বাংলাদেশে প্রথম সিঙ্গেল সেল জিনোমিক্স ডাটা সংশ্লেষণ

অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহার নেতৃত্বে বাংলাদেশে প্রথম সিঙ্গেল সেল জিনোমিক্স ডাটা সংশ্লেষণ করেছেন চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের বিজ্ঞানীরাফাইল ছবি

অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহার নেতৃত্বে বাংলাদেশে প্রথম সিঙ্গেল সেল জিনোমিক্স ডাটা সংশ্লেষণ করেছেন চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের বিজ্ঞানীরা। তাঁরা চ্যান জাকারবার্গ ইনস্টিটিউটের অর্থায়নে শিশুদের নাক ও মুখের মিউকোসার কোষের অ্যাটলাস তৈরির একটি আন্তর্জাতিক প্রকল্পের অংশ হিসেবে কাজ করছেন। এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আছেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, এমআইটি ও বোস্টন চিলড্রেনস হসপিটালের বিজ্ঞানীরাও।

এই প্রকল্পে প্রধান গবেষক হিসেবে যুক্ত আছেন যুক্তরাষ্ট্র, গ্যাম্বিয়া, বাহামাস, ভারত ও বাংলাদেশের মোট এগারো জন বিজ্ঞানী। বাংলাদেশ থেকে আছেন চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা। তাঁর নেতৃত্বে চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষকদল শিশুদের নাক ও মুখের মিউকোসার কোষের সংগৃহীত নমুনার সিঙ্গেল সেল জিনোমিক্স ডাটা সংশ্লেষণ করেছেন। সিঙ্গেল সেল জিনোমিক্স ডাটা সংশ্লেষণ দেশে এই প্রথম।

এ বিষয়ে প্রকল্পের অন্যতম প্রধান গবেষক সেঁজুতি সাহা বিজ্ঞানচিন্তাকে বলেন, ‘আমরা সুস্থ শিশুদের নাক ও মুখের জিনোমিক্স তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখতে চাই। সর্দি-কাশি বা সংশ্লিষ্ট রোগে ভূগছে, এমন শিশুদের জিনোমিক্স তথ্যও বিশ্লেষণ করে দেখতে চাই। দুটোর তুলনা করলে আমরা এই রোগের পেছনের বিষয়গুলো আরও ভালো বুঝতে পারব, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উদ্যোগ নিতে পারব। এটা আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধির পাশাপাশি শিশুরোগ কমানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’

আমরা সুস্থ শিশুদের নাক ও মুখের জিনোমিক্স তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখতে চাই। সর্দি-কাশি বা সংশ্লিষ্ট রোগে ভূগছে, এমন শিশুদের জিনোমিক্স তথ্যও বিশ্লেষণ করে দেখতে চাই। দুটোর তুলনা করলে আমরা এই রোগের পেছনের বিষয়গুলো আরও ভালো বুঝতে পারব, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উদ্যোগ নিতে পারব। এটা আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধির পাশাপাশি শিশুরোগ কমানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
—সেঁজুতি সাহা, অণুজীববিজ্ঞানী

মানবদেহে প্রায় ৩৭ ট্রিলিয়ন (বা ৩৭ লক্ষ কোটি) কোষ থাকে। একেক ধরনের কোষের কাজ একেকরকম। তবে সব ধরনের কোষ সম্পর্কে সবকিছু এখনো জানেন না বিজ্ঞানীরা। দেহের কোন অংশে কী রকম কোষ আছে; তাদের মলিকিউলার বা আণবিক বৈশিষ্ট্য কী, অর্থাৎ কোষগুলোতে কী ধরনের অণু আছে—এসব তথ্য জানা থাকলেই কেবল বোঝা যায়, বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলে দেহে কোষ পর্যায়ে কী কী পরিবর্তন আসে। পাশাপাশি এসব ক্ষতিকর পরিবর্তন কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়, কিংবা এর প্রতিকার কী হতে পারে—এসব নিয়ে কাজ করা সম্ভব হয়। দেহের বিভিন্ন ধরনের কোষের অবস্থান ও বৈশিষ্ট্যকে এভাবে ‘ম্যাপিং’ বা মানচিত্রের মতো সাজানোই হলো ‘অ্যাটলাস’ তৈরি। এ লক্ষ্যে ২০১৬ সালে একটি বৈশ্বিক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়—হিউম্যান সেল অ্যাটলাস। এ কনসোর্টিয়ামের মূল উদ্দেশ্যই হলো দেহের কোষগুলোর একটি ত্রিমাত্রিক অ্যাটলাস তৈরি করা।

