অস্ত্রের নাম জিন ড্রাইভ

ম্যালেরিয়া থেকে শুরু করে ডেঙ্গু বা হালের চিকুনগুনিয়া—কালে কালে মানুষের জীবনকে করে তুলেছে অতিষ্ঠ। মেরেছে অনেক মানুষ, কঠিন করেছে জীবনযাত্রা। এসব রোগের একটা সাধারণ ব্যাপার হলো এগুলো মশাবাহিত। তাই এই রোগ দমনে মশা নির্মূলেই জোর দেওয়া হয়। সব বড় নগরীকেই মশামুক্ত রাখতে খরচ করতে হয় প্রচুর টাকা। কীটনাশক, অ্যারোসল, কয়েল, মশারি আরও কত-কী আমরা ব্যবহার করি শুধু মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য। তবে আসল শত্রু কিন্তু এই মশারা নয়, বরং মশার দ্বারা বাহিত বিভিন্ন রোগজীবাণু। অর্থাৎ, কোনোভাবে যদি এমন ব্যবস্থা করা যায় যে মশারা আর রোগজীবাণু বহন করবে না, তাহলে আর দুশ্চিন্তা নেই। মশার কামড়ে একটু কষ্ট হলেও মরে যাওয়ার ভয় নেই। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব? আধুনিক জীববিজ্ঞানে অনেক প্রশ্নের উত্তরে একটা জিনিসই বারবার ঘুরেফিরে আসে, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা জিন প্রকৌশল। এখানেও সেই একই উত্তর। আরও নিখুঁতভাবে বললে ক্রিসপার ক্যাস-নাইন।

রোগজীবাণুর জন্য দুর্ভেদ্য মশা বানাতেই দরকার জিন প্রকৌশল। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ম্যালেরিয়ার জীবাণু Plasmodium vivax এর সেকেন্ডারি বাহক হলো মশক প্রজাতি Anopheles। শুধু এই প্রজাতির মশাই ম্যালেরিয়ার জীবাণু ছড়ায়। এখন আমরা যদি জেনেটিক্যালি মডিফায়েড Anopheles মশা বানাই, যার ভেতরে এমন জিন থাকবে, যা ম্যালেরিয়ার জীবাণুকে আর বংশবৃদ্ধি করতে দেবে না। ফলে ম্যালেরিয়া আর ছড়াতে পারবে না ও ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

এ ধরনের জিন প্রকৌশল আসলে খুব কঠিন নয়। অনেক আগেই এ ধরনের মশা তৈরি করা গেছে এবং তা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। কারণটা খুব সোজা। একবার ভাবুন, ১০ হাজার অপরাধীর সমাজে একজন ভালো মানুষ এল। ওই সমাজে কি পরিবর্তন আসবে? উত্তর হলো ‘না’! পরিবর্তন আনতে হলে জনসংখ্যার মধ্যে অপরাধীদের শতকরা অংশ একদম কমিয়ে আনতে হবে। এ জন্য দরকার ১০ লাখ ভালো মানুষ! একই কথা মশাদের ক্ষেত্রেও সত্য। এখন আপনিই বলুন, আপনি কি চাইবেন আপনার পাড়ায় এসে সরকারি লোকজন লাখে লাখে মশা ছেড়ে দিক? সেটা যতই ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী হোক? অবশ্যই না। তাহলে উপায় কী?

একটা ভালো মানুষ যদি পাওয়া যায় যার সংস্পর্শে আসা সব অপরাধী ভালো হয়ে যায়। আবার নব্য ভালো মানুষগুলোও যদি তাদের সংস্পর্শে আসা সবাইকে ভালো বানিয়ে ফেলতে পারে? তাহলে আর ১০ লাখ ভালো মানুষ লাগবে না সেই অপরাধীদের সমাজকে বদলে দিতে, একজনই যথেষ্ট।

