুলো দ্বীপ নিয়ে একটি দ্বীপগুচ্ছ এবং অনেকগুলো দ্বীপগুচ্ছ নিয়ে পুরো মস্তিষ্ক-সিস্টেমটি তৈরি। তাহলে এখানে যে দ্বীপগুচ্ছটির ফাইয়ের মান সবচেয়ে বড় হবে, একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে মস্তিষ্ক সেই দ্বীপগুচ্ছের চেতনাকেই ‘অভিজ্ঞতা’ হিসেবে ধরে নেবে। এটার একটা ভালো বাস্তব উদাহরণ হতে পারে হেঁচকি। কারও হেঁচকি উঠলে তাকে যদি হঠাৎ ভয় দেখানো হয় বা চিমটি দেওয়া হয়, তাহলে হেঁচকি থেমে যায়। এখানে ভয় দেখানোর আগপর্যন্ত মস্তিষ্ক হেঁচকিকেই সেই মুহূর্তের ‘অভিজ্ঞতা’ হিসেবে ধরেছিল। যে মুহূর্তে ভয় দেখানো হলো, সেই মুহূর্তে মস্তিষ্কের যে অংশে ভয় তৈরি হয়েছে, সে অংশের নিউরনগুচ্ছের ফাইয়ের মান বড় হয়ে গেল। ফলে মস্তিষ্ক সেই মুহূর্ত অভিজ্ঞতা হিসেবে ‘ভয়’কে গ্রহণ করল, বন্ধ হয়ে গেল হেঁচকি।
আইআইটির ভালো-মন্দ দুই দিকই আছে। ভালো দিকগুলো নিয়ে প্রথমে বলি। মানুষের মস্তিষ্কে চেতনা তৈরি হওয়ার ব্যাপারটি সে অনেকটা ব্যাখ্যা করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে মস্তিষ্কের সেরেব্রাল কর্টেক্স (সামনের দিকের একটি অংশ) ও সেরেবেলামের (পেছনের দিকের একটি অংশ) কথা ভাবা যাক। সেরেব্রাল কর্টেক্সে নিউরনের সংখ্যা কম হলেও এরা ‘হাইলি ইন্টারকানেক্টেড’। অর্থাৎ এরা পরস্পরের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। সেই হিসেবে এই অংশের ফাইয়ের মান বড়। এদিকে সেরেবেলামে নিউরনের সংখ্যা বেশি হলেও এরা সেরেব্রাল কর্টেক্সের তুলনায় একে অন্যের সঙ্গে সেভাবে যুক্ত নয়। সে জন্য এর ফাইয়ের মান কম। তার মানে, আইআইটির হিসেবে, কারও সেরেবেলাম ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা চেতনার ওপর কম প্রভাব ফেলবে। কিন্তু সেরেব্রাল কর্টেক্স ক্ষতিগ্রস্ত হলে মানুষটির চেতনা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাস্তবেও তা-ই দেখা যায়।
কিন্তু আরেকটু গভীর গিয়ে যদি আইআইটিকে তলিয়ে দেখি, তাহলে এর সমস্যাগুলো বেরিয়ে আসতে থাকে। যেমন কেউ ঘুমিয়ে থাকলে বা কাউকে অ্যানেস্থেশিয়া দেওয়া হলে ফাইয়ের মান কমে যাওয়া উচিত। কিন্তু তা হয় না। ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের ড্যানিয়েল বোর এটি গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখেছেন। দেখা গেছে, এ সময় ফাইয়ের মান হয় একই থাকে, না হয় বেড়ে যায়।
আইআইটির কঠিন সমালোচকদের একজন, দার্শনিক জন সার্লের মতে, আইআইটি চেতনা কেন ও কীভাবে তৈরি হচ্ছে—তার সরাসরি কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারে না। এই তত্ত্ব চেতনাকে তথ্যের বাই-প্রোডাক্ট বা উপজাত হিসেবে দেখায়। সে জন্য তিনি এটিকে ‘বৈজ্ঞানিক’ প্রস্তাবনা বলে মানতে রাজি নন।
আইআইটির সবচেয়ে বড় সমস্যাটিও জন সার্লের যুক্তির পক্ষে যায়। আংশিকভাবে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের কর্মকাণ্ডকে ব্যাখ্যা করতে পারলেও এটি ব্যবহার করে পুরো মস্তিষ্কের ফাইয়ের মান হিসেব করা এককথায় অসম্ভব। শন টালও এটি স্বীকার করে নিয়েছেন।
মানুষের মস্তিষ্কে ৮৬ বিলিয়ন নিউরন আছে। এতগুলো নিউরনের জন্য হিসাব করতে গেলে যে সময় লাগবে, তা আমাদের মহাবিশ্বের বর্তমান বয়সের চেয়েও বেশি! ড্যানিয়েল বোর হিসাব করে দেখিয়েছেন, মাত্র ৩০২টি নিউরনবিশিষ্ট একটি কীটের জন্য হিসাব করতে গেলেই লেগে যাবে ৫x১০৭৯ বছর!
