আপনি আসলে কে?

আপনি যখন ‘আমি’ শব্দটা উচ্চারণ করেন, নিশ্চয় বোঝেন এটি দিয়ে কী বোঝাচ্ছেন। আর যা–ই হোক, এই জিনিসই তো আপনার মস্তিষ্কে সবচেয়ে পরিষ্কার। বয়স এক বছরের মতো হওয়ার পরেই বিষয়টা আপনার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। ‘কে আমি?’ প্রশ্নের ‘আমি’ অংশ তো পরিষ্কার। কিন্তু ‘কে’ অংশটি কি আসলেই পরিষ্কার? বলুন তো, আপনার দেহের কোন অংশ আসলে আপনাকে ‘আপনি’ বানিয়েছে।

বেশির ভাগ মানুষ উত্তরে বলবেন শরীরের কথা। আপনার দেহই আপনাকে আপনি বানিয়েছে বলে মনে হওয়া খুব স্বাভাবিক। এর পেছনে যুক্তিও তো আছে। আপনার জীবনে অসংখ্য ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে যাক, তাতে কিছুই আসে যায় না, আপনার দেহ কাজ করছে, তো আপনি ঠিক আছেন। দেহযন্ত্র অচল, তো নেমে আসবে মৃত্যু।

মনে করুন, মারাত্মক অসুখে পড়ে জামান সাহেব পুরোপুরি বদলে গেছেন। বন্ধুবান্ধবেরা বলছেন, ‘অসুখটা ওকে একদম বদলে দিয়েছে।’ তারা কিন্তু এটা বোঝাতে চাইছেন না যে জনাব জামান আর আগের মানুষটি নেই। তাঁরা শুধু বোঝাতে চাইছেন, ‘জামান কিছুটা বদলে গেছে। তবে শরীরটা এখনো ওরই আছে। তাই সে এখনো জামানই আছে। আগে মানুষ জামান বললে যাকে চিনত, এখনো তাকেই চেনে।’

মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রেও আমরা পরিচয়ের সঙ্গে দেহকে জড়িয়ে ফেলেছি। পিঁপড়ার দেহটাই পিঁপড়া। টিকটিকির দেহটাকেই আমরা টিকটিকি বলি, যেমনি বলি মানুষের দেহকে মানুষ। এই ধারণাকে দেহতত্ত্ব বলা চলে। এটা আসলে কতটুকু সঠিক? চলুন পরীক্ষা করে দেখি।

প্রতি সপ্তাহে আপনি আঙুলের নখ কাটেন। ফেলে দেন নখের বাড়তি অংশটুকু। আপনার দেহ থেকে হারিয়ে যায় অনেকগুলো পরমাণু। তবে আপনি কি বদলে গেলেন, নাকি আগের ‘আপনি’–ই আছেন? অবান্তর প্রশ্ন। আপনি আগের আপনিই আছেন।

আচ্ছা, এবার ধরুন আপনার লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হলো। আগের যকৃতের বদলে আপনি পেলেন তাজা একটি যকৃত। এবার কি তাহলে আপনি বদলে গেলেন? না, এবারও আপনি ঠিক আছেন।

এবার ধরুন, দুর্ভাগ্যক্রমে আপনি কঠিন কোনো রোগে পড়ে গেলেন। একে একে পাল্টে ফেলতে হলো আপনার যকৃত, কিডনি, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, রক্ত, মুখের টিস্যুসহ আপনার দেহের প্রতিটি অঙ্গ। এত সব কিছু পাল্টেও আপনি দিব্যি সুস্থ আছেন। এবার যেহেতু আপনি সব কটি অঙ্গ পাল্টেছেন, আপনার পরিবার কি বলবে আপনি বদলে গেছেন? আপনি আর আগের আপনি নেই? না, তারা এমন কিছু বলবে না। এখনো আপনি ঠিকই আছেন।

কিন্তু ডিএনএ? ডিএনএ পাল্টে ফেললে কী হবে? হয়ত আপনি একটু আগেও আপনিই ছিলেন, কারণ, দেহের সব কটি অঙ্গ বদলে গেলেও আপনার ডিএনএতে হাত দেওয়া হয়নি। আপনার দেহকোষে এখনো আগের ডিএনএ রয়ে গেছে। ডিএনএর কোডেই লেখা আছে আপনার সব তথ্য। তাহলে কি ডিএনএই পরিচয় বহন করে?

