নিজ কর্মে অমর প্রাণীবিজ্ঞানী জেন গুডঅল

জেন গুডঅলন্যাশনাল জিওগ্রাফি

আমি এখন বসে আছি লাউয়াছড়া জঙ্গলে। উল্লুকের ডাক শুনছি। হঠাৎ ইন্টারনেট সংযোগ পেতেই জানলাম, বিখ্যাত শিম্পাঞ্জি বিশেষজ্ঞ জেন গুডঅল আর নেই। ৯১ বছর বয়সে স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুবরণ করেছেন এই প্রকৃতিবিদ।

জীবন ১০ বছরের হোক বা ১০০ বছরের, তা পৃথিবীকে কতটা বদলে দিতে পারল, সেটাই মূখ্য। জেন গুডঅলের জীবন যেন তেমনই একটি বই। এর প্রতিটি পাতায় রয়েছে জীবনের জয়গান। লিপিবদ্ধ আছে পৃথিবীর শুদ্ধতম প্রাণের গল্প, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা।

জেন গুডঅল (Jane Goodall) বিশ্বের অন্যতম প্রখ্যাত একজন প্রাণিবিজ্ঞানী ও পরিবেশকর্মী ছিলেন। তিনি ১৯৩৪ সালের ৩ এপ্রিল ইংল্যান্ডের লন্ডন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই প্রাণী ও প্রকৃতির প্রতি তাঁর ছিল অদম্য কৌতূহল। এই কৌতূহলই তাঁকে পরে প্রাণিবিজ্ঞান গবেষণায় এক নতুন যুগের সূচনা করতে সাহায্য করে।

জেন গুডঅল
ন্যাশনাল জিওগ্রাফি

শৈশব থেকেই জেন গুডঅল প্রাণীদের ভীষণ ভালোবাসতেন। লন্ডনের ছোট্ট মেয়েটি বই পড়ত, আফ্রিকার স্বপ্ন দেখত আর টারজানের গল্পে ডুবে থাকত। সেই সময়ে একজন মেয়ের বিজ্ঞানী হওয়া বা জঙ্গলে গবেষণা করার স্বপ্ন ছিল প্রায় অবাস্তব। তাঁর পরিবারও ধনী ছিল না। তাই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাননি। তবুও নিজের স্বপ্নকে তিনি আঁকড়ে ধরলেন।

২৩ বছর বয়সে জেন সেক্রেটারি ও ওয়েট্রেসের কাজ করে টাকা জমান। সেই টাকা দিয়ে চলে যান আফ্রিকায়। সেখানে তাঁর দেখা হয় বিখ্যাত ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ লুইস লিকির সঙ্গে। জেনের কৌতূহল ও প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ হন লিকি। তিনি জেনকে তানজানিয়ার গোম্বে স্ট্রিম ন্যাশনাল পার্কে শিম্পাঞ্জিদের ওপর গবেষণার দায়িত্ব দেন।

১৯৬০ সালে জেন গোম্বেতে গবেষণা শুরু করেন। তিনি একটি ছোট তাঁবুতে একা থাকতেন। শিম্পাঞ্জিরা প্রথমে তাঁকে ভয় পেয়ে পালিয়ে যেত। কিন্তু জেন ধৈর্য হারাননি। তিনি প্রতিদিন দূর থেকে তাদের পর্যবেক্ষণ করতেন। ধীরে ধীরে শিম্পাঞ্জিরা তাঁর উপস্থিতি মেনে নেয়।

একদিন তিনি একটি অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখেন। ডেভিড গ্রেবিয়ার্ড নামে একটি শিম্পাঞ্জি গাছের ডালকে কাঠি হিসেবে ব্যবহার করে উইপোকা শিকার করছিল। এর আগে বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, শুধু মানুষই যন্ত্র বা টুল ব্যবহার করতে পারে। জেনের এই আবিষ্কার বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এটি মানুষ ও অন্য প্রাণীর পার্থক্য নিয়ে প্রচলিত ধারণা বদলে দেয়।

তাঁর গবেষণা প্রমাণ করে, শিম্পাঞ্জিদেরও মানুষের মতো আবেগ ও সামাজিক সম্পর্ক আছে। তাদের মধ্যে পরিবার, ভালোবাসা, সহানুভূতি, এমনকি যুদ্ধ ও সংঘাতের মতো জটিল আচরণও দেখা যায়।