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা পড়েছে। যেসব জিনিসকে আমরা ‘অচেতন’ বা ‘জড়’ পদার্থ বলে ভাবি, তাদের ক্ষেত্রে আইআইটি ব্যবহার করে উদ্ভট ফলাফল পাওয়া গেছে।
ভ্যান্ডারমণ্ড ম্যাট্রিক্স নামে একধরনের ম্যাট্রিক্স আছে, যার প্রতিটি ঘরের মান আন্তসম্পর্কযুক্ত। এটি ব্যবহার করে রিড-সলোমন সার্কিট তৈরি করা হয়। কম্পিউটার যখন সিডি বা ডিভিডিতে সংরক্ষিত তথ্য পড়ার চেষ্টা করে, তখন এই তথ্যে কোনো ভুল থাকলে তা রিড-সলোমন সার্কিটের মাধ্যমে সংশোধন করা হয়। যেহেতু এই ম্যাট্রিক্সের ঘরগুলো আন্তসম্পর্কযুক্ত এবং এখানে তথ্য প্রবাহিত হচ্ছে, তাই আইআইটি ব্যবহার করলে এর জন্য ফাইয়ের মান পাওয়া যায়। দেখা গেছে, মোটামুটি বড় একটি রিড-সলোমন সার্কিটের ফাইয়ের মান অনেক বেশি! অর্থাৎ এর চেতনার মাত্রা মানুষের চেয়ে বেশি!
এটা জানার পর অনেক বিজ্ঞানীই আইআইটির ওপর ভিত্তি করে তৈরি গাণিতিক মডেলের খুব বেশি আশা দেখছেন না। ক্লেইনার ও শন টাল কিন্তু হাল ছাড়তে রাজি নন। তাঁরা আইআইটির প্রয়োজনীয় গাণিতিক উপাদানগুলো শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন।
ক্লেইনার ও শন টাল এই উপাদানগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করে নিয়েছেন—এক, ফিজিক্যাল সিস্টেম, যার মধ্যে তথ্য এনকোড হয়; দুই, অভিজ্ঞতার সচেতন প্রকাশ, এনকোডেড তথ্য থেকে প্রাপ্ত ফলাফল; আর তিন, কজ অ্যান্ড অ্যাফেক্ট, মানে কার্যকারণ ও এর ফলাফল। এই কজ অ্যান্ড অ্যাফেক্টই ফিজিক্যাল সিস্টেমের সঙ্গে অভিজ্ঞতার প্রকাশকে যুক্ত করে। আবারও মস্তিষ্কের উদাহরণে ফিরি। এখানে নিউরনগুলো হলো ফিজিক্যাল সিস্টেম, আমাদের চেতনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য যাদের ভেতরে এনকোড করা থাকে। আমাদের বিভিন্ন আচরণ বা কাজ হচ্ছে এসবের প্রকাশ। আর তথ্যকে কাজে লাগিয়ে কোনো একটি আচরণ করার জন্য আমরা সাঁকো হিসেবে কজ অ্যান্ড অ্যাফেক্ট ব্যবহার করি।
তাহলে এই যে জড় বস্তু থেকে মানুষের চেয়েও বেশি ফাইয়ের মান পাওয়া যাচ্ছে, এ নিয়ে ক্লেইনার ও শন কী ভাবছেন? শুনে মনে হতে পারে, তারা প্যানপসিকাজমের (panpsychism) সঙ্গে একমত। প্যানপসিকাজম বলে, কোনো পদার্থ যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, এর চেতনা আছে। একটা ইলেকট্রন বা প্রোটন কিংবা কোয়ার্কের চেতনা আছে, এটা মেনে নেওয়া কঠিন। তবে ক্লেইনার ও শন ব্যাপারটাকে একটু ভিন্নভাবে দেখছেন। তাঁরা বলছেন, প্যানপসিকাজমের দিকে আমরা যদি একটু ভিন্নভাবে তাকাই, তাহলে ব্যাপারটার একটা সহজ ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। হয়তো এই ক্ষুদ্র পদার্থগুলোর চেতনা নেই। তবে এদের মধ্যে চেতনার কোনো একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ হয়তো লুকিয়ে আছে। হয়তো এই ভগ্নাংশগুলো একটি নির্দিষ্ট বিন্যাসে যুক্ত হলে সত্যিকারের চেতনা তৈরি হয়।
অনেকগুলো চেতনাবিহীন জড় কণা একত্র হয়ে হুট করে চেতনা তৈরি হচ্ছে, এই ব্যাখ্যার চেয়ে ওপরের ব্যাখ্যাটিই কি যৌক্তিক নয়? সে জন্য প্যানপসিকাজমের এই ধারণাকে সরাসরি বাতিল করে দিতে রাজি নন ক্লেইনার ও শন। বরং তাঁদের মতে, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অবজারভার বা দর্শকের সঙ্গে মহাবিশ্বের কোনো ঘটনার সম্পর্কের যে ব্যাখ্যা দেয়, এটি তার সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়।