হিউম্যান সেল অ্যাটলাস কাজ করে আন্তর্জাতিক সহযোগিতায়। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে দেহের কোষগুলোর জিনোম বা জিন বিন্যাস বের করে নিয়ে সেগুলো পড়েন হিউম্যান সেল অ্যাটলাস প্রকল্পে জড়িত বিজ্ঞানীরা। এর সঙ্গে শক্তিশালী কম্পিউটিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে তাঁর বের করেন, দেহের কোষগুলো ঠিক কীভাবে ভেতরে থাকা জিনোম ব্যবহার করছে। দেহের জিনোম বা জিন বিন্যাস যদি বই হয়, তবে আমাদের কোষগুলো কীভাবে এই বই পড়ে সে অনুযায়ী কাজ করে, তা নিয়েই কাজ এই বিজ্ঞানীদের।

ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশনের মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে সিঙ্গেল সেল জিনোমিক্স ডাটা সংশ্লেষণের নানা ধরণের কোষ ও কোষীয় উপাদান
ছবি : চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন
আরও পড়ুন

এ বিষয়টি সহজ করে বোঝাতে গিয়ে অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা বলেন, ‘ধরুন, আমার কাছে অনেকগুলো ফল আছে। আঙুর, আপেল, কমলা ইত্যাদি। আবার আঙুরগুলোর কোনোটা ভালো, কোনোটা থেঁতলে গিয়েছে, কোনোটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ সবই আঙুর, তবে প্রতিটা আঙুর আলাদা। কোষের ব্যাপারেও বিষয়টা এমন। ডিএনএ সবগুলো কোষের জন্য একই। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের কোষের জন্য ডিএনএর নির্দিষ্ট ও ভিন্ন ভিন্ন অংশ কাজ করে। সেটা বুঝতে শুধু ডিএনএ সিকোয়েন্স করলে হয় না, আরএনএ সিকোয়েন্স করে দেখতে হয়। কারণ, এই আরএনএ ডিএনএ নামের বই পড়ে পড়ে, সেখানকার নির্দিষ্ট নির্দেশ অনুযায়ী প্রোটিন তৈরি করে। আর এই প্রোটিনগুলোই কোষের বিভিন্ন কাজ করে। বিষয়টা অনেক ব্যয়বহুল। কারণ, এভাবে আমাদের শত শত কোষকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করতে হয়। তবে এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে সুস্থ ও অসুস্থ কোষের পার্থক্যগুলো চিহ্নিত করতে পারলে শিশুদের চিকিৎসায় অনেক অগ্রগতি করা সম্ভব।’

হিউম্যান সেল অ্যাটলাসের প্রথম খসড়া তৈরির কাজ এখন চলমান। এ জন্য কাজ চলছে ১৮টি সিস্টেমের ওপর। এই অ্যাটলাস তৈরি হলে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে, যেন সব দেশের বিজ্ঞানীরা অ্যাটলাস কাজে লাগিয়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে কাজ করতে পারেন। ইতিমধ্যেই ফুসফুস ও মস্তিষ্কের অ্যাটলাস সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।