শুরুতে অনেক পুরুষ বিজ্ঞানী তাঁর গবেষণাকে গুরুত্ব দেননি। কারণ, তাঁর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ছিল না। কিন্তু তাঁর কাজের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তাই তিনি পরে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরাসরি পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ পান। এটি তাঁর জন্য ছিল বিরল সম্মান।

জেন শুধু গবেষক হিসেবে থেমে থাকেননি। তিনি বুঝতে পারলেন, বন ধ্বংস ও চোরাশিকারের কারণে শিম্পাঞ্জিরা বিলুপ্তির পথে। তাই তিনি সংরক্ষণের কাজে মন দেন। ১৯৭৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘জেন গুডঅল ইনস্টিটিউট’। পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের জন্য শুরু করেন ‘রুটস অ্যান্ড শুটস’ নামে একটি বৈশ্বিক আন্দোলন, যা আজ শতাধিক দেশে সক্রিয়।

তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘জেন গুডঅল ইনস্টিটিউট’ আফ্রিকা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিম্পাঞ্জি সংরক্ষণ, বন রক্ষা এবং স্থানীয় জনগণের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। জেন গুডঅল সারা বিশ্বে পরিবেশ রক্ষার বার্তা ছড়িয়ে দিতেন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, বন সংরক্ষণ ও টেকসই জীবনযাপন নিয়ে কাজ করছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার। এর মধ্যে আছে জাতিসংঘ শান্তির দূত উপাধি, কিয়োটো পুরস্কার, টাইলার পুরস্কার ও ডেম কমান্ডার অব দ্য অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার পুরস্কার।

জেন গুডঅল নানা দেশে পরিবেশ সংরক্ষণ ও তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করার জন্য পরিচিত ছিলেন। বাংলাদেশও তাঁর কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। ২০০৩ সালে জাতিসংঘের শান্তির দূত হিসেবে তিনি বাংলাদেশ সফরে আসেন। এই সফরের উদ্দেশ্য ছিল পরিবেশ সংরক্ষণ ও তরুণদের অনুপ্রাণিত করা। তিনি বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (BCAS) এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সহযোগিতায় বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেন।

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা দেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘প্রকৃতি ও মানুষ একে অপরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই পরিবেশ রক্ষা ছাড়া মানবজাতির টিকে থাকা সম্ভব নয়।’

জেন গুডঅল
ন্যাশনাল জিওগ্রাফি

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে জেন গুডঅলের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব ছিল। বাংলাদেশ সফরে এসে তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের নারী ক্ষমতায়ন কার্যক্রমে বিশেষভাবে মুগ্ধ হন। তিনি দেখেন, ক্ষুদ্রঋণ কীভাবে নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দিচ্ছে এবং গ্রামীণ জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে। পরে তিনি নিজের ‘রুটস অ্যান্ড শুটস’ সংগঠনেও বাংলাদেশ থেকে পাওয়া এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগান।

বাংলাদেশ সফরের সময় জেন গুডঅল স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তিনি তরুণদের বলেন, ছোট ছোট উদ্যোগও পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে। তাঁর এই অনুপ্রেরণা বাংলাদেশের তরুণ পরিবেশকর্মীদের মধ্যে বিশেষভাবে সাড়া ফেলে।

জেন গুডঅল সবসময় বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে দেখতেন। মৃত্যুর পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ অনেক বাংলাদেশি তাঁকে স্মরণ করে বলেছেন, তিনি শুধু পৃথিবীরই নন, বাংলাদেশেরও একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন।

আজ তিনি শুধু একজন বিজ্ঞানী নন। তিনি প্রকৃতি, বন্যপ্রাণী এবং মানবতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার প্রতীক হিসেবে বিশ্বজুড়ে অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন। জেন গুডঅলের গল্প আমাদের শেখায়, মন থেকে স্বপ্ন দেখলে কোনো বাধাই অসম্ভব নয়। ধৈর্য, সাহস আর ভালোবাসা দিয়ে একজন মানুষও পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে।

লেখক: বন্যপ্রাণী পরিবেশবিদ, গবেষক ও লেখক