ধরা যাক, একটা ঘটনা অনেকভাবে ঘটতে পারে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলে, এই সব কটি সম্ভাব্য উপায়ই একই সঙ্গে সত্যি। যখন আমরা, অর্থাৎ দর্শক সেই ঘটনা দেখতে পা, সঙ্গে সঙ্গে একটি উপায় ছাড়া বাকিগুলো মিথ্যে হয়ে যায়। এর বিখ্যাত উদাহরণ শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল। এর কথা আমরা সবাই জানি।
শ্রোডিঙ্গার মানস পরীক্ষা হিসেবে একটি বন্ধ বাক্সের মধ্যে একটি বিড়ালের কথা ভেবেছিলেন। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলে, বিড়ালটিকে দেখার আগপর্যন্ত এটি একই সঙ্গে জীবিত ও মৃত (সম্ভাব্য একাধিক উপায় একই সঙ্গে সত্যি)। যেই মুহূর্তে আমরা বিড়ালটিকে দেখব, তার একটি অবস্থা সত্যি হবে, আরেকটি মিথ্যা হয়ে যাবে। অর্থাৎ দর্শকের দেখার মুহূর্তে তৈরি হচ্ছে ‘বাস্তবতা’। এই যে একাধিক সম্ভাব্য উপায় মিলে একটি ঘটনা ঘটছে, এর সঙ্গে অনেকগুলো কণার মধ্যে লুকিয়ে থাকা চেতনার ভগ্নাংশের ধারণাটি কি অনেকটাই খাপ খেয়ে যায় না?
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে শন ও ক্লেইনার আইআইটির ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি গাণিতিক মডেল নিয়ে একটি পেপার করেছেন। তাঁরা ওপরে আলোচিত তিন ধরনের উপাদান নিয়ে মস্তিষ্কের মতো জটিল সিস্টেমের জন্য যৌক্তিকভাবে ফাই হিসাব করার একটি পদ্ধতির কথা বলেছেন সেই পেপারে। পেপারটি এখন পিয়ার-রিভিউয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
এখন পর্যন্ত আইআইটি খুব শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক প্রস্তাবনা বলে বিবেচিত হচ্ছে না। তবে এটি কেবল শুরু। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বা স্ট্রিং থিওরিকে শুরুর দিকে আরও অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। বর্তমানে আমরা কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে ‘বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব’ বলে মেনে নিয়েছি। স্ট্রিং থিওরি খাতা-কলমে ‘তত্ত্ব’ বলে গৃহীত হয়েছে, যদিও হাতে-কলমে এটি এখনো প্রমাণিত হয়নি। সেই হিসেবে আইআইটির শুরুটাকে খুব একটা মন্দ বলার উপায় নেই। হয়তো এটি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবে না, বাতিল হয়ে যাবে; কিন্তু এর মধ্যে দিয়েই হয়তো আমরা আরও গ্রহণযোগ্য কোনো বৈজ্ঞানিক প্রস্তাবনা বা তত্ত্বের খোঁজ পেয়ে যাব। হয়তো গাণিতিকভাবে আসলেই ব্যাখ্যা করা যাবে চেতনাকে।
পৃথিবীতে বসে যারা বিলিয়ন বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের দুটি কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষের ফলাফল কী হবে—তা বের করে ফেলতে পারে, হিসাব করে বের করে ফেলতে পারে মহাবিশ্বের বয়স, তারা একসময় চেতনার রহস্যও ভেদ করতে পারবে—এটুকু স্বপ্ন বোধ হয় দেখাই যায়!
লেখক: শিক্ষার্থী, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট, উইকিপিডিয়া, রিসার্চগেট/ জোহাননেস ক্লেইনার