এত সুন্দর তত্ত্বটাও কিন্তু একটি জায়গায় মুখ থুবড়ে পড়ছে। অবিকল যমজদের (identical twin) ডিএনএও অবিকল একই। আপনি তো আপনি, কিন্তু আপনার যমজও কি আপনি? না তো। তাহলে ডিএনএ আমাদের উত্তর নয়। ফলে দেহতত্ত্বও শেষের দিকে এসে ব্যর্থ। সবকিছু পাল্টেও আমরা আগের পরিচয়ে থেকে যাচ্ছি। অতএব নতুন সমাধান দরকার।

মস্তিষ্ক নিয়ে চিন্তা করলে কেমন হয়?

ধরা যাক, আপনি আর জামান সাহেব পড়লেন এক পাগল বিজ্ঞানীর খপ্পরে। দুজনকেই পরীক্ষাগারে বন্দী করলেন তিনি। এবার তিনি দুজনের ওপরেই অপারেশন চালালেন। খুলে নিলেন দুজনেরই মস্তিষ্ক। পরে আবার সেই মস্তিষ্কগুলো স্থাপন করলেন খুলির ভেতরে। তবে এবার আপনার মস্তিষ্ক জামান সাহেবের খুলিতে, আর জামান সাহেবেরটা আপনার খুলিতে। কিছুক্ষণ ঘুম পাড়িয়ে রাখার পর জাগানো হলো দুজনকে।

চোখ খুলে তো আপনার চক্ষু চড়কগাছ। কোথায় আপনার হাত-পা? এ যে জামান সাহেবের দেহ! আপনার পাশের খাটেই শুয়ে আছেন জামান সাহেব। কিন্তু হাত-পাগুলো তো আপনার! আগে থেকে দুজনেই একই পরীক্ষার গিনিপিগ বলেই না ধরে নিলেন উনিই জামান সাহেব? কিন্তু…

আচ্ছা, এবার কি আপনিই আপনি আছেন? একটু ভেবে দেখুন। এখনো আপনার চিন্তা, স্বভাব, সব আপনারই আছে। আছে আপনার অতীত জীবনের অম্ল-মধুর সব স্মৃতিও। ফলে আপনি ঠিকই আছেন।

দেহের অন্যান্য অঙ্গ পাল্টানোর সঙ্গে মস্তিষ্ক পাল্টানোর পার্থক্য স্পষ্ট। এগুলো পাল্টালেও আপনার পরিচয় পাল্টায় না। তবে মস্তিষ্ক পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? আপনার শুধু ব্রেইন ট্রান্সপ্ল্যান্টই হলো না, হলো বডি ট্রান্সপ্ল্যান্টও। আপনার অনুভূতি আগের মতোই আছে। ভিন্ন এক দেহে—এই যা। আর আপনার আগের দেহ এখন আর আপনি নন। সেটা এখন জামান সাহেব। তাহলে তো মস্তিষ্কই আমাদের পরিচয় বহন করে। একে আমরা বলব মস্তিষ্কতত্ত্ব। এটি বলছে, ব্রেইন যেখানে, আপনি সেখানে।

কিন্তু!

