যত কাণ্ড বেগুন নিয়ে

সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন ও তাঁর সহগবেষকদের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় নেচার পোর্টফোলিও জার্নাল সায়েন্টিফিক রিপোর্টস-এ। এতে জানা যায়, ট্রেস মেটাল লেড ও ক্যাডমিয়ামের মতো ধাতু পাওয়া গেছে বেগুনে। সেই গবেষণার নানা দিক ও বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব...

নেচার পোর্টফোলিও জার্নাল 'সায়েন্টিফিক রিপোর্টস'–এ প্রকাশিত প্রবন্ধ

বেগুন খাব, নাকি খাব না? বেগুনের কি তাহলে আর কোনো গুণ নেই? এ রকম অনেক প্রশ্নে সরগরম সাম্প্রতিক বাংলাদেশ। বেগুন নিয়ে একটি গবেষণা অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে একদিকে গণমাধ্যমকে, অন্যদিকে জনস্বাস্থ্যকে।

বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় সবজিজাতীয় খাবারের মধ্যে বেগুন অন্যতম। বাণিজ্যিক দিক বিবেচনা করলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এর যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। প্রায় সব শ্রেণির মানুষের কাছে সহজলভ্য সবজি এই বেগুন। এটি একদিকে যেমন শস্যখেতে চাষ করা যায়, অন্যদিকে নিজের বাড়িতেই অনেক নারী বেগুনের চারা লাগান। রমজানের সময়ে ইফতারের টেবিলে বেগুন অনেকটা অত্যাবশ্যকীয়। ধরা হয়, বেগুনের রয়েছে কয়েক শ কোটি টাকার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার। এখন প্রশ্ন হলো, বেগুনের কি আসলে কোনো উপকারী ভূমিকা আছে মানবদেহে? কেন আমাদের বেগুন খাওয়া দরকার?

বেগুনের কিছু উপাদান রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। পাশাপাশি বেশ কিছু ক্ষেত্রে সহায়তা করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে৷ বেগুনে থাকে বিভিন্ন ফাইটোনিউন্ট্রিয়েন্টস, তথা উদ্ভিজ্জ উপাদান। বিভিন্ন সময়ে এসব পুষ্টি উপাদান মস্তিষ্কের কোষপ্রাচীরের সুরক্ষা দেয়। মস্তিষ্কের এক অংশ থেকে অন্য অংশে তথ্য আদান-প্রদানে সহায়তা করে। কিছু গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বেগুনে থাকা বিশেষ কিছু উপাদান সাহায্য করে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে। সেই সঙ্গে গ্লুকোজের বিপাককে দ্রুততর করে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। এতে রয়েছে উচ্চমাত্রার আঁশজাতীয় খাদ্য উপাদান, যা হজমশক্তি বাড়ায়।

সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি রসায়ন বিভাগের বিজ্ঞানী অধ্যাপক মো. জাকির হোসেন ও তাঁর সহগবেষকদের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় নেচার পোর্টফোলিও প্রকাশনা সংস্থার জার্নাল সায়েন্টিফিক রিপোর্টস-এ। গবেষক দলে আরও ছিলেন অধ্যাপক কাজী ফরহাদ কাদির, অধ্যাপক হারুনুর রশিদ এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএস (থিসিস) শিক্ষার্থী আনিকা বুশরা। বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় আসা এই জার্নালকে কিউ ওয়ান র৵াঙ্কিং, তথা একটি মানসম্মত জার্নাল হিসেবে বিবেচনা করা হয় স্কুপাস ডেটাবেজ অনুযায়ী।

ফুল থেকে বেগুন হচ্ছে গাছে

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিয়মিতভাবেই সার্ভিল্যান্স, তথা পর্যবেক্ষণ করা হয়। দেখা হয়, বিভিন্ন খাবারের পুষ্টিগুণ যথাযথ আছে কি না বা অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো উপাদানের অনুপ্রবেশ ঘটেছে কি না। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা জনগণকে আশ্বস্ত করেন প্রচলিত খাবারের ব্যাপারে। অথবা নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন আশঙ্কাজনক কোনো কিছুর উপস্থিতি পেলে।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক এই গবেষণা মূলত পরিচালিত হয় জামালপুর জেলার ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলার ২০টি স্থান থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সংগৃহীত বেগুন নিয়ে। কেন জামালপুরকে নির্বাচন করা হলো গবেষণার স্থান হিসেবে? কারণ, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বৃহত্তর ময়মনসিংহের শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলায় মোট যে পরিমাণ বেগুন উৎপাদিত হয়, এর ৬০ শতাংশ আসে জামালপুরের ইসলামপুর থেকে। এই জেলার ২টি উপজেলা থেকে বেগুনের ৮০টি ও মাটির (টপ সয়েল) ৬০টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। অর্থাৎ গবেষণাটি শুধু বেগুনের ওপর হয়নি, যে মাটিতে এই বেগুন চাষ করা হয়েছে, সেই মাটির নমুনাও পরীক্ষা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, দেশের প্রায় ৯ ভাগ বেগুন উৎপাদিত হয় জামালপুরে। তার মধ্যে ইসলামপুরে ৬০ ভাগের বেশি বেগুন উৎপাদিত হয়।

