অ্যানিজিওগ্রাফি: হৃদপিন্ডের ভেতরে ছবি তোলার আধুনিক যন্ত্র

পৃথিবীব্যাপী প্রতিবছর যত মানুষের মৃত্যু হয়, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা যান কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ বা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) সাম্প্রতিক রিপোর্ট (ওয়ার্ল্ড হেলথ স্ট্যাটিসটিকস ২০২০) অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছর প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয় হৃদরোগে। অন্য কোনো রোগে এত মানুষের মৃত্যু হয় না। বাংলাদেশে ৩০ থেকে ৭০ বছর বয়সী মানুষের হৃদরোগে মারা যাবার সম্ভাবনা শতকরা ২১.৬। তার মানে, প্রতি পাঁচ জন মানুষের মধ্যে একজনের হৃদরোগে মারা যাবার আশঙ্কা আছে। এই পরিসংখ্যান খুব একটা সুখকর নয় আমাদের জন্য। শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে হৃৎপিন্ড। হৃৎপিন্ডকে আমাদের শরীরে রক্ত সরবরাহের পাম্প মেশিন বলা চলে। রক্ত সরবরাহের জন্য শরীরের প্রায় সব জায়গায় আছে রক্তনালীর জটিল অথচ বিশাল নেটওয়ার্ক।

অ্যানজিওগ্রাফি মেশিন

একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের শরীরের সবগুলি রক্তনালী একটার সাথে আরেকটা যোগ করলে মোট দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার কিলোমিটার। হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ হৃৎপিন্ডের পেশীতে রক্ত সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া, অথবা মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া। রক্তনালীতে মেদ জমলে রক্তনালীর পথ বা প্রস্থচ্ছেদ ছোট হয়ে যায়। পদার্থবিজ্ঞানের ইকুয়েশান অব কন্টিনিউটি বা তরল পদার্থের প্রবাহের সমীকরণ অনুসারে প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল ছোট হলে প্রবাহের বেগ বেড়ে যায়। ফলে শরীরে রক্তচাপ অনেক বেড়ে যায়। হৃৎপিন্ডকে অনেক দ্রুত কাজ করতে হয় তখন। রক্তনালীর পথ যদি একেবারে বন্ধ হয়ে যায় বা ব্লক হয়ে যায়, তখন হৃৎপিন্ডের পেশীতে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে হার্ট অ্যাটাক হয়। মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহ বন্ধ হলে স্ট্রোক হয়। এক্স-রের মাধ্যমে শরীরের রক্তনালীর সামগ্রিক অবস্থা দেখার প্রক্রিয়ার নাম পেরিফেরাল অ্যানজিওগ্রাফি। হৃৎপিন্ডের রক্তনালী দেখার পদ্ধতির নাম করোনারি অ্যানজিওগ্রাফি।

অ্যানজিওগ্রাফি করার জন্য ফ্লুরোস্কোপিক মেশিন ব্যবহার করা হয়। বিশেষ বিশেষ অ্যানজিওগ্রাফির জন্য বিশেষ ধরনের ফ্লুরোস্কোপিক মেশিন আছে। আধুনিক সি-আর্ম ফ্লুরোস্কোপে এক্স-রে ও ইমেজ ইন্টেন্সিফায়ারের একে অপরের বিপরীত দিকে লাগানো থাকে। রোগীকে বেডে শোয়ানোর পর এই ফ্লুরোস্কোপ প্রয়োজন মতো পজিশানে সেট করা যায়, যাতে রোগীর শরীরের ভেতরের ছবি পরিষ্কার দেখা যায়।

অ্যানজিওপ্লাস্টিতে এভাবেই রক্তনালির ব্লক সারানো হয়

রক্তনালীর ঘনত্ব খুব বেশি নয়। তাই এক্স-রে খুব বেশি শোষিত হয় না। ফলে এক্স-রে ইমেজে রক্তনালীকে মেদ, পেশী ও অন্যান্য উপদান থেকে আলাদা করে দেখা যায় না। কিন্তু ইমেজে রক্তনালীকে আলাদা করে দেখতে না পারলে সহজে বোঝা যাবে না রক্তনালীর কোথাও কোন সমস্যা আছে কি না। এই আলাদা করার কাজটা করা হয় কম্পিউটারে ডিজিটাল সাবট্রাকশান পদ্ধতিতে। তাই এ ধরনের অ্যানজিওগ্রাফিকে ডিজিটাল সাবট্রাকশান অ্যানজিওগ্রাফি (DSA) বলা হয়।