২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হিউম্যান সেল অ্যাটলাস কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে বর্তমানে যুক্ত আছেন ৯৯টির বেশি দেশের ১ হাজার ৭০০টির বেশি প্রতিষ্ঠানের ৩ হাজার ২০০ জনেরও বেশি বিজ্ঞানী। তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন দেশ, জাতি, বয়সের সীমা ছাড়িয়ে। এই প্রকল্পে জীববিজ্ঞানীর পাশাপাশি যুক্ত আছেন চিকিৎসক, কম্পিউটারবিজ্ঞানী, সফটওয়্যার প্রকৌশলী থেকে শুরু করে গণিতবিদরাও। এত বড় এবং উন্মুক্ত এই প্রকল্পের অর্থ যোগান দেয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, যাদের মধ্যে অন্যতম চ্যান জাকারবার্গ ইনস্টিটিউট।

চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষকেরা কাজ করছেন
ছবি : চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন

চ্যান জাকারবার্গ ইনস্টিটিউট মূলত কাজ করে শিশুদের কোষের অ্যাটলাস তৈরিতে। জীবনের বিভিন্ন সময়ে আমাদের বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়। তবে অনেক রোগের শুরুটা হয় বাল্যকালেই। এসব রোগ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষ থেকে পাওয়া কোষের চেয়ে বেশি জরুরি শিশুদের কোষ নিয়ে কাজ করা। একইভাবে পৃথিবীর সব জায়গায়, সব পরিবেশের মানুষের রোগ-ব্যাধি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও এক নয়। তাই ধারণা করা যায়, তাদের দেহের কোষগুলোতেও কিছু পার্থক্য আছে। কোষ নিয়ে কাজ করার সময় তাই বিভিন্ন বয়সের মানুষ নিয়ে যেমন কাজ করতে হয়, তেমনি কাজ করতে হয় বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন পরিবেশের মানুষ নিয়ে।

পুরো দেহের কোষ নিয়ে কাজ করার কথা বলা যত সহজ, করা তার চেয়ে বহুগুণ কঠিন। তাই এই কাজ করা হয় ধাপে ধাপে, কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে প্রাধান্য দিয়ে। শিশুদের কোষ নিয়ে কাজ করার সময় তাই প্রাধান্য পেয়েছে তাদের নাক ও মুখ। নাক ও মুখের মিউকোসা, অর্থাৎ শ্লেষ্মার ঝিল্লির কোষগুলো বাইরের পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত। তাই বাইরের পরিবেশ ও বিভিন্ন রোগজীবাণুর সংস্পর্শে এগুলোই সবচেয়ে বেশি আসে। নাক ও মুখ যুক্ত থাকে শ্বাসতন্ত্র ও পরিপাকতন্ত্রের সঙ্গে। তাই এই দুই তন্ত্রের রোগব্যাধির সঙ্গেও এখানকার কোষের সম্পর্ক আছে।

হিউম্যান সেল অ্যাটলাসের প্রথম খসড়া তৈরির কাজ এখন চলমান। এ জন্য কাজ চলছে ১৮টি সিস্টেমের ওপর
ছবি : চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন

আবার নাক, মুখ থেকে কোষ সংগ্রহ করাও সহজ, যেটা শিশুদের নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এসব দিক বিবেচনা করেই চ্যান জাকারবার্গ ইনস্টিটিউট শুরু করে শিশুদের নাক ও মুখের মিউকোসার অ্যাটলাস তৈরির অন্যতম এ প্রকল্প।

শিশুদের নাক ও মুখের মিউকোসার কোষ সংগ্রহ করে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এই কোষগুলোর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যেমন জানা যাবে, তেমনি জানা যাবে বিভিন্ন রোগে কোষগুলোর কেমন পরিবর্তন হয়। এ জন্য বিশ্বের সাতটি স্থান থেকে এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। মূল লক্ষ্য, এই নমুনা থেকে পাওয়া তথ্য দিয়ে সব জায়গার শিশুদের উপযোগী নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি উন্মোচিত করা।

বিশ্বকে এ লক্ষ্যের দিকে একধাপ এগিয়ে নিলেন চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের বিজ্ঞানীরা।

লেখক: ইন্টার্ন চিকিৎসক, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল

সূত্র: ১. হিউম্যানসেলঅ্যাটলাস.অর্গ

২. চ্যানজাকারবার্গ.কম

৩. সিএইচআরএফবিডি. অর্গ