কী নিয়ে গবেষণা? প্রচলিত জনপ্রিয় খাদ্যে কী পরিমাণ ট্রেস মেটাল, তথা গৌণ ধাতু পাওয়া যাচ্ছে, এই কাজের উদ্দেশ্য ছিল তা দেখা। ট্রেস মেটাল বা ট্রেস ধাতু মানে সেসব ধাতু, যেগুলো সাধারণত প্রাণী, উদ্ভিদকোষ ও টিস্যুতে অল্প, কিন্তু পরিমাপযোগ্য পরিমাণে উপস্থিত থাকে। যেগুলো পুষ্টি ও শারীরবৃত্তির একটি প্রয়োজনীয় অংশ, কিন্তু খুব বেশি পরিমাণ প্রয়োজন নেই শরীরের। উদাহরণ দিই। লোহা, লিথিয়াম, কপার, ক্রোমিয়াম, নিকেল, ক্যাডমিয়াম, লেড ইত্যাদি ট্রেস মেটাল। ‘ট্রেস মেটাল’ শব্দটিকে অনেকে ‘হেভি মেটাল’ হিসেবে ব্যবহার করেছে, যা সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। খাদ্যনিরাপত্তার অবস্থা পর্যবেক্ষণের লক্ষ্যে পরিচালিত এ গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল, প্রচুর পরিমাণে বেগুন উৎপাদিত হওয়া এলাকার মাটি এবং বেগুনে কোনো ক্ষতিকর উপাদান আছে কি না, তা দেখা। যদি থাকে, তবে মানবদেহে এর প্রভাব কী? এই গবেষণায় অ্যাটমিক অ্যাবজর্পশন ফটোমিটার নামের একটি যন্ত্রের মাধ্যমে ধাতুগুলোর মাত্রা নির্ণয় করা হয়।

কী পাওয়া গেল এ গবেষণায়? গবেষকদের মতে, দেহের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় ট্রেস মেটাল লেড, ক্যাডমিয়াম ও নিকেলের উপস্থিতি ধরা পড়েছে এই বেগুনগুলোতে; যার মাত্রা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি। এর পরিমাণ অতিরিক্ত হয়ে গেলে এবং নিয়মিতভাবে তা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলে কিছু ক্ষেত্রে ক্যানসার সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া লেড ও ক্যাডমিয়াম মূত্রনালির অস্বাভাবিকতা, হাড়ক্ষয় হওয়া, রক্তে কোলেস্টেরল বাড়িয়ে দেওয়া, হৃদ্‌রোগের সমস্যার মতো শারীরিক জটিলতার উদ্রেক করে। নিকেল কিছু ক্ষেত্রে বিষক্রিয়ার উদ্রেক করতে পারে।

গবেষকদের মতে, দেহের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় ট্রেস মেটাল লেড, ক্যাডমিয়াম ও নিকেলের উপস্থিতি ধরা পড়েছে এই বেগুনগুলোতে; যার মাত্রা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি

এই গবেষণায় আরও কিছু তথ্য উঠে আসতে পারত। হয়তো পরের ধাপে বিজ্ঞানীরা তা প্রকাশ করবেন। যেমন কৃষকের কাছ থেকে যেসব বেগুন সংগ্রহ করা হয়েছে, তা হাইব্রিড নাকি স্থানীয় জাতের, সে বিষয়ে এ গবেষণা থেকে জানা যায়নি। এ ছাড়া দেশের প্রায় সব জেলাতেই বেগুনের চাষ হয়। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন এলাকার বেগুনের জাত ভিন্ন, চাষের মৌসুম ও পদ্ধতিও ভিন্ন। অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় জাতের বেগুনে সার, কীটনাশক বা বালাইনাশকের ব্যবহার খুব কম। অল্প জমিতে যাঁরা চাষ করেন, তাঁরা সীমিতভাবে ব্যবহার করেন অনেক ক্ষেত্রে। তাই কোন ধরনের বেগুনে এসব ধাতু পাওয়া গেছে, তা আরও বিস্তারিত জানা প্রয়োজন খাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিতকারী নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর। এমনকি স্থানীয় জাত ও হাইব্রিড বা উফশী জাতের মধ্যে ফলাফলে কোনো পার্থক্য আছে কি না, বিস্তারিত জানা প্রয়োজন এ ব্যাপারেও।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার তাই কিছু নেই। এই গবেষণার ফলাফল অস্বাভাবিক কিছু নয় বা আগে কোনো দিন কেউ জানত না, এমন কিছু নয়। এ ধরনের ভারী ধাতু মাছসহ অনেক খাদ্যে আছে। কোথাও মাত্রা কম, কোথাও বেশি। লেড দূষণ অন্যান্য সবজিতেও এর আগে পাওয়া গেছে। এই দূষণ ঘটে বাতাস, পানি ও মাটির মাধ্যমে। আর সেটা হয় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণে। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণায় দেখা গেছে, ধান, ভুট্টা ও গমেও লেডের দূষণ আছে, যা গ্রহণযোগ্যমাত্রা—প্রতি কেজিতে শূন্য দশমিক ৮২ মিলিগ্রামের চেয়ে বেশি। একইভাবে বিভিন্ন গবেষণায় ধান ও সবজিতে পাওয়া গেছে ক্যাডমিয়াম। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সয়েল সায়েন্স বিভাগের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৯ সালে ফুলকপি ও টমেটোতে লেডের দূষণ ছিল উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, শিল্পকারখানার বর্জ্য আছে, এমন এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত শাক (যেমন পালং), টমেটো, ফুলকপি ইত্যাদি ফসলে ক্যাডমিয়াম ও নিকেল পাওয়া গেছে। বেগুনে পাওয়া হেভি মেটালের (ভারী ধাতু) উপাদান মানবদেহের কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতির কারণ হতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে হেভি মেটালযুক্ত বেগুন খেলে ক্যানসারসহ লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