‘কিন্তু’ বলার কারণ আছে। মস্তিষ্ক কি আসলেই সব সময় পরিচয় বহন করতে পারবে? একটু বাজিয়ে দেখা যাক না। ধরুন, পাগল বিজ্ঞানী আবার ধরেছেন আপনাদের দুজনকে (ধরে নিন, ইতিমধ্যে আপনারা নিজ নিজ দেহে নিজ নিজ ব্রেইন ফিরে পেয়েছেন)। এবার আর তিনি মস্তিষ্ক খুলে নেওয়ার ঝামেলায় গেলেন না। করলেন আরও সহজ কাজ। দুজনের মস্তিষ্ককে কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত করলেন। আলাদাভাবে কপি করলেন ব্রেন দুটির প্রতি বিট তথ্য। দুজনের ব্রেইন সম্পূর্ণ খালি হয়ে গেল। এবার সেই তথ্য আবার কম্পিউটার থেকে মস্তিষ্কে পাঠালেন। তবে আগের মতোই উল্টো করে। আপনার তথ্য গেল জামান সাহেবের মস্তিষ্কে, আর জামান সাহেবের তথ্য আপনার মস্তিষ্কে।

এরপর দুজনেই চেতনা ফিরে পেলেন। তবে আপনার মস্তিষ্ক নামক নিজের অঙ্গটি আপনার মাথায়ই আছে। যেমন আছে জামান সাহেবের। তবে আপনি কিন্তু আপনার দেহে নেই। আছেন জামান সাহেবের দেহে। কারণ, জামান সাহেবের মস্তিষ্কেই তো আপনার সব চিন্তা, স্মৃতি, আশা, ভয়, স্বপ্ন, আবেগ, ব্যক্তিত্ব ভর করেছে। এখনো আপনার পরিবারের জন্য আবেগ-মায়া কাজ করছে আপনার মধ্যে। যদিও আপনি আছেন জামান সাহেবের দেহে। এ অবস্থায় আপনি দৌড়ে বাড়িতে গেলে প্রথমে হয়তো সবাই আপনাকে তাড়াতে চাইবে। কিন্তু সব বুঝিয়ে বলার পর মেনে নেবে, আপনিই তাদের প্রিয় মানুষটি।

দার্শনিক জন লকের মতে স্মৃতিতত্ত্বই সঠিক। আপনার অভিজ্ঞতার স্মৃতিগুলোই আপনাকে অনন্য করে তোলে। লকের কথা মেনে নিলে নতুন জামান সাহেবই আপনি, যার মধ্যে আপনার আগের দেহের কোনো কিছু না থাকলেও আছে স্মৃতি। আগের মস্তিষ্কও যদিও নেই, তবু পরিবর্তিত এই জামান সাহেবই আপনি। এই ধারণাকে আমরা বলব ডেটা থিওরি বা উপাত্ততত্ত্ব। অর্থাৎ, আপনার ব্যক্তিত্ব ও স্মৃতির তথ্য-উপাত্তই আপনাকে ‘আপনি’ পরিচয় দিয়েছে।

আমরা সম্ভবত চূড়ান্ত কোনো উত্তর পেয়ে গেছি। তবে সেটা যাচাই করতে হলে পরীক্ষার বিকল্প নেই। ব্রিটিশ দার্শনিক বার্নার্ড উইলিয়ামস এমন একটি পরীক্ষা (বলা ভাল চিন্তন-পরীক্ষা) নিয়ে ভেবেছেন। এটাই আমরা এখন দেখব।

নির্যাতন পরীক্ষা

অবস্থা-১: পাগল বিজ্ঞানী আপনাকে আর জামান সাহেবকে ধরে নিয়ে গেলেন। একটু আগে যেমন করেছিলেন, সেভাবেই আপনাদের দুজনের মস্তিষ্কের তথ্য অদল-বদল করলেন। দুজনকেই জাগিয়ে তুললেন। এবার তিনি জামান সাহেবের শরীরের কাছে গিয়ে এক ভয়ংকর প্রশ্ন করে বসলেন। প্রশ্ন শোনার আগে ভেবে রাখুন, জামান সাহেবের দেহে কিন্তু এই মুহূর্তে আপনি আছেন। বিজ্ঞানীর প্রশ্ন, ‌‘আমি আপনাদের মধ্যে একজনকে নির্যাতন করব। বলুন, কাকে করব?’

