আমরা প্রতি বছর পাহাড় পরিমাণ প্লাস্টিক ফেলে রাখি। ২০২২ সালে বিশ্বে প্রায় ২৬ কোটি ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়েছিল। এর মধ্যে মাত্র ১৪ শতাংশ, অর্থাৎ ৩ কোটি ৮০ লাখ টন রিসাইকেল করা গেছে। বাকিটা হয় পুড়িয়ে ফেলা হয়, নয়তো জমা হয় ভাগাড়ে। প্লাস্টিক দূষণের কারণে যে আমাদের পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে, তা আর নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু এত বছরেও প্লাস্টিক রিসাইকেলের হার তেমন বাড়েনি। ফলে প্রশ্ন উঠছে, প্লাস্টিক রিসাইকেল করে আসলেই কি কাজের কিছু হচ্ছে? নাকি রিসাইকেল করে প্লাস্টিক কমানোর আশা ছেড়ে দেওয়াই ভালো?
প্লাস্টিকের সমস্যাটা কিন্তু আমাদের ভাবনার চেয়েও জটিল। গত কয়েক দশকে সারা বিশ্বে প্লাস্টিকের ব্যবহার অনেক বেড়েছে। কিন্তু অনেক দেশেই এই আবর্জনাগুলো জমা করা, আলাদা করা এবং রিসাইকেল করার মতো তেমন ভালো ব্যবস্থা নেই। যত প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, তার মাত্র ২৭ শতাংশ জমা করে রিসাইকেলের জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারও অর্ধেক রিসাইকেল হয়।
চীনের সিংহুয়া ইউনিভার্সিটির গবেষক কোয়ানইন তান প্লাস্টিক নিয়ে গবেষণা করেছেন দীর্ঘদিন। তিনি বলেছেন, ‘প্লাস্টিক বর্জ্যের একটা বড় অংশ আসে আমরা যা খাই বা ব্যবহার করি, তার প্যাকেট থেকে। সারা বিশ্বে যত প্লাস্টিক ব্যবহার হয়, তার ৪৪ শতাংশই এই প্যাকেজিংয়ের জন্য দায়ী।’
প্লাস্টিকের প্যাকেটগুলো খুব সস্তা হওয়ায় মানুষ একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেয়। রিসাইকেল কোম্পানিগুলোর জন্য এগুলো জমা করা আর আলাদা করা বেশ খরচসাপেক্ষ। তাছাড়া প্যাকেজিংয়ে এত রকমের প্লাস্টিক আর নানা রকমের জিনিস মেশানো হয় যে কোনটা রিসাইকেল করা যাবে আর কোনটা যাবে না, তা আলাদা করাও কঠিন। এমনকি অনেক সময় নতুন প্লাস্টিক তৈরি করার চেয়ে রিসাইকেল করার খরচ বেশি পড়ে যায়। ফলে কোম্পানিগুলো প্লাস্টিক রিসাইকেল করতে তেমন আগ্রহী হয় না।
এর সঙ্গে আরও একটা সমস্যা হলো, অনেক দেশে রিসাইকেলের জন্য দরকারি সাধারণ ব্যবস্থাও নেই। যেমন, বাড়ি থেকে আবর্জনা নেওয়ার নিয়মিত সার্ভিসে সমস্যা দেখা যায়। শুধু দরিদ্য দেশেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও মাত্র ৫ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইকেল করা হয়, আর ৭৫ শতাংশের বেশি পাঠানো হয় ভাগাড়ে।
লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের গবেষক আগি ব্রান্ডট-টালবট বলেছেন, ‘নতুন প্লাস্টিক তৈরির জন্য আমাদের একটা বিশাল অবকাঠামো আছে। কিন্তু প্লাস্টিক রিসাইকেল করার জন্য তেমন উন্নত কোনো ব্যবস্থা নেই।’
ফলে অনেক দেশে এখন রিসাইকেল করার বদলে প্লাস্টিক পুড়িয়ে ফেলার পথ বেছে নিচ্ছে। ২০২২ সালে ৩৪ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য এভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। কিছু অঞ্চলে তো এই হার আরও বেশি। যেমন, জাপান ৭০ শতাংশ, চীন ৬০ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ৩৮ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলে।
অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে প্লাস্টিক ভাগাড়ে ফেলার চেয়ে পুড়িয়ে ফেলা ভালো। কারণ, এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ তৈরি করা যায়। কিন্তু এতে গ্রিনহাউস গ্যাসও বের হয়। তাছাড়া এটা প্লাস্টিকের পুনর্ব্যবহার নয়, বরং একেবারে শেষ করে দেওয়া।
তবে এত সমস্যা থাকার পরেও আমাদের এখনই প্লাস্টিক রিসাইকেল করা বন্ধ করে দেওয়া উচিত নয়। যেসব দেশে ভালো রিসাইকেল ব্যবস্থা আছে এবং সরকার সাহায্য করছে, সেখানে প্লাস্টিক রিসাইকেলের হার বিশ্ব গড়ের চেয়ে অনেক বেশি। জাপানে প্রায় ২০ শতাংশ এবং চীন ২৩ শতাংশ প্লাস্টিক রিসাইকেল করে।
তবে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। খুব নিখুঁতভাবে যদি প্লাস্টিক সংগ্রহ ও আলাদা করাও যায়, তবু সব প্লাস্টিক রিসাকেল করা যাবে না। গত ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে আমরা প্লাস্টিক তৈরি করেছি, সেগুলোকে আরও কীভাবে উন্নত করা যায়, সেই চেষ্টাও করেছি। কিন্তু এই প্লাস্টিকগুলো কীভাবে রিসাইকেল করা যায়, তা নিয়ে খুব বেশি কাজ করা হয়নি।
তবে ভালো খবর হলো, এখন দিন দিন আরও উন্নত হচ্ছে। নতুন কেমিক্যাল রিসাইকেলের সাহায্যে প্লাস্টিককে ভেঙে মূল রাসায়নিক উপাদানে পরিণত করা সম্ভব। মানে প্লাস্টিক তৈরির সময় রাসায়নিক যেমন ছিল, সে অবস্থায় নেওয়া যাবে। বিজ্ঞানীরা এখন এই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। তাই নতুন প্রযুক্তি তৈরি হবে, প্লাস্টিক রিসাইকেলের নতুন ও উন্নত প্রযুক্তি আসবে।
সব মিলিয়ে আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। ধীরে ধীরে এই নতুন প্রযুক্তিগুলো বাস্তবায়িত হলে হয়তো বিশ্বে প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের হার বাড়বে। আর যেসব যাদের দেশে ভালো রিসাইকেল ব্যবস্থা আছে, তারা অবশ্যই তাদের পানীয়ের বোতল আর দইয়ের পাত্রগুলো রিসাইকেলের জন্য আলাদা করে রাখুন।