এ গবেষণায় আরেকটি আশঙ্কাজনক তথ্য পাওয়া গেছে। তা হলো মাটিতে ব্যাপক হারে লেড, নিকেল, ক্রোমিয়াম ও কপারের উপস্থিতি। মানে, এই এলাকার মাটি ফসল চাষের জন্য বিপজ্জনক। এখানকার অন্যান্য ফসলে এসব ধাতুর উপস্থিতির আশঙ্কা প্রকট। পানিতেও তা প্রবাহিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

জামালপুরের ইসলামপুর থেকে গবেষণার জন্য সংগ্রহ করা হয় বেগুন, মূল গবেষণাপত্র থেকে নেওয়া

বেগুন আমাদের জন্য উপকারী একটি আন্তর্জাতিক সবজি, এর বাণিজ্যিক চাহিদা ব্যাপক। বিলিয়ন ডলারের বাজার। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে বেগুন খায় এবং বাণিজ্যিকভাবে বেগুনের ব্যাপক চাষ হয়। বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলো বেগুনের আদি উৎপত্তিস্থল বলে চিহ্নিত। আমাদের দেশেই দুই শতাধিক জাতের বেগুন আছে। তবে এ ক্ষেত্রে বাজারে হাইব্রিড বেগুনের আধিক্য দেখে অনেকের ভুল ধারণা তৈরি হয়েছে। ভাবা হয়, বেগুন মানে মাত্র দু–একটি জাত। যেমন লম্বা বা গোলাকার বেগুন। বেগুনি রঙের বেগুন বা সবুজ রঙের বেগুন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বেগুনের অনেক আকৃতি, ছোট-বড় হরেক রকমের পাওয়া যায়। রঙেও বৈচিত্র্য আছে। ভবিষ্যতে বেগুনের স্থানীয় জাতের সক্ষমতা, এতে বিভিন্ন উপাদানের উপস্থিতি ও এর গুণাগুণ নিয়ে গবেষণা হতে পারে।

খাদ্য ও ফসল উৎপাদন নিয়ে বাংলাদেশ গর্ব করে। কিন্তু নিরাপদ পদ্ধতিতে কতটুকু খাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে, তা নানা গবেষণায় প্রশ্নবিদ্ধ। সরকার এ বিষয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে সরকারের রয়েছে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, বিতরণ ও বিপণন–সংক্রান্ত আইন। দেশে সক্রিয় একটি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষও আছে; অর্থাৎ সরকার এ ধরনের সমস্যা এড়াতে চায়। এরপরও বাণিজ্যিক খাদ্য ফসল উৎপাদনে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার হচ্ছে, এটা পুরোপুরি ঠেকানো যায়নি। তাই খাদ্য ফসল উৎপাদনে অনাকাঙ্ক্ষিত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক অবিলম্বে বন্ধ করার দিকে আরও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। পুরো দেশেই এ ব্যাপারে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

বিজ্ঞানীরা দেশের টাকায় দেশের জন্য কাজ করেন। তাই গণমাধ্যমে তাঁদের গবেষণা জানানো অনেকটা দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। জনগণেরও অধিকার আছে তাঁদের কাজের ফলাফল জানার। একই সঙ্গে এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোও জানতে পারে বিভিন্ন অসংগতি। তাই সরকারি-বেসরকারি সচেতন সংস্থাগুলো এ ধরনের গবেষণায় আরও আগ্রহী হয়ে উঠবে, উৎসাহ দেবে বিজ্ঞানীদের, এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা। গবেষণাই হোক এই সমাজের অসংগতি দূর করার হাতিয়ার।

লেখক: অধ্যাপক, জিনপ্রকৌশল ও জৈব প্রযুক্তি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়