ঠিক এই কাজটাই করে ফেলতে পারে জিন ড্রাইভ! জিন ড্রাইভ একটি মলিকিউলার বা আণবিক যন্ত্র। এটি নিউক্লিক অ্যাসিডের সিকোয়েন্স দিয়ে তৈরি। এতে থাকে ক্রিসপার ক্যাস নাইন সিস্টেম তৈরির জন্য দরকারি জিন। সঙ্গে থাকে যেই জিনটা প্রকৌশল করে ঢুকিয়ে দিতে হবে সেটা। কোষ বিভাজনের সময় জিন ড্রাইভ নিজেকে তৈরির জন্য দরকারি পুরো সিকোয়েন্সটি কপি করে ঢুকিয়ে দিতে পারে অন্য একটা ক্রোমোজোমে।

মশা একটি ডিপ্লয়েড প্রাণী। অর্থাৎ এর দুই সেট ক্রোমোজোম থাকে। একটা মশা যখন জন্মায়, তার এক সেট ক্রোমোজোম আসে বাবা থেকে আরেক সেট আসে মা থেকে। বাবা থেকে আসা ক্রোমোজোমে যদি জিন ড্রাইভ থাকে, তাহলে দেখা যাবে যে এই ড্রাইভটা নিজেকে কপি করে বসিয়ে দিচ্ছে মা থেকে আসা ক্রোমোজোমে। একই ঘটনা ঘটবে এই সন্তানদের সন্তানে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলতে থাকবে এটা।

ফলাফল কী হতে পারে? ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে যেখানে সাধারণ অবস্থায় মেন্ডেলের সূত্র মেনে চলা একটা জিনের বাহক মশার সংখ্যা ১৬টিতে ১টি হচ্ছে, সেখানে একই সংখ্যক প্রজন্মের পর জিন ড্রাইভের বাহক মশার সংখ্যা হচ্ছে ১৬টিতে ১৬টি! বিজ্ঞানীদের গবেষণাগারে করা এক্সপেরিমেন্টেও একই রকম ফলাফল এসেছে। ৯৯.৫% সন্তান মশার মধ্যে জিন ড্রাইভ সফলভাবে ছড়িয়ে যায়।

একটা অ্যানোফিলিস মশা একবারে অন্তত ৫০টা ডিম পাড়ে। এদের মধ্যে ১০টাও যদি বাঁচে এবং এক মাস লম্বা জীবনে তারাও ১০টার মতো সন্তান দেয়, এবং প্রত্যেক মশার জিনোমে জিন ড্রাইভ থাকে, ১০ মাস পরে ১০১০ অর্থাৎ এক হাজার কোটি মশার জন্ম হবে যাদের জিন ড্রাইভ আছে। প্রকৃতিতে অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে কখনোই এত মশা এত কম সময়ে জন্ম নেবে না। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো যে তারা মশাদের জনগোষ্ঠীতে জিন ড্রাইভটা ছড়িয়ে দেবে দাবানল ছড়িয়ে পড়ার মতো। কয়েক বছরেই পৃথিবীর একই প্রজাতির প্রায় সব মশার মধ্যে ছড়িয়ে যাবে জিন ড্রাইভগুলো।

এতক্ষণ পর্যন্ত ব্যাপারটাকে শুনতে যতটুকু সরল লাগল বাস্তব কিন্তু মোটেই তত সরল নয়। এখনই জিন ড্রাইভের আশা ধরে বসলে আশাভঙ্গ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। আশাভঙ্গের সম্ভাব্য কারণগুলো বলা যাক।

প্রথমত, প্রকৃতিতে কোনো কিছুই স্থির অবস্থায় থাকে না। প্রতিনিয়ত প্রজাতিতে বৈচিত্র্য তৈরির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে মিউটেশন। তাই প্রকৃতিতে থাকা মশারা জিন ড্রাইভের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে পারে প্রতিরোধ। এর চেয়েও ভয়ের ব্যাপার হলো কোনোভাবে যদি জিন ড্রাইভগুলোতে এমন মিউটেশন হয়ে যায় যার পরিণতি ক্ষতিকারক, সেটা কিন্তু অল্প সময়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে পারে।