আপনি হলে কী উত্তর দিতেন? হয়তো বলা উচিত আগের দেহের কথা, যেখানে এখন আর আপনি নেই। অতএব, জামান সাহেব নিশ্চয় বলবেন, ‘ওকে করুন।’ উপাত্ততত্ত্বে বিশ্বাসী হলে সিদ্ধান্তটা ভাল হয়েছে। যেহেতু আমার মস্তিষ্কের তথ্য এখন জামান সাহেবের দেহে, তাই আমার আগের দেহ নিয়ে ভাবার কোনো কারণ আছে কি?

আছে কি না, সেটারও আরেক দফা পরীক্ষা হয়ে যাক না!

অবস্থা-২: পাগল বিজ্ঞানী আবার ধরলেন আপনাদের। তবে এবার আর কোনো পাগলামি করলেন না। দুজনকে অনেকগুলো প্রশ্ন করলেন।

বিজ্ঞানী: আপনাদের একজনকে নির্যাতন করব। বলুন কাকে করি?

আপনি: জামানকে।

বিজ্ঞানী: একটা কথা। নির্যাতনের আগে আমি আপনাদের দুজনের সব স্মৃতি মুছে ফেলব। ফলে নির্যাতনের সময় আপনার মনে থাকবে না আগে আপনি কে ছিলেন। এবার কি আপনি সিদ্ধান্ত পাল্টাবেন?

আপনি: না, জামানকেই নির্যাতন করুন।

বিজ্ঞানী: আরেকটা কথা। আমি শুধু আপনাদের স্মৃতিই মুছব না, মস্তিষ্কে নতুন একটা যন্ত্র বসিয়ে দেব, যাতে আপনার কাছে মনে হবে আপনিই জামান সাহেব। তাঁর সব স্মৃতি ও ব্যক্তিত্ব চলে আসবে আপনার কাছে। তিনি যা জানেন বা অনুভব করেন, সব হবে আপনার। তিনিও আবার আপনার সব আবেগ-অনুভূতি পাবেন। তিনি মনে করবেন, তিনি আপনি। এবার কি সিদ্ধান্ত পাল্টাবেন?

আপনি: নাহ। আমি নিজেকে কী ভাবব, তা জেনে লাভ নেই। আমি ব্যথা পেতে চাই না। ওকেই নির্যাতন করুন।

দেখা যাচ্ছে, প্রথম ক্ষেত্রে (অবস্থা-১) আমরা নিজের দেহকে নির্যাতনের শিকার হতে দিচ্ছি। কিন্তু পরের ক্ষেত্রে আমরা চাইছি, জামান সাহেবের দেহ নির্যাতিত হোক। কিন্তু মজার বিষয় হলো দুটো আসলে একই কাজ। দুই ক্ষেত্রেই নির্যাতনের আগে একজনের মস্তিষ্কের তথ্য আরেকজনের দেহে চলে যাচ্ছে। পার্থক্যটা হলো, কখন আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে বলা হচ্ছে। দুই ক্ষেত্রেই আপনার উদ্দেশ্য হলো আপনি নিজে যাতে নির্যাতিত না হোন। তবে প্রথম ক্ষেত্রে আপনি ভাবছেন, ব্রেইন বদলের পর আপনি জামান সাহেবের দেহে চলে গেছেন। আর পরের ক্ষেত্রে আপনি ব্রেইনের তথ্য বদল নিয়ে চিন্তিত নন। যা–ই ঘটুক, আপনি নিজের দেহের নিজের মস্তিষ্কের সঙ্গেই আছেন।

প্রথম অবস্থা হলো উপাত্ততত্ত্বের পক্ষে যুক্তি। আর দ্বিতীয় অবস্থার যুক্তি ব্রেইন থিওরির পক্ষে। আপনার মস্তিষ্ক যেখানে, আপনি সেখানে। পাগল বিজ্ঞানী যদি এটাও বলেন যে তিনি মস্তিষ্কটা খুলে জামান সাহেবের খুলিতে লাগিয়ে দেবেন, তা–ও হয়তো অনেকে আগের দেহকেই বাঁচাতে চাইবেন। এটা হবে তাহলে দেহতত্ত্ব।

নিশ্চয়ই আমরা এখনো বুঝতে পারছি না কী করা উচিত। ব্যাপারটাকে আরও খোলাসা (পড়ুন ঘোলাটে) করতে আরেকটি পরীক্ষা হয়ে যাক। এই পরীক্ষার উদ্ভাবক ডেরেক পারফিট। প্রকাশ করেন তাঁর রিজনস অ্যান্ড পারসনস বইয়ে।

দূরপরিবহন চিন্তন পরীক্ষা

২৭০০ সাল। যত রকম প্রযুক্তির উদ্ভাবন কল্পনা করা সম্ভব, তার সবকিছুই মানুষ সম্ভব করেছে। এর মধ্যে একটি হলো টেলিট্র্যান্সপোর্টার। এর মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে এক জায়গা থেকে বহু দূরের অন্য জায়গায় যাওয়া যায়।

এ যন্ত্র ব্যবহার করতে আপনাকে একটি প্রকোষ্ঠে ঢুকতে হয়। মনে করুন আপনি ঢাকা থেকে সিলেট যাবেন। তাহলে আপনি ঢাকার প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে একটি বাটন চাপবেন। এবার দেয়ালের স্ক্যানার আপনার সম্পর্কে সব তথ্য নিয়ে নেবে। আপনার দেহের সম্পূর্ণ গঠন, প্রতিটি অণু-পরমাণুর অবস্থান, সব তথ্য সংগ্রহ করা হবে। স্ক্যান শেষ হতেই আপনার দেহের প্রতিটি কোষ ধ্বংস হয়ে যাবে। এবার সব তথ্য পাঠানো হবে সিলেটের আগমন প্রকোষ্ঠে। এখানে দেহের পুনর্নির্মাণের জন্য সব রকম পরমাণু প্রস্তুত করে রাখা আছে। নতুন করে আপনাকে গড়ে দেওয়া হলো। আপনি প্রকোষ্ঠ থেকে বেরিয়ে গন্তব্যের দিকে চলে গেলেন।

এভাবেই সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। সমস্যা হলো একদিন। বাটন চাপলেন। কিন্তু স্ক্যানার কাজ করছে না। গড়গড় করে শব্দ হচ্ছে। মন খারাপ করে আপনি প্রকোষ্ঠ থেকে বেরিয়ে এলেন। আসার পথে চোখে পড়ল অফিসের চেক-ইন কাউন্টার। ভাবলেন, বিষয়টা জানিয়ে রাখি। বললেন, ‘যন্ত্র কাজ করছে না। আর কোনো যন্ত্র আছে কি না দেখুন। আমার সিলেটে জরুরি কাজ আছে।’

উত্তরে অফিসার বললেন, ‘আপনার স্ক্যানার ঠিকভাবেই কাজ করেছে। সব তথ্যও নেওয়া হয়েছে। তবে চেতনানাশক ও দেহকোষ ধ্বংসের যন্ত্র কাজ করেনি।’

আপনি বললেন, ‌‘আরে না, কিছুই কাজ করেনি। আমি তো এখনো এখানেই আছি। আমার মিটিংয়ের সময় চলে যাচ্ছে।’

এবার অফিসার আপনাকে ভিডিও দেখালেন, ‘এই যে দেখুন, আপনি এখন সিলেটে। আপনি ঠিক সময়েই মিটিংয়ে পৌঁছবেন।’

কিন্তু আপনি বলে চললেন, ‌‘এই লোক আমি নই। আমি তো এখানে।’

এবার অফিসার লোক ডাকলেন। তারা এসে অফিসারের কথায় সায় দিল। বলল, যন্ত্রের শুধু কোষ ধ্বংসের কাজটি ঠিকমতো হয়নি। সেটা করার জন্য তারা আপনাকে ধরে নিয়ে গেল নতুন আরেকটি প্রকোষ্ঠের দিকে।

আগেও এভাবে আপনার দেহকোষ নষ্ট করা হয়েছে। আগে ভয় না পেলেও কিন্তু আজ আপনি হঠাৎ করে ভয় পেতে শুরু করেছেন। অফিসার বলে যাচ্ছেন, ‘স্যার, ভয় পাবেন না। আপনি মারা যাবেন না। আপনি একটু আগেই তো আপনাকে সিলেটে দেখেছেন।’

কিন্তু আপনি বলছেন, ‘না, ওই লোক নকল। আমিই আসল আমি।’ কিন্তু অফিসারের হাতে আর সময় নেই। আইনে আছে, যাত্রীকে স্থানান্তর করার পর কোষ নষ্ট করে ফেলতেই হবে। প্রথম দৃষ্টিতে ওপরের এই টেলিট্র্যান্সপোর্টেশনকে খুব স্বাভাবিক মনে হলেও শেষে দেখা যাচ্ছে এটা মৃত্যুরই একটি পথ। আমাদের সব তথ্য কোথাও সংরক্ষিত আছে, এই যুক্তিতে কি আমাদের মেরে ফেলা উচিত? আবার ভাবুন, একই টেলিট্র্যান্সপোর্টার দিয়ে তো একই সঙ্গে আরও ৫০টি শহরেও (বা আরও বেশিই) আপনার নকল তৈরি করা যাবে। তাহলে তারা সবাই কি আপনি? উপাত্ততত্ত্বের কফিনে বড় পেরেক পড়ল।

এখন আবার মনে হচ্ছে দেহ বা মস্তিষ্কতত্ত্ব নিশ্চয় খুব ভালো। চলুন আবারও পরীক্ষা হয়ে যাক।

খণ্ডিত মস্তিষ্ক পরীক্ষা

মানব মস্তিষ্কের দারুণ একটি বৈশিষ্ট্য আছে। মস্তিষ্কের ডান ও বাম গোলার্ধ নিজস্ব জগৎ হিসেবে কাজ করে। প্রতিটি অংশ নিজ নিজ কাজ নিয়ে ব্যস্ত। একটি অংশ খারাপ হয়ে গেলেও অপর অংশ টিকে থাকতে পারে। শুধু তা–ই নয়, খারাপ অংশের অনেকগুলো কাজ নিজেও শিখে নিতে পারে। ফলে মানুষটি মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যেতে পারে।

এবার ধরুন, আপনার অবিকল ডিএনএর একজন যমজ সহোদর আছে। কোনো কারণে তার মস্তিষ্ক খারাপ হয়ে গেল। আপনি তাকে আপনার মস্তিষ্কের একাংশ দিতে চাইলেন। ডাক্তার অস্ত্রোপচার করে আপনার মহৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করলেন। আপনি সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে জেগে উঠলেন। জেগে উঠল আপনার যমজও। আপনার মতো একই ব্যক্তিত্ব ও স্মৃতি নিয়ে।

আপনি এবার চিন্তায় পড়ে গেলেন। আপনার যমজ ভাই বা বোনটি এখন আপনার সব অনুভূতি, সব গোপন কথা জানে। ওকে বলে দিতে হবে, কাউকে যেন না বলে। পরক্ষণেই বুঝলেন, তার কোনো দরকার নেই। আপনার গোপন কথা তারও গোপন কথা। সে তো আপনার যমজ নয় এখন। সে–ও তো আপনিই।

আগে মস্তিষ্ক পুরোটা আপনার হলেও এবার আপনি একাংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন। চাইলেও এখন আপনার চিন্তা দুটো উৎস থেকে আসবে না। যদি মস্তিষ্কই আপনার পরিচয় বহন করে থাকে, তবে মস্তিষ্ক একই সঙ্গে দুই জায়গায় থাকলে তার কী হবে? একটু আগে কচুকাটা হওয়া উপাত্ততত্ত্বও এখানে কাজে আসছে না।

তবে লেখার শুরুতেই ধাক্কা খাওয়া দেহতত্ত্বকেই আবার সঠিক মনে হচ্ছে। এটি বলছে, ‘যে দেহে আপনি জেগে উঠলেন, সেটাই আপনি। মস্তিষ্ক তো দেহ কাজে লাগায় চিন্তার জন্যই শুধু। আপনার যমজ আপনি নন। সে এমন এক যমজ, যে এখন আপনার আগের অনুভূতি জেনে ফেলেছে।’

এটা থেকে বোঝা যাচ্ছে, কেন মস্তিষ্ক অর্ধেক হারিয়ে ফেললেও আপনি আপনার দেহেই ছিলেন। তাহলে কি দেহতত্ত্বের জয় হতে চলল? আবারও পরীক্ষা করা যাক না।

টেলিট্র্যান্সপোর্টার পরীক্ষায় আমরা কী করলাম, আবার মনে করে দেখা যাক। আপনার সব তথ্য আরেক জায়গায় পাঠানো হলো। সেই তথ্য দিয়ে ঠিক আপনার মতোই আরেকজন মানুষ তৈরি হলো, যে আসলে আপনার নকলমাত্র। সিলেট শহরে আপনাকে নতুন করে বানানোর সময় কিছু একটা হারিয়ে গিয়েছিল। এমন কিছু, যা আপনাকে আপনি বানায়। দেহতত্ত্ব বলবে, দুই শহরের আপনির মাঝে পার্থক্য শুধু উপাদানে—দুটি ভিন্ন পরমাণু ও উপাদান দিয়ে গড়া। কিন্তু দেহতত্ত্ব নিজে কি সমস্যাটি সমাধান করতে পারবে? চলুন দেখি।

কোষ প্রতিস্থাপন পরীক্ষা

ধরুন আপনার হাতের একটি কোষ বদলে নতুন একটি কোষ দেওয়া হলো। আপনি কি আপনিই আছেন? অবশ্যই। কিন্তু উত্তর কি একই হবে, যদি ১% কোষ বদলে ফেলা হয়? কিংবা ১০%, ৩০%, ৭০%? সিলেটের আপনার নকলে ১০০% কোষ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। আর আমরা বলেছি, তিনি নকল মানুষ। তিনি আপনি নন। তাহলে ঠিক কত ভাগ কোষ বদল করার পর আপনি থেকে নকল-আপনি আলাদা হলো? কখন আপনি ‘মারা’ যাবেন আর আপনার নকল তৈরি হবে?

স্বাভাবিকভাবে বদলাতে বদলাতে ১০০% নতুন কোষ পেলেও আমরা নিজেকেই নকল বলি না। মারা যাচ্ছিও বলি না। তাহলে সিলেটের মানুষটির সঙ্গে আপনার পার্থক্য কোথায়?

দেহকোষ ভাঙন পরীক্ষা

এমন একটি যন্ত্রের কথা ভাবুন, যেটি দেহের সব পরমাণুকে আলাদা করে তাসের মতো এলোমেলো করে ফেলবে। একটু পর আবার ঠিক ঠিকভাবে জোড়া লাগিয়ে দেবে। মানুষটা আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবেন। কিন্তু এতে কি আপনি আপনিই থাকবেন? নাকি পরমাণুগুলো আলাদা হওয়ার পর মারা গেলেন? একে যদি ‘আসল আপনি’ বলা যায়, তাহলে ‘সিলেট আপনি’ কী দোষ করল? পার্থক্য শুধু এটাই যে এখানে আপনার আগের পরমাণু দিয়েই আপনাকে পুনরায় বানানো হয়েছে। আর সিলেটে আপনাকে বানানো হয়েছে অন্য পরমাণু দিয়ে। অথচ মৌলিকভাবে চিন্তা করলে ভিন্ন জায়গার একই পরমাণু তো আসলে ভিন্ন কিছু নয়। আপনার দেহের একটি হাইড্রোজেন আর সিলেটের একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

অতএব সিলেটের মানুষটাকে নকল বললে এই যন্ত্রের নতুন মানুষটাকে আসল বলার কোনো কারণ নেই। তাহলে ওপরের পরীক্ষা দুটির পার্থক্য কী? কোষ প্রতিস্থাপন পরীক্ষা বলছে, আপনি একে একে দেহের অধিকাংশ বা সব কোষ পাল্টে ফেললেও আপনি আপনিই থাকবেন। আবার দেহকোষ ভাঙন পরীক্ষা বলছে, আপনার দেহের আগের সব কোষ নিয়ে পুনরায় গঠিত হলেও আসল আপনি আর সিলেট-আপনির মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। দেহতত্ত্বের কফিনে নতুন আরেকটি পেরেক পড়ল।

তবে দুই পরীক্ষার মধ্যে একটি পার্থক্য আছে। একটিতে কোষ বদল হয়েছে ধীরে ধীরে। অন্যটিতে হয়েছে সব কোষ একসঙ্গে। এতে করে চলমানতা (continuity) হারিয়ে গেছে। এই চলমানতার জন্যেই হয়তো ১০ বছর আগের ছবি ফেসবুকে আপলোড করে আপনি বলেন, এটা আমি। অথচ দুই আপনি কত আলাদা। মুখের গঠন বদলেছে। স্বভাব, ব্যক্তিত্ব বদলেছে। ১০ বছর আগের কোনো কোষ আজ আর নেই। এই লোকের সঙ্গে তো আপনার চেয়ে আপনার ১০ বছরের ছোট যে কারও সঙ্গেই বেশি মিল। তবু ওটাই আপনি।

এ কারণেই ব্যাপারটা হয়তো মিল নয়, বরং চলমানতা। ১০ বছর আগের আপনিই আপনি, কারণ, দুজনের মধ্যে রয়েছে এক চলমান, অবিরাম, অবিচ্ছিন্ন অস্তিত্বের সম্পর্ক। এটা যেন একটি নৌকার মতো। বছর বছর নৌকার এটা-সেটা বদলাতে বদলাতে আগের আর কিছুই নেই। তবু এই নৌকাই সেই নৌকা।

তাহলে, হতে পারে মস্তিষ্কের তথ্য আপনি নন। বরং আপনি একটি ডেটাবেইস, প্রতিনিয়ত যাতে তথ্য যোগ-বিয়োগ হচ্ছে। আর একগুচ্ছ পরমাণুও আপনি নন। আপনি বরং একগুচ্ছ নির্দেশ, যা পরমাণুগুচ্ছকে চালাচ্ছে।

আসলেই কি তাই? নাকি অন্য কিছু? আমাদের পরিচয় তাহলে কোন জিনিস বহন করে? বিষয়টি কি আমাদের নিজস্ব চেতনা? কিংবা দৃষ্টিভঙ্গি?

আপনিও একটু ভাবুন না। বিষয়টিকে নিছক দর্শনের আলোচনা ভাবলে ভুল হবে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান ও পরিচয়। মহাবিশ্বের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক। মহাবিশ্বকে জানতে হলে যে নিজেকেও জানা চাই! বিষয়টি তাই কোয়ান্টাম মেকানিকসেরও একটি আলোচ্য বিষয়।

লেখক: প্রভাষক, পরিসংখ্যান বিভাগ, পাবনা ক্যাডেট কলেজ

সূত্র: ওয়েইট বাট হোয়াই, এনআইএইচডটজিওভি