অ্যানজিওগ্রাফিক মেশিন সেট করার পর রোগীকে লোকাল অ্যানেস্থেশিয়া দিয়ে রোগীর হাত অথবা পায়ে ছোট্ট ছিদ্র করে ধমনীর ভেতর ছোট্ট ক্যাথেটার প্রবেশ করানো হয়। ফ্লুরোস্কোপির সাহায্যে মনিটরে দেখা যায় ক্যাথেটার ঠিকমতো ধমনীতে ঢুকছে কি না। রক্তনালীর ভেতর কোন স্নায়ুতন্ত্র নেই। তাই ধমনীতে ক্যাথেটার ঢুকলেও কোন ব্যথা লাগে না। ক্যাথেটারটা ধমনীর ভেতর দিয়ে হৃৎপিন্ড পর্যন্ত পৌঁছানো হয়। ডাক্তার ফ্লুরোস্কোপির মনিটরে সবকিছু খেয়াল রাখেন। এই পর্যায়ে ক্যাথেটারসহ হৃৎপিন্ড, মাংশপেশী, রক্তনালীসহ সবকিছুর একটা ছবি সিলেক্ট করেন। একে মাস্ক ছবি বলা হয়। এরপর ক্যাথেটার দিয়ে হৃৎপিন্ডের রক্তনালীতে সামান্য কনট্রাস্ট মিডিয়া যোগ করা হয়। এরপর এক্স-রে শোষণের পরিমাণ বেড়ে যায়। তখন কম্পিউটারের সফটওয়ার প্রতিটি ফ্রেম থেকে মাস্ক ছবি বিয়োগ করে। ফলে কন্ট্রাস্ট যুক্ত রক্তনালী ছাড়া বাকি সবকিছু মনিটর থেকে উধাও হয়ে যায়। মনিটরে দেখা যায় রক্তনালীর ভেতর দিয়ে কন্ট্রাস্ট মিডিয়া আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে। রক্তনালীর কোথাও যদি ব্লক থাকে, দেখা যায় কন্ট্রাস্ট মিডিয়া সেখানে গিয়ে থেমে যায়। এভাবে রক্তনালীর ব্লক ধরা পড়ে।

রক্তনালীর ব্লক দূর করার জন্য বেশ কিছু পদ্ধতি আছে। যদি রক্তনালীতে মেদ জমে ক্যাথেটারের সাহায্যে যেখানে মেদ জমেছে সেখানে ছোট একটা বেলুন পাঠিয়ে সেটা বাইরে থেকে ফুলানো হয়। বাতাসের চাপে অনেকসময় জমাট মেদ সরে যায়। ফলে রক্তনালীর ব্লক সরে গিয়ে রক্তচলাচল স্বাভাবিক হয়। অনেক সময় বেলুন সরিয়ে নিলে ব্লক আবার ফিরে আসে। সেক্ষেত্রে সেই জায়গায় ছোট্ট একটা ধাতব নল বা স্টেন্ট বসিয়ে দেয়া হয়।

স্টেন্ট শব্দটি এসেছে অদ্ভুতভাবে। উনিশ শতকে লন্ডনের একজন ডেনটিস্ট ছিলেন চার্লস টমাস স্টেন্ট । হৃৎপিন্ডের চিকিৎসার সাথে কোনো সম্পর্ক ছিল না তাঁর। তিনি দাঁতের চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য এক ধরনের রাসায়নিক যৌগ উদ্ভাবন করেছিলেন, যেগুলি দিয়ে ভাঙা-দাঁতের মাঝখানে জোড়া দেয়া হত। পরে যে কোনো সার্জারিতে কোন টিস্যুকে নির্দিষ্ট জায়গায় ধরে রাখার জন্য যা ব্যবহার করা হতো তাকে স্টেন্ট বলা হতো। আস্তে আস্তে সেটাই নাম হয়ে যায়।

এই পদ্ধতিতে হার্টে রিং পরানো বা স্টেনটিং এর ফলে রক্তনালীর ব্লক খুলে যায়। এই পদ্ধতিকে ডাক্তারি ভাষায় বলা হয় অ্যানজিওপ্লাস্টি।

অ্যানজিওপ্লাস্টি পদ্ধতিটা দাঁড়িয়েই আছে অ্যানজিওগ্রাফির ওপর। প্রতিবছর এই অ্যানজিওগ্রাফির কারণেই লাখ লাখ মানুষের জীবন বাঁচিয়ে দিচ্ছে।