দ্বিতীয়ত, একবার জিন ড্রাইভ ছেড়ে দিলে সেটা আর থামানো যায় না। তবে রিভার্সাল জিন ড্রাইভ বলে একটা নতুন প্রযুক্তিও আছে এ জন্য, এটা জিন ড্রাইভের ভেতরের থাকা সবকিছু বের করে ফেলে।

তৃতীয়ত, একবার জিন ড্রাইভ ছেড়ে দেওয়া হলে সেটা একটা প্রজাতিকে চিরকালের জন্য বদলে দেবে। বাস্তুতন্ত্রে এর প্রভাব কী হবে আমাদের সঠিকভাবে জানা নেই। যেমন অ্যানোফিলিস প্রজাতির মশাকে ম্যালেরিয়াবিরোধী করলেই বা কী লাভ যদি অন্য নতুন ক্ষতিকারক কোনো জীবাণু তখন এর মাধ্যমে ছড়াতে পারে? বা কিছু ম্যালেরিয়ার জীবাণু যদি অন্য কোনো বাহক দিয়ে ছড়িয়ে পড়তে শিখে যায়?

ল্যাবের পরিবেশে করা এক্সপেরিমেন্টে জিন ড্রাইভের পরিণতি আর বাস্তব দুনিয়ায় এর পরিণতি যে এক হবে, এটা নিশ্চয়তা দিয়ে বলা মুশকিল।

জিন-ড্রাইভ এখনই তাড়াহুড়ো করে প্রয়োগ করা যাবে না, এটা নিয়ে বিজ্ঞানীরা তাই একমত। কিন্তু এটাকে বাতিলের খাতায়ও তাঁরা ফেলে দিতে চান না। কারণ, প্রতিবছর দুনিয়ার ৪০ কোটি মানুষ কোনো না কোনো মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হন। ২৫ হাজারের বেশি লোক মারা যান। স্মলপক্স ও অন্যান্য অনেক রোগের মতো এই রোগগুলোকেও দুনিয়া থেকে বিদায় করে দেওয়াটা মানবজাতির জন্য এক আশীর্বাদ হয়ে আসবে।

এই প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ প্রভাবের কথা বুঝতে পেরেই ভারতের ধনকুবের রতন টাটা ৭ কোটি ডলার দান করেছেন ইউনিভার্সিট অব ক্যালিফোর্নিয়া স্যান ডিয়েগোকে। এই টাকা দিয়ে তৈরি হবে টাটা ইনস্টিটিউট ফর জেনেটিকস অ্যান্ড সোসাইটি। অর্ধেক টাকা জিন ড্রাইভ নিয়ে গবেষণায় যাবে আর বাকি অর্ধেক যাবে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের এই প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ করে তুলতে। বিজ্ঞানীরা এই প্রযুক্তিকে আরও বেশি ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তুলবেন, এই আশা করতেই পারি আমরা।

জিন ড্রাইভ তাই আমাদের মশাবাহিত রোগমুক্ত এক ভবিষ্যতের আশাই দেখায় শুধু। এখনকার জন্য আমাদের ভরসা ওই মশারি, কয়েল, কীটনাশক। কিন্তু তার চেয়েও বড় অস্ত্র হলো আমাদের চারপাশ পরিষ্কার রাখা। শহর থাকলেই মশার উত্পাত থাকবে। প্রকৃতিতে মশার সংখ্যা কখনো তেমন বাড়তে পারে না, কারণ অন্য প্রাণীদের সঙ্গে টিকে থাকতে তাকে সংগ্রাম করতে হয়। মশা খাদক যেসব মাছ আমাদের শহরের জলাশয়, ড্রেনে ছেড়ে দিলে এবং নিজেদের বাড়িঘর ও চারপাশ পরিষ্কার রাখলেই আমরা পারব মশাবাহিত সব রোগকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখতে।

লেখক: শিক্ষার্থী, জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: আমেরিকান কাউন্সিল অব সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ

*লেখাটি ২০১৭ সালে বিজ্ঞানচিন্তার আগস্ট সংখ্যায় প্